Beta
বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪
Beta
বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪

গুগলের প্রজেক্ট নিমবাস কী, গাজার সঙ্গে কী সম্পর্ক

গুগলের নিমবাস প্রকল্পের বিরুদ্ধে কোম্পানিটির কর্মীদের প্রতিবাদ। ছবি: বিবিসি।
গুগলের নিমবাস প্রকল্পের বিরুদ্ধে কোম্পানিটির কর্মীদের প্রতিবাদ। ছবি: বিবিসি।
[publishpress_authors_box]

ইসরায়েল সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছে গুগল। তার প্রতিবাদ করায় প্রায় ৫০ জন কর্মীকে বরখাস্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্রের টেক জায়ান্ট কোম্পানিটি।

এর শুরুটা ২০২১ সালে। সেবছর স্বাক্ষরিত চুক্তিটির আওতায় গুগল ও অ্যামাজন যৌথভাবে প্রজেক্ট নিমবাস নামে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের একটি প্রকল্প শুরু করে। ফলে অ্যামাজনও এই চুক্তির একটি পক্ষ।

এই প্রকল্পের মাধ্যমে ইসরায়েলের সরকার ও সামরিক বাহিনীকে ক্লাউড কম্পিউটিং অবকাঠামো, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং অন্যান্য প্রযুক্তিগত পরিষেবা সরবরাহ করা হয়। ইসরায়েলের স্বাস্থ্যসেবা, পরিবহন ও শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় পাবলিক ক্লাউড পরিষেবাও দেওয়া হয় প্রকল্পটির মাধ্যমে।

যাই হোক, প্রকল্পটি বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, যার ফলে গুগল কোম্পানির মধ্যে বিক্ষোভ এবং কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটেছে।

গত ১৬ এপ্রিল গুগলের বেশ কিছু সংখ্যক কর্মী কোম্পানির নিউ ইয়র্ক সিটি ও ক্যালিফোর্নিয়ার সানিভেইল অফিসে বিক্ষোভ দেখায়।

বিক্ষোভে অংশ নেওয়া ৩০ জন কর্মীকে পরদিনই বরখাস্ত করে গুগল। গত সোমবার ওই বিক্ষোভের সংগঠক গ্রুপ ‘নো টেক ফর অ্যাপার্থেইড’ এক বিবৃতিতে আরও ২০ জন কর্মীকে বরখাস্তের খবর জানায়।

‘নো টেক ফর অ্যাপার্থেইড’ ২০২১ সাল থেকেই প্রজেক্ট নিমবাসের বিরুদ্ধে গুগলের কর্মীদের সংগঠিত করা শুরু করে।

গত বছরের নভেম্বেরের শেষদিকে মাই উবেইদ নামে গুগলের এক তরুণী সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় তার পুরো পরিবারসহ নিহত হলে গুগল কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ আরও বাড়তে থাকে।

তখন হাডসন নদী এবং গুগলের মালিকানাধীন চেলসি মার্কেট বিল্ডিংয়ের পাশের ছোট পার্কে প্রায় ৫০ জন লোক জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করেছিল। ওই বিক্ষোভে গুগল ও অ্যামাজনকর্মীদের সঙ্গে ইহুদি ভয়েস ফর পিস ও উইদিন আওয়ার লাইফটাইম নামের সংগঠনের সদস্যরাও যোগ দিয়েছিল।

অনেক গুগলকর্মী গত দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রতিবাদ করে আসছে। তাদের অভিযোগ, তাদের কম্পানি ইসরায়েলকে এমন প্রযুক্তি সরঞ্জাম সরবরাহ করছে, যা ফিলিস্তিনিদের উপর চাপিয়ে দেওয়া জায়নবাদীদের জাতিবৈষম্যমূলক কার্যক্রমে ব্যবহার হয়।

গুগলের কর্মীদের দাবি, তাদের শ্রম কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তা জানার অধিকার তাদের রয়েছে।

প্রকল্পটি নিয়ে অস্পষ্টতা থাকায় তাদের আশঙ্কা, তাদের শ্রম কোনও মানবতাবিরোধী কাজের জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে। অ্যামাজন ও ফেইসবুকের মূল কম্পানি মেটার কর্মীরাও তাদের নিয়োগকর্তাদের সঙ্গে যুদ্ধের সংযোগ নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছে।

গুগলের স্টাফ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার টিনা ভাচভস্কি বলেন, “যখন আপনি জানেন যে, আপনার কোম্পানি ইসরায়েলি সরকারকে এমন সেবা দিচ্ছে, যা ফিলিস্তিনে নৃশংসতা চালাতে সহায়তা করছে, তখন কাজ করার জন্য উদ্দীপিত এবং উৎসাহিত বোধ করা অসম্ভব।”

‘নো টেক ফর অ্যাপার্থেইড’র ওয়েবসাইটে টিনার ওই বক্তব্য প্রকাশিত হয়।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম দ্য ইন্টারসেপ্টের ২০২১ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রজেক্ট নিমবাসের অংশ হিসেবে গুগল ইসরায়েলকে উন্নত এআই প্রযুক্তি দিয়েছে, যা দিয়ে কোনও মানুষের চেহারা শনাক্ত করা এবং কোনও বস্তু ট্র্যাকিংয়ের জন্য ডেটা সংগ্রহ করা যায়।

অ্যাক্টিভিস্ট ও শিক্ষাবিদরাও ফিলিস্তিনিদের লক্ষ্যবস্তু করার জন্য ইসরায়েলের এআই ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুদ্ধে এআই ব্যবহার আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।

গত অক্টোবরে অ্যামাজন ও গুগলের কর্মীরা ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত একটি খোলা চিঠিতে বেনামে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন এভাবে:

“আমরা বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে গুগল ও অ্যামাজন এর বিবেকবান কর্মচারী হিসেবে লিখছি। আমরা বিশ্বাস করি, আমরা যে প্রযুক্তি তৈরি করি তা আমাদের সমস্ত ব্যবহারকারীসহ সব মানুষের সেবা এবং উন্নতির জন্য ব্যবহৃত হওয়া উচিৎ। শ্রমিক হিসেবে যারা এই কোম্পানিগুলোকে চালু রাখে, আমরা নৈতিকভাবে এই মূল মূল্যবোধের লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কথা বলতে বাধ্য। এই কারণে, আমরা অ্যামাজন ও গুগলের নেতাদের প্রজেক্ট নিমবাস থেকে সরে আসতে এবং ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য আহ্বান জানাতে বাধ্য হয়েছি। এখনও পর্যন্ত, গুগলের ৯০ জনেরও বেশি কর্মী ও অ্যামাজনের ৩০০ জনেরও বেশি কর্মী অভ্যন্তরীণভাবে এই চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন। চাকরি হারানোর ভয়ে আমরা নাম প্রকাশ করিনি।”

প্রকল্পটি কেন এত বিতর্কিত

সংক্ষেপে প্রজেক্ট নিমবাস হল ক্লাউড এবং এআই কম্পিউটিং সেবা সরবরাহে ইসরায়েলি সরকারের সঙ্গে গুগল ও অ্যামাজনের একটি লাভজনক ব্যবসায়িক চুক্তি। এর বাজেট ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার।

আরও নির্দিষ্টভাবে বললে, প্রজেক্ট নিমবাসের মাধ্যমে গুগুলের ক্লাউড বিভাগ ও অ্যামাজন ওয়েব সার্ভিসেস (এডাব্লিউএস) ইসরায়েলি সরকারকে এআই ও ক্লাউড কম্পিউটিং অবকাঠামো সরবরাহ করে।

লস অ্যাঞ্জেলেসের ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির (ইউসিএলএ) অধ্যাপক রমেশ শ্রীনিবাসন আল জাজিরাকে বলেন, “আসলে আন্তঃপরিচালনাযোগ্য ও ব্যাপক ক্লাউড কম্পিউটিং- যা মূলত ডেটা স্টোরেজ, ডেটা ম্যানেজমেন্ট ও শেয়ারিং সিস্টেম- সরবরাহের বাইরে এই প্রকল্পটি ঠিক কী কী করে তা নিয়ে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে।

“ইসরায়েলি সরকারের জন্য ডেটা সরবরাহ অবশ্যই ইসরায়েলি সেনাবাহিনী পর্যন্ত যেতে পারে। সুতরাং এটি এমন একটি প্রকল্প যার মাধ্যমে স্পষ্ট হয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো শুধুমাত্র কথিত সামরিক-শিল্প খাতের সঙ্গেই নয় বরং ইসরায়েল সরকারের সঙ্গেও সরাসরি কাজ করে।”

প্রজেক্ট নিমবাস ইসরায়েলের মাটিতে গুগল ক্লাউডের একটি সুরক্ষিত কেন্দ্র স্থাপন করেছে। এটি ইসরায়েলি সরকারকে গুগল এর প্রযুক্তি ব্যবহার করে বড় আকারের ডেটা বিশ্লেষণ, এআই প্রশিক্ষণ, ডাটাবেইজ হোস্টিং এবং অন্যান্য শক্তিশালী কম্পিউটিং কাজ করায় সক্ষম করবে। গুগল ক্লাউড দেশটির সরকারি কর্মচারী ও জ্যেষ্ঠ নেতাদের ডিজিটাল দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণও দেবে।

তবে গুগল এক বিবৃতিতে দাবি করেছে, নিমবাস চুক্তি অত্যন্ত সংবেদনশীল, গোপন, বা অস্ত্র বা গোয়েন্দা পরিষেবার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক সামরিক কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। গুগুলের দাবি, তারা ইসরায়েল ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন সরকারের সঙ্গেই কাজ করে।

চুক্তিটির মাধ্যমে আসলে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীকেও সহায়তা করা হয়। আর ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বর্তমানে ফিলিস্তিনের গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে গত সাত মাস ধরে একটি বিতর্কিত অভিযানে যুক্ত রয়েছে। গাজায় ইসরায়েলের হামলায় এখন পর্যন্ত প্রায় ৩৫ হাজার মানুষ নিহত ও প্রায় এক লাখ মানুষ আহত হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু এবং বেসামরিক নাগরিক।

বিজনেস টুডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এআই ও অন্যান্য প্রযুক্তির সম্ভাব্য অপব্যবহারের বিষয়ে উদ্বেগের কারণেই প্রজেক্ট নিমবাস বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। গুগলের কর্মীরা আশঙ্কা করছেন যে, নিমবাস প্রকল্পের অধীনে তৈরি করা প্রযুক্তি ক্ষতিকারক উপায়ে ব্যবহার করা হতে পারে। এমন খবর পাওয়া গেছে যে, ইসরায়েল তাদের হামলার লক্ষ্যবস্তু সনাক্ত করতে এআই ব্যবহার করছে।

ইসরায়েলি সংবাদ মাধ্যম +৯৭২ ম্যাগাজিন ও লোকাল কলের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, দুটি এআই সিস্টেম, ‘ল্যাভেন্ডার’ ও ‘হয়ার ইজ ড্যাডি?’ গাজায় হামাসের ৩৭ হাজার সদস্যকে শনাক্ত করতে ব্যবহার করা হয়েছিল।

যুদ্ধক্ষেত্রে এআই এর ব্যবহার উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ এটি এখনও অপেক্ষাকৃত নতুন একটি প্রযুক্তি এবং এখনও সারা বিশ্বে এর ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি।

রমেশ শ্রীনিবাসন বলেন, “সবাই জানে এই এআই সিস্টেমগুলো ভুল করবে, যার ফলে অন্যায়ভাবে মৃত্যু এবং অন্যায় হত্যাকাণ্ড ঘটবে, যেমনটি আমরা গাজার অনেক বেসামরিক লোক নিহত হওয়ার ক্ষেত্রে দেখেছি।”

আর কোন কোন কোম্পানির ইসরায়েল যোগ

কেবল ক্লাউড কম্পিউটিং প্রযুক্তি সংস্থাগুলোই নয় বরং আরও অনেক প্রযুক্তি কম্পানিই ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীকে সহায়তা করে।

গত সপ্তাহে ব্রাউন ইউনিভার্সিটির প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সান হোসে স্টেট ইউনিভার্সিটির সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক রবার্তো জে গঞ্জালেজ বর্ণনা করেছেন, কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের পাবলিক কোম্পানি প্যালান্টির টেকনোলজিসও ইসরায়েলের সঙ্গে জড়িত।

১৭ এপ্রিল প্রকাশিত মন্তব্যগুলোতে গঞ্জালেজ বলেন, “কয়েক বছর ধরে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সঙ্গে প্যালান্টির একাধিক চুক্তি করেছে এবং ২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এটি ইসরায়েলের প্রতি সহায়তা বাড়িয়েছে।”

প্যালান্টির ডেনভার-ভিত্তিক একটি ডেটা বিশ্লেষণ সংস্থা, যা সামরিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সরবরাহ করে। ডানপন্থি বিলিওনেয়ার পিটার থিয়েল এর প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার সঙ্গে কাজ করা প্যালান্টির এর আগেও ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর জন্য প্রযুক্তিগত সমাধান সরবরাহ করেছে। প্যালান্টির ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকেও সহায়তা করে।

বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা আমেরিকান ফ্রেন্ডস সার্ভিস কমিটি (এএফএসসি) গাজায় চলমান ২০২৩-২০২৪ সালের ইসরায়েলের সামরিক অভিযান থেকে লাভবান কোম্পানিগুলির একটি তালিকা করেছে। ওই তালিকায় যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের ৫০টিরও বেশি কোম্পানির নাম রয়েছে।

এএফএসসির অ্যাকশন সেন্টার ফর কর্পোরেট অ্যাকাউন্ট্যাবিলিটি বলেছে, “শুধু লকহিড মার্টিন, আরটিএক্স, বোয়িং ও জেনারেল ডাইনামিক্সের মতো বৃহত্তম অস্ত্র প্রস্তুতকারকরাই নয় বরং এমন অনেক কোম্পানিও এই যুদ্ধ থেকে লাভবান হয়েছে যাদের সাধারণত সমরাস্ত্র শিল্পের অংশ হিসেবে দেখা হয় না। যেমন, ক্যাটারপিলার, ফোর্ড ও টয়োটা। এই যুদ্ধের সময় বহু কোম্পানিরই স্টকের দাম আকাশচুম্বী হয়েছে।”

তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, আল জাজিরা, সিএনএন, বিবিসি, বিজনেস টুডে, টেক ডট কো

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত