ইতালীয় শব্দ ‘গ্রাফিও’ (‘স্ক্র্যাচ’) থেকে সৃষ্ট শব্দ গ্রাফিতি। শব্দটি বহুবচন, তবে প্রায়শই একবচন হিসেবে ব্যবহার হয়। সবাই দেখতে পায়- এমন জায়গায় অনুমতি ছাড়াই লেখা বা আঁকা হলে তা গ্রাফিতি।
দেয়ালে লেখা বা আঁকার ইতিহাস সুদীর্ঘ। প্রাচীন রোমান ধ্বংসাবশেষ, মধ্য আমেরিকার তিকাল নামের মায়া শহরের অবশেষে,স্পেনের ১৬শ শতাব্দীর পাথরে এবং মধ্যযুগীয় ইংরেজি চার্চে গ্রাফিতির চিহ্ন পাওয়া গেছে।
প্রাচীন রোমে গ্রাফিতির ব্যবহার ছিল ব্যাপক। সেসময়ও গ্রাফিতির মাধ্যমে মানুষকে রাজনৈতিক মত প্রকাশ করতে দেখা গেছে। প্রাচীন রোমে স্বাধীন সংবাদপত্র বা সোশ্যাল মিডিয়ার মতো আধুনিক যোগাযোগ মাধ্যম ছিল না। ফলে সাধারণ মানুষের পক্ষে তাদের অসন্তোষ বা দাবি জানানো কঠিন ছিল। এ ক্ষেত্রে গ্রাফিতি তাদের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিল। রাস্তাঘাটে উন্মুক্ত দেয়ালে লেখা বার্তাগুলো কখনো কখনো ছিল খুব সরল একটি বাক্যে। আবার কখনো ছিল জটিল রাজনৈতিক কার্টুন।
প্রাচীন রোমে নির্বাচনী প্রচারণার ক্ষেত্রেও গ্রাফিতির ব্যবহার চোখে পড়ার মতো। প্রার্থীরা তাদের নাম, স্লোগান এবং প্রতিশ্রুতি দেয়ালে লিখে বা এঁকে ভোটারদের মন জয়ের চেষ্টা করতেন। বিপক্ষ দলও পাল্টা প্রচার চালাত। এই রকম গ্রাফিতির লড়াই রাস্তায় উত্তপ্ত রাজনৈতিক বিতর্কের সৃষ্টি করত। (ইলেক্টোরাল নোটিস) সামাজিক মন্তব্য ও ব্যঙ্গের জন্যও গ্রাফিতি ব্যবহৃত হত। শিল্পীরা ধনীদের বিলাসবহুল জীবনযাপন, সামাজিক বৈষম্য বা রাজনৈতিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যঙ্গচিত্র ও কৌতুকাশ্রয়ী মন্তব্য দেয়ালে লিখতেন।
ধর্মীয় ও দার্শনিক চিন্তাধারা প্রচারের ক্ষেত্রেও গ্রাফিতির ব্যবহার দেখা গেছে। খ্রিস্টানরা দেয়ালে লিখে তাদের বিশ্বাসের কথা জানাতো বা মূর্তিপূজার সমালোচনা করত। দার্শনিকরাও তাদের চিন্তাধারা জনসম্মুখে তুলে ধরার জন্য গ্রাফিতি ব্যবহার করতেন।
প্রাচীন রোমে গ্রাফিতি রাজনৈতিক প্রতিবাদের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসাবেও কাজ করত। সম্রাটদের নীতি, সিদ্ধান্ত, এবং শাসন পদ্ধতির বিরুদ্ধে গ্রাফিতিতে প্রায়ই ব্যঙ্গ করা হতো।
সম্রাটদের নীতি ও সিদ্ধান্তগুলি প্রায়শই গ্রাফিতির লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠত। যদি কোনো নীতি জনগণের অপছন্দ হতো, তাহলে তা নিয়ে ব্যঙ্গ করে গ্রাফিতি লেখা হতো। যেমনটা হতো সম্রাট নিরোর অতিরিক্ত খরচ এবং খ্রিস্টানদের ওপর তার নির্যাতন নিয়ে। সম্রাটদের সামরিক অভিযানগুলিও গ্রাফিতির বিষয়বস্তু ছিল। যদি কোনো যুদ্ধে পরাজয় হতো বা যুদ্ধ অযথা লম্বা হতো, তাহলে তা গ্রাফিতিতে ব্যঙ্গ করা হতো। সম্রাটকে কাপুরুষ, অযোগ্য বলে অভিহিত করা হতো। সম্রাটদের অর্থনৈতিক নীতি, বিশেষ করে করের বোঝা বা মুদ্রাস্ফীতি, গ্রাফিতিতে প্রায়শই ব্যঙ্গ করা হতো। জনগণের ক্ষতি হয় বা কষ্ট পায়- এমন যেকোনো নীতির বিরুদ্ধে গ্রাফিতিতে প্রতিবাদ করা হতো।
রোমান সমাজে ধনী ও গরিবের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ব্যবধানের সমালোচনা করতে গ্রাফিতি প্রায়শই ব্যবহৃত হত। রোমানরা কয়েকজনের হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল এবং তাদের হতাশা প্রকাশের জন্য গ্রাফিতি ব্যবহার করত। রোমান অভিজাতদের বিলাসিতা ও অপচয়ের সমালোচনা করার পাশাপাশি দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের দুর্দশা তুলে ধরে গ্রাফিতি পাওয়া গেছে।
সামাজিক অশান্তি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে মন্তব্য করতেও গ্রাফিতি ব্যবহৃত হতো। রোমানরা প্রায়শই সহিংসতা এবং গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকত এবং তাদের ভয় ও উদ্বেগ প্রকাশের জন্য গ্রাফিতি ব্যবহার করত। ক্রমবর্ধমান দাস বিদ্রোহ এবং অন্যান্য ধরনের সামাজিক অশান্তির হুমকি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশকারী গ্রাফিতি পাওয়া গেছে।
প্রাচীন রোমে পরিবেশবাদ আজকের মতো এতটা উন্নত ধারণা না থাকলেও, পরিবেশগত সমস্যা নিয়ে মন্তব্য করতে কখনও কখনও গ্রাফিতি ব্যবহৃত হত। উদাহরণস্বরূপ, বনাঞ্চল ধ্বংস এবং নদীর দূষণের সমালোচনা করতে গ্রাফিতি পাওয়া গেছে। পেনাইন পর্বতমালা নিরবীক্ষণ এবং টাইবার নদীর দূষণের সমালোচনা করে গ্রাফিতি পাওয়া গেছে।
সময়ের স্রোতে বেশির ভাগ রোমান গ্রাফিতিই হারিয়ে গেছে। তবে, টিকে থাকা কিছু গ্রাফিতি প্রাচীন রোমের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের মূল্যবান দলিল হিসেবে কাজ করে।