‘‘I don’t like to write on walls.
Write everywhere.’’
১৯৬৮ সালের ১০ মে প্যারিসের রাস্তায় ছাত্রদের ওপর চালানো পুলিশের তাণ্ডবে স্তম্ভিত হয়ে যায় ফ্রান্সের মানুষ। এ সময় ফরাসি ভাষায় চিত্রিত করে দেয়ালে লেখা হয়েছিল এই ছন্দময় বাক্যাংশটি। এই পংক্তির আগে দেয়ালে লেখা ছিল, ‘‘Abolish alienation. / Obedience begins with consciousness; / First, disobey; then write on the walls. / (Law of 10 May 1968)’’।
কবিতার মতো প্যারিসের দেয়ালের এই লেখাটি ‘গ্রাফিতি এক অবৈধ শিল্প’ বইয়ের লেখক বীরেন দাশশর্মা ভাষান্তর করেছেন এইভাবে, ‘‘বিচ্ছিন্নতা দূর করো। / মান্যতার শুরু চেতনায়। চেতনার শুরু অমান্যতায়। / প্রথমেই, অমান্য করো; তারপর লেখো দেওয়ালে। / (১০ মে, ১৯৬৮-র আইন) / দেওয়ালে লিখতে আমার ভালো লাগে না। / ধুর,যেখানে পারো, লেখো।”
যেখানে ইচ্ছা সেখানে লেখার অন্তিম আকাঙ্ক্ষা কখন আসে মানুষের জীবনে? কীভাবে আসে সেই মুহূর্ত? এর উত্তর আছে প্যারিসের সেই ছাত্র আন্দোলনের সময় দেয়ালে ফরাসি ভাষায় লেখা এক শ্লোগানে, ‘‘বাস্তববাদী হও, অসম্ভবের দাবি করো’’। কিংবা ‘‘যা অসম্ভব, তা-ই দাবি করো’’।
তবে, প্যারিসে দেয়ালে লেখা কোনও অসম্ভব দাবি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তো নয়-ই, ১৯৬৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় কবি হেলাল হাফিজ লিখেছিলেন ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’। কোনও ‘অসম্ভবের দাবি’ নয়, তিনি শুধু আহ্বান করেছেন তার লেখা এই কবিতার প্রথম দুই পংক্তিতে, ‘‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময় / এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’’
উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের সময় লেখা হয়েছিল ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’। পত্রিকায় ছাপানো যায়নি এই কবিতাটি। উত্তাল সময়ে ভীতিকর পরিবেশে গভীর রাতে ভয়াবহ এক পরিস্থিতিতে আহমদ ছফা ও হুমায়ূন কবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার দেয়ালে দেয়ালে চিকা মেরে স্লোগান হিসেবে লিখলেন সেই কবিতার প্রথম দুই লাইন। মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও দুই লাইনের এই পংক্তির সেই উদ্দীপনা এখনও ফিকে হয়ে যায়নি। মাঝে মাঝে আজও দেয়ালে লেখা হয় এই কবিতা— এক জীবন্ত স্লোগান।
দেয়ালে রঙ দিয়ে স্লোগান লেখা এই ‘চিকামারা’র চল বাংলাদেশে প্রথম শুরু হয় ১৯৬২ সালে। ড. মোহাম্মদ হাননানের লেখা ‘বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস ১৮৩০ থেকে ১৯৭১’ বই থেকে জানা যায়, ১৯৬২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে আইয়ুব-বিরোধী স্লোগান রাজপথে লিখছিল ছাত্র-নেতৃবৃন্দ।
ওই রাতে দেয়ালে লেখা হলো, ‘‘সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক’’, ‘‘Down Ayub’’, ‘‘পূর্ব বাংলাকে শোষণ করা চলবে না’’। প্রথম এই চিকামারা হয়েছিল ঢাকা হলের পূর্বপাশে রেলওয়ে হাসপাতালের পাশে টি অ্যান্ড টি’র একটি দেয়ালে। ইন্দোনেশিয়ায় এসব দেয়াল লেখার প্রচলন ছিল। পত্রিকায় প্রকাশিত সেই ছবি দেখে ঢাকায় এই প্রথম দেয়াল লিখনের অনুপ্রেরণা বলে মনে করা হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় প্রথম ‘প্রতিবাদী চিকামারা’ বা দেয়াল লিখন হয় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খোলাকে উপলক্ষ্য করে। তাই এ নিয়ে প্রতিবাদী মিছিলের আগে ছাত্রদের প্রতিক্রিয়া বুঝতে ১৯৭৫ সালের ১৭ অক্টোবর রাতে চিকামারা হয়। দেয়ালে লেখা হয়, ‘‘এক মুজিবের রক্ত থেকে লক্ষ মুজিব জন্ম নেবে।’’ ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা প্রধানভাবে এ কাজে যুক্ত ছিল। ড. মোহাম্মদ হাননানের লেখা ‘বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস ১৯৭২ থেকে ২০০০’ বই থেকে এ তথ্য জানা যায়।
বাংলাদেশের মানুষের স্লোগানের ইতিহাস সেই ১৯৪৮ সাল থেকে— দেশভাগের পরের বছরেই। মানুষের মুখের কথাই— মনের কথাই— স্লোগান হিসেবে উজ্জীবিত করেছে। বিশেষ করে ভাষা আন্দোলনে ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানের মাধ্যমেই মানুষের তার প্রাণের দাবির কথা বলেছিল। দেয়ালে লেখা হয়েছিল কি না এই স্লোগান— এ সম্পর্কে স্পষ্ট করে জানা যায় না— প্রচলনও ছিল না তখন। এই স্লোগানই মানুষকে করেছে আন্দোলিত। কোনও অসম্ভবকেও দাবি করেনি তারা। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পোস্টার ও প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘‘শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’’, ‘‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’’।
শাসকের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক— চাওয়া-পাওয়া— লেনদেনের এই দাবি মানুষ মুখেই বলে প্রথমে। তারপর ধীরে ধীরে ছড়িয়ে যায় নানা জায়গায়— নানা ভাষায়। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে স্বাধীন হতে যাওয়া বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনের সময় থেকে দেয়াল লেখার প্রচলন শুরু হয়। তারপর আর কখনও খালি থাকেনি কোনও দেয়াল— সেই দেয়াল লিখন— চিকামারা— মানুষের শরীরেও লেখা হয়েছে সেই দাবির ভাষা।
ইতিহাসে সেইসব চিহ্ন না থাকলেও ১৯৬৭ সালে পশ্চিম বাংলায় সশস্র বিপ্লব শুরু করেন চারু মজুমদার। ওই বছরের শেষদিকে সশস্ত্র গোপন দলগুলো অত্যন্ত দ্রুতই ছড়িয়ে যায় পূর্ব পাকিস্তানের গ্রামে-গঞ্জে। মুখে বলা স্লোগান লেখা হয় দেয়ালে, ‘‘বন্দুকের নলই ক্ষমতা উৎস’’। সিদ্দিকুর রহমান স্বপনের লেখা ‘বাংলাদেশের গণ-আন্দোলন:স্লোগান প্ল্যাকার্ড ও পোস্টার’ বইতে এই তথ্যের উল্লেখ আছে।
এর পরের বছরের শেষ দিকে ছাত্রসংগ্রাম কমিটির নেতৃত্বে ১১ দফা কর্মসূচি প্রণয়ন—বাংলাদেশকে স্বাধীন করার আন্দোলনে ছিল উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। এই সময় সভা-সমাবেশ-মিছিলে অনেক কিছুর মধ্যে শোনা যায় সেই স্লোগান, ‘‘জয় বাংলা’’। নানা পর্যায়ের এই স্লোগান আজও বাংলার মানুষের যাপিত জীবনকে করেছে অনুপ্রাণিত— হয়ে উঠেছে এক অমর স্লোগান।
১৯৬৯ সালে গণ-অভ্যুত্থানের পরই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার দিকে এগুতে গিয়ে সভা-সমাবেশে সবার কণ্ঠে স্লোগান উঠল, ‘‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’’। এরপর ১৯৭১ সালের মার্চ মাস। শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলনের স্লোগান, ‘‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’’, ‘‘তোমার আমার ঠিকানা,পদ্মা মেঘনা যমুনা’’।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও প্রচার দফতর’র পক্ষ থেকে বিভিন্ন ধরনের পোস্টার প্রকাশ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে শিল্পী কামরুল হাসানের আঁকা ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’। এছাড়া শিল্পী দেবদাস চক্রবর্তীর আঁকা পোস্টার ‘বাংলার হিন্দু / বাংলার খৃষ্টান / বাংলার বৌদ্ধ / বাংলার মুসলমান / আমরা সবাই বাঙালি’। এই পোস্টারের লেখা আজকের বাংলাদেশেও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক— গুরুত্বপূর্ণ। নানা ধরনের দাবিতে এই পোস্টারের কথা প্রেরণা যোগায় এই সময়েও বাংলাদেশের মানুষকে এক করতে।
মুখের ভাষা, স্লোগান, প্ল্যাকার্ড, পোস্টার, দেয়াল লিখন, দেয়াল চিত্র এবং গ্রাফিতি— এই সবই কথা বলতে পারার অধিকার— দাবি আদায়ের ভাষা। মানুষের সঙ্গে মানুষের— জনগণের সঙ্গে রাষ্ট্রের— মানুষের সঙ্গে শাসকের যোগাযোগের ‘অস্ত্র’। যতই এসব সম্পর্ক জটিল হয়— ততই এসব হয় ইঙ্গিতপূর্ণ— গোপন— অপ্রকাশ্য— নিগূঢ়। ভাষা, সৃজনশীলতা আর শিল্প মিলেমিশে শেষপর্যন্ত প্রকাশবাদী হওয়ার অন্তিম বাসনাই থাকে এসব আয়োজনে— পরিসরে— স্বতঃস্ফূর্তভাবে। যা হয়ে ওঠে ‘অসম্ভব দাবি’র মতো।
প্রখ্যাত চলচ্চিত্র শিক্ষক ও লেখক বীরেন দাশশর্মা। তিনি ‘গ্রাফিতি এক অবৈধ শিল্প’ বইয়ে লিখেছেন, ‘‘গ্রাফিতির চিত্রভাষার মধ্যে লুকিয়ে আছে এক অবদমিত জনমণ্ডলীর গভীর গোপন আশা ও আকাঙ্ক্ষা। প্রতিটি গ্রাফিতিই যেন অবচেতন মন থেকে উঠে-আসা স্বপ্ন— যে-স্বপ্ন বিশ্লেষণের অপেক্ষায় রয়েছে।’’
দেয়ালচিত্র থেকে গ্রাফিতি— এই পার্থক্য কত দূরের বা কাছের সেটা সবসময় নির্ধারণ করে স্থান-সময় আর ঘটনার আবহে। বীরেন দাশশর্মা লিখছেন, ‘‘গ্রাফিতি-শিল্পী তার পারিপার্শ্বিক জগৎ ও জীবন সম্পর্কে কিছু বলতে চান— এবং তা বলতে চান এই মুহূর্তে। … গ্রাফিতি-শিল্পী স্থায়িত্বের জন্য সৃষ্টি করেন না, সৃষ্টি করেন মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য, সংযোগ স্থাপনের জন্য, সচেতন করার জন্য।’’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ব্রিটিশ কাউন্সিলের উল্টোদিকে শিক্ষকদের বহুতল আবাসিক ভবনের সীমানা দেয়ালে কালো রঙের অক্ষরে লেখা ‘কষ্টে আছে আইজুদ্দিন’ দেখেছিলেন কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক আন্দালিব রাশদী। ২০১২ সালে এক লেখায় তিনি এ কথা উল্লেখ করেছেন। ২০১৫ সালে চট্টগ্রামে এক দেয়ালে আঁকা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাবের এক সদস্য। অথবা ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে দেয়ালে তার প্রতিকৃতি এঁকে নিচে লেখা হলো, ‘‘I AM AVIJIT KILL ME’’।
এসব দেয়ালে আঁকা চিত্র-লেখা গ্রাফিতি শিল্পের ‘রূপান্তর পর্ব’র উদাহরণ হিসেবে গণ্য করা যায় বাংলাদেশে। যদিও জেনারেল এরশাদের ক্ষমতার পতনের সোচ্চার দাবিতে ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর নূর হোসেন বুকে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’ আর পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লেখা ছিল। গুলিস্তানের জিরো পয়েন্টে পুলিশ-বিডিআর(বিজিবি)’র গুলিতে নিহত হন তিনি। শরীর, ভাষা আর প্রতিবাদের এক অনন্য সম্মিলন— এক অন্তিম আখ্যান।
মানুষের চিন্তার ভাষা— আকাঙ্ক্ষার ভাষা— চেতনার ভাষা— মুখের ভাষা— লেখার ভাষাই যে প্রতিবাদের ভাষা— স্লোগানের ভাষা— দেয়ালের ভাষা— প্ল্যাকার্ড-পোস্টারের ভাষা— এই ঐতিহ্যের শুরুটা ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে এই বাংলাদেশে। এই মানুষেরই কথা— এই মানুষেরই ভাষা— ‘বৈধ’ ‘অবৈধ’র সীমা ছাড়িয়ে হয়ে গভীর সম্পর্ক গড়ে মানুষের সঙ্গে।
এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে গ্রাফিতি শিল্প হিসেবে ইঙ্গিতপূর্ণ ভাষায় ‘সুবোধ’র দেখা পাওয়া পাওয়া যায় ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আগারগাঁওয়ের এক দেয়ালে। ওই সময় অনেকবার নানা ঘটনায় ঢাকার বিভিন্ন দেয়ালে দেখা পাওয়া গেলেও সাত বছর পর আবার ফিরে এসেছে সুবোধ। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টিএসসির মেট্রোস্টেশনের দেয়ালে সুবোধের দেখা মিলেছে আবার।
এক অচেনা রাগী সুবোধ লাথি মেরে ফেলে দিচ্ছে শাসকের চেয়ার। এ চিত্রের ব্যাখ্যা বিচিত্রমুখী হলেও এই বিষয়ে স্পষ্ট কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার নেই কোনও সুযোগ। এক ধরনের সিদ্ধান্তহীনতা— ধাঁধায় আটকানো এবারের সুবোধ। সম্প্রতি সুবোধের এই দেয়ালে একপাশে লেখা হয়েছে, ‘‘সুবোধ, গণকবরে কারা?’’ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুক ‘হবে কি গ্রাফিতি ফ্যানস’ পেইজে গত ১ সেপ্টম্বর এই সংযুক্তির ছবিটি প্রকাশ করেছে।
২০১৮ সালের মার্চ মাসে শুরু হয় কোটাবিরোধী আন্দোলন। পরের মাসে ৯ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে স্লোগান ওঠে, ‘‘ক্যাম্পাসে হামলা কেন? / প্রশাসন জবাব চাই’’, ‘‘সন্ত্রাসীর কালো হাত / ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’’. ‘‘বঙ্গবন্ধুর বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’’ এবং ‘‘কোটা/সংস্কার’’।
কোটাবিরোধী এই আন্দোলন আবার শুরু হয় ২০২৪ সালের জুলাই মাসের শুরুতে। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’র ব্যানারে এই আন্দোলন রূপ নেয় সরকার পতনের আন্দোলনে। ফেইসবুকের দেয়ালেও স্থান করে নেয় এই আন্দোলন। কথায়-লেখায়, চিত্রে, ডিজিটাল পোস্টার আর ভিডিওতে ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।
এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৬ জুলাই গুলিতে নিহত হয় রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। সেই দৃশ্যের ভিডিও ছড়িয়ে যায় বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। প্রবল প্রতিবাদে আবু সাঈদের প্রতিকৃতি এঁকে স্প্রে-রঙে ঢাকার দেয়ালে লেখা হয়, ‘‘বুকের ভেতর অনেক ঝড় / বুক পেতেছি গুলি কর’’।
অন্য আরেক দেয়ালে কালো রঙে আরও লেখা হয়, ‘‘আমার টাকায় কেনা গুলি, / কাইড়া নিল ভাইয়ের খুলি!’’, ‘‘আসছে ফাগুন অনেক দেরী / এক্ষুণি দ্বিগুণ হও’’, ‘‘রক্ত দেখলে বাড়ছে সাহস’’।
‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ আগস্টের দিকে এগিয়ে গিয়ে পরিণত হয় ‘স্বৈরাচারী সরকার পতন’র আন্দোলনে। ৩ আগস্ট ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত হয় ছাত্র-জনতার সমাবেশ। সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘোষণা করে।
এই দাবির সমর্থনে ভাষার প্রতি ভালবাসার কথা— না ভুলে যাওয়ার কথায় চিত্রিত দেয়ালের উপরেই স্বৈারাচারী শাসকেরও ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে— প্রতিবাদ জানিয়ে লেখা হয়, ‘‘মুক্তি সবার!’’, ‘‘শেখ হাসিনার অনেক গুণ /পুলিশ দিয়ে করছো খুন’’, ‘‘স্বৈরাচার জুলাই’’, ‘‘এক দফা’’। পরিস্থিতি, প্রেক্ষাপট আর আন্দোলনের লক্ষ্য ছড়িয়ে যায় সব দেয়ালে— কোনও কিছু না মনে রেখে— এক আরাধ্য কিছু পেতে। একুশের দেয়ালগুলোর পরিণতি হয়েছে এমনই।
তারপর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগের পর উন্মুক্ত গণভবনে মানুষ গিয়ে দেয়ালে লিখে, ‘‘পতন’’, ‘‘36 JULY’’। এরপরই বদলাতে শুরু করলো বাংলাদেশের দেয়াল। ঢাকতে থাকলো ‘প্রতিবাদের ভাষা’— ‘ক্ষোভের ভাষা’। রঙে-রেখায়-লেখায়— আপন ইচ্ছায়— প্রকাশের গভীর বাসনায় চিত্রিত হলো মানুষের সৃজনশীল উদ্ভাসন।
দেয়ালে লেখা হয়, ‘‘এখন দরকার জনগণের সরকার’’। এক ‘নতুন’ বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে লেখা হলো, ‘‘আমি সুপার বাংলাদেশ’’, ‘‘চেতনায় চব্বিশ / হৃদয়ে বাংলাদেশ’’, ‘‘স্বাধীন হয়েছি / এবার সভ্য হই। আবার লেখা হলো, ‘‘চিড়িয়াখানাই একমাত্র কারাগার / যেখানে বন্দিরা অপরাধী নয়’’। প্রাণ-প্রকৃতি আর প্রাণীজগত নিয়ে ভাবনাও এলো দেয়ালে। ঢাকার কোনও এক নির্জন রাস্তায় রঙ উঠা দেয়ালে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী মানচিত্র এঁকে লিখলেন,, ‘ভালো মানুষ / ভালো দেশ / স্বর্গভূমি বাংলাদেশ’’।
দেয়ালে আঁকা হলো একের পর এক বাংলাদেশ— এক গভীর আবেগের প্রত্যয়। থাকল না দেয়ালের বাধা। সব ভেঙে এক হতে চাইল সবাই। পার্থক্য থাকল না মানুষের ভাষায়— দেয়ালের ভাষায়।