Beta
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪

জ্ঞানী-গুণীদের কেন বড় চুল

longhair-090324
[publishpress_authors_box]

‘চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা’; জীবনানন্দ দাশ থেকে ধার করে কত পুরুষ কত নারীর জন্য এই পঙক্তি আওড়েছে। নারীর চুলের প্রতিটি ভাঁজেই লুকিয়ে আছে একেকটি কবিতা। রূপকথার রুপাঞ্জেল চুল এলিয়ে দিলে রাজপুত্র সে চুল বেয়ে উঠে আসতো। দীঘল চুল নারীকে আকর্ষণীয় করে।

নারীর দীঘল আর রেশমি চুলের হাজারো স্তুতির ভিড়ে পুরুষের চুলের কদর যে একেবারে নেই তা কিন্তু নয়। নারীর মতো পুরুষের চুলও হয়ে উঠেছে কবিতা। যেমন শামসুর রাহমানের কবিতায় কাজী নজরুল হয়েছেন- ‘ …ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ…’।

আজকের নারী কি পুরুষ, সবাই কেটেছেঁটে যার যার মতো সামলে রাখছে চুল। অথচ এক কালে কোনো কোনো সমাজে খাটো চুলকে অশুভ এবং লম্বা চুলকে সৌভাগ্যের প্রতীক মনে করা হতো। প্রাচীন ইতিহাস বলছে, তখনকার বিশ্বাস ছিল মানবজাতির শক্তির গোড়া থাকতো চুলেই।      

আর একটু বুদ্ধি খাঁটিয়ে ভাবলে নজরে আসবে, এক সময় বুদ্ধিদীপ্ত ব্যক্তি মাত্রই চুল বড় রাখতেন। বলতে গেলে চুলের ধরন তাদের চেহারায় বুদ্ধি ছটা যেন আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। তাদের বুদ্ধির ছটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার পেছনের রহস্য কি তবে ওই চুল?

লম্বা চুলের বিদ্বানদের নিয়ে সকাল সন্ধ্যা তাই চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখেছে।

উশকোখুশকো চুলের আইনস্টাইন

বিজ্ঞানী আইনস্টাইন মানে মাথার চারদিকে ফুলেফেঁপে থাকা চুল। দেখে মনে হতেই পারে, এই বিজ্ঞানী কখনই মাথার চুলে চিরুনি চালাননি।

চুল নিয়ে আইনস্টাইন ছেলেকে লেখা চিঠিতে বলেছিলেন, “মাথার চুল নিয়ে আমি বেশ বিপাকে থাকি সব সময়। মেয়ে হলে আমি অবশ্যই লম্বা ও কোঁকড়ানো চুল রাখতাম। কিন্তু যেহেতু ছেলে তাই একটু ছেঁটে রাখি। তারপর চুলগুলো আমার মাথার উপর খাঁড়া হয়ে থাকে।”

কাঁধ ছুঁই ছুঁই চুলে রবিঠাকুর

যৌবন কাল একটু পার হতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চুল ও দাঁড়ি বড় করেন। রবিঠাকুর বিজ্ঞাপনের জন্যও লিখতেন। এরমধ্যে তেলের বিজ্ঞাপন বার্তা লিখেছিলেন তিনি। ‘কেন কুন্তলীন ব্যবহার করিব’ বিজ্ঞাপনে রবি ঠাকুর বলেন, “কুন্তলীন তৈল আমরা দুই মাস কাল পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছি। আমার আত্মীয়ের বহুদিন হইতে চুল উঠিয়ে যাইতেছিল। কুন্তলীন ব্যবহার করিয়া এক মাসের মধ্যে তাঁহার নুতন কেশোদ্গম হইয়াছে। এই তৈল সুবাসিত এবং ব্যবহার করিতে ইহার গন্ধ ক্রমে দুর্গন্ধে পরিণত হয় না।”   

কান ঢাকতে লম্বা চুলে আবদুল কালাম

বিজ্ঞানী আবুল পাকির জয়নুল আবেদিন আবদুল কালাম ২০০২ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ভারতের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। দুই কানের উপর লেপ্টে নেমে আসতো তার চুল। আসলে জন্ম থেকে আবুল কালামের ছিল এক কান। তাই চুল দিয়ে কান ঢেকে রাখতেন তিনি। শুরুতে অনেক লম্বা চুল রাখতেন তিনি। একদিন আমজাদ হাবিব তার চুল কেটে দেন। ওই চুলের ছাঁট পরে আর কখনই পাল্টাননি আবদুল কালাম। এমনকি ভারতের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে নিজের নাপিতকে একই ছাঁট দিতে বলতেন তিনি।

বাবরি চুলের নজরুল

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম চুল ছিল ঢেউ খেলানো কোঁকড়া। কাঁধ পর্যন্ত নেমে আসতো তার চুল।

নজরুলের চুল ছিল কাঁধ পর্যন্ত ঢেউ খেলানো আর কোঁকড়ানো। এমন বৈশিষ্ট্য হলে বাবরি চুল বলে। ফরাসি বাবরি মানে সিংহের কেশরের মতো কাঁধ ছড়ানো চুল। অর্থাৎ এমন চুল সঙ্গে বীরত্বেরও যোগ আছে।

নিউটনের চুল না পরচুলা?

নিউটনকে দেখা যেত নানা রঙের চুলে। লালচে ছোট চুলে কখনও। তারপর ওই রঙের লম্বা চুলও ছিল তার। এরপর ধূসর লম্বা চুলের নিউটনের মাথায় সম্ভবত টাক পড়ে যায়। আবার অনেকে বলেন, নিউটনের কখনই টাক ছিল না; ৩০ বছর বয়সের পর তার চুল পেকে যায়। তাই বিভিন্ন সময় লম্বা চুলের পরচুলা পরে থাকতেন নিউটন। পরচুলার কারণে অনেকে তার চুলের প্রকৃত রঙ নিয়ে সংশয়ে পড়েন। তবে নিজের চুলের রঙের সঙ্গে মিলিয়েই তিনি ওইসব পরচুলা পরতেন বলে ধারণা করা হয়।    

১৭২৭ সালে বিজ্ঞানি আইজাক নিউটন ঘুমের মধ্যেই মারা যান। মৃত্যুর পরে আইজাক নিউটনের চুল পরীক্ষা করেন গবেষকরা। নিউটনের চুলে পারদ ও লোহা পাওয়া যায়। বিজ্ঞানিরা মনে করেন, পারদের কারণে তার নার্ভাস ব্রেকডাউন ঘটেছিল, যা থেকে মৃত্যু হতে পারে। অথচ জীবদ্দশায় পারদের বিষক্রিয়া থেকে চুল পড়ে যাওয়া কিংবা মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণের মতো কোনো উপসর্গ টের পাননি নিউটন।   

ওস্তাদ জাকির হোসেনের এলোমেলো চুল

বয়স হতে হতে কিছু চুল ঝরেছিল তবলার জাদুকর ওস্তাদ জাকির হোসেনের। নয়তো আরেকটু তরুণ কালে এই তবলা বাদকের মাথায় কিছুটা ফুলে থাকতো চুল। খুব লম্বা না হলেও ঘাড়ের কাছাকাছি চুল রাখতেন তিনি। আর তবলার তেহাই দিতে গেলে ঝাঁকি লেগে দুলে উঠতো সেই চুল।  

ভিঞ্চির লম্বা লাল চুল

ইতালীয় চিত্রকর লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির সব ছবিতে দেখা যায়, তার চুল ঘাড় ছাড়িয়ে নেমে দাঁড়ি ছুঁয়েছে। চিত্রশিল্পীদের এমন করে লম্বা চুল রাখার চল কিন্তু এখনও রয়েছে। ভিঞ্চির লাল রঙের চুল নিয়ে অনেকেই হাসাহাসি করতো। চুল সাদা হতে শুরু হলে চেস্টনাট জাতের বাদাম সিদ্ধ করে এক ধরনের মিশ্রণ বানান ভিঞ্চি; যেন ধূসর চুলগুলো ঢেকে রাখা যায়।

মিলটনের দীঘল চুল

ইংরেজ কবি জন মিলটনের চুল ছিল হালকা বাদামি রঙের। একটু ঢেউ খেলানো তার সেই চুল কাঁধ পেরিয়ে কুণ্ডুলি পাকিয়ে থাকতো গায়ে।  

শক্তির আধার চুল  

গবেষণা বলছে, আমাদের আচরণ, চিন্তাভাবনা, বুদ্ধি এবং শক্তি প্রভাবিত হয় চুল দিয়েও। চুলের লম্বা হওয়ার শারীরিক প্রক্রিয়া সবার জন্যই একই রকম। তবে ভৌগলিক এবং পরিবেশের বৈচিত্রে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে চুলের বৈশিষ্ট্য আলাদা আলাদা হতে পারে।

এসবের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও আছে। মাথার চুল যখন বড় রাখা হয়, তখন মাথার ত্বকে ফসফরাস, ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন ডি সঞ্চালন বেড়ে যায়। এই উপাদানগুলো মস্তিষ্কের দুটো টিউব দিয়ে মানুষের শরীরে চলে আসে। পুরো প্রক্রিয়াটির কারণে মানুষের স্মৃতিশক্তি আরও ধারালো হয়ে ওঠে। তাতে করে মানুষ শারীরিক ভাবে আরও শক্তি ও ধৈর্য অনুভর করে।   

চুল কাটা মানে শক্তি আর পুষ্টির অপচয় বলেও মানতো লোকেরা। কারণ এই চুল বড় হতে আরও অনেক শক্তি জোগান দিতে হতো শরীরে। চুল হলো শরীরের অ্যান্টেনা। সূর্যের আলোর শক্তি উপাদাগুলো মস্তিষ্কে পর্যন্ত পৌঁছে দেয় চুল।  

প্রাচীন ভারতবর্ষে সাধুসন্তুরা লম্বা চুল রাখতেন। এখনও আমাদের দেশে বাউল, লালন অনুসারীরা চুল লম্বা রাখেন। সন্তদের জটাধারী চুল মস্তিষ্কের মধ্যভাগে থাকা পিনিয়াল গ্রন্থিকে সজাগ করে। এই অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি মাথার সামনের দিকে চৌম্বক ক্ষেত্র জাগিয়ে রাখে। পিনিয়াল গ্রন্থির এই তৎপরতার কারণে মনোযোগ এবং মগজের ধার বেড়ে যায়।  

মনীষীদের লম্বা চুল তাদের চেনার ফ্যাশন হয়ে উঠলেও হলেও, এর পেছনের রহস্যে কিন্তু এমন বিজ্ঞানও আছে।   

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত