এক অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ প্রাণ ঝড়ে যাওয়ার পর গ্রিন কোজি কটেজ শপিং মলে নানা অনিয়মের ঘটনা বেরিয়ে আসছে। ভবনটি থেকে পুলিশ চারজনকে গ্রেপ্তার এবং মামলা করলেও এই অব্যবস্থাপনার দায় যাদের হওয়ার কথা, সেই মালিকের হদিসই মিলছে না।
অগ্নিকাণ্ডের পরপরই জানা গিয়েছিল, ভবনটি আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের নির্মাণ করা। তবে এই নির্মাণ প্রতিষ্ঠানটি বলছে, তারা ভবনটি ফ্ল্যাট মালিকদের কাছে বুঝিয়ে দিয়েছে। এরপর থেকে সার্বিক তত্ত্বাবধান করছিল ‘গ্রিন কোজি কটেজ স্পেস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন’।
তবে এই সমিতির কাউকে এখন আর পাওয়া যাচ্ছে না। ধারণা করা হচ্ছে, তারা সবাই আত্মগোপন করেছেন।
গত ২৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বেইলি রোডের সাত তলা এই ভবনে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। তাতে ৪৬ জন মানুষের মৃত্যুর পাশাপাশি আরও অনেকে আহত হন।
এই ভবনের অধিকাংশ তলায় ছিল রেস্তোরাঁ, যার মধ্যে কাচ্চি ভাই, পিজ্জা ইনও রয়েছে। যারা মারা গেছেন, তাদের বেশিরভাগই খাবারের দোকানগুলোতে গিয়েছিলেন সেদিন।
মামলায় নাম নেই
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে যে মামলা করেছে, সেখানে মালিকদের কারও নাম দেওয়া হয়নি; যদিও এই ধরনের যে কোনও ঘটনায় মালিকদের দায়ই আগে আসে।
মামলার বাদী রমনা মডেল থানার এসআই (নিরস্ত্র) মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম ঘটনার চার দিন পর সোমবার সকাল সন্ধ্যার জিজ্ঞাসায় বলেন, তাৎক্ষণিক পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মামলা হয়েছে, ফলে মালিকদের নাম আসেনি।
‘গ্রিন কোজি কটেজ স্পেস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের’ বিষয়ে তার জানা ছিল না বলেও দাবি করেন তিনি।
শহীদুল বলেন, “স্পেস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের বিষয়ে আমার জানা ছিল না। তাৎক্ষণিক আমরা যে তথ্য পেয়েছি, সেটা মামলাতেই উল্লেখ করেছি। এখন মামলার তদন্তে যিনি আছেন, পুরো বিষয়টি তিনি দেখবেন।”
মামলার তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার জন্য নাম-ফোন নম্বর চাইলে ‘দেখে বলতে হবে’ জানিয়ে ফোন রেখে দেন তিনি। পরে আরেকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি সাড়া দেননি।
এরপর সকাল সন্ধ্যা কথা বলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা জোনের সহকারী কমিশনার সালমান ফারসির সঙ্গে।
তিনি বলেন, “যাদের যাদের যুক্ততা পাওয়া যাবে, তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। তখন তাড়াতড়ি মামলা করাতে কিছু তথ্য বাদ গেছে। কিন্তু এখন তদন্ত শুরু হয়েছে, দোষীরা কেউ বাইরে থাকতে পারবে না।”
অগ্নিকাণ্ডের পর যে চারজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে, তাদের মধ্যে ভবন কিংবা ফ্ল্যাট মালিকদের কেউ নেই।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন- ভবনটির নিচতলার চা-কফির দোকান চায়ের চুমুক এর দুই মালিক আনোয়ারুল হক ও শফিকুর রহমান রিমন, কাচ্চি ভাইয়ের ওই শাখার ব্যবস্থাপক জয়নুদ্দিন জিসান ও গ্রিন কোজি কটেজ ভবনের ব্যবস্থাপক মুন্সি হামিমুল আলম বিপুল।
এখন পর্যন্ত মনে করা হচ্ছে, নিচতলার চায়ের চুমুক দোকান থেকেই আগুনের সূত্রপাত, পরে তা ওপরে ছড়িয়ে পুরো ভবনটি পুড়িয়ে দেয়।
আমিন মোহাম্মদ দেখাচ্ছে সমিতিকে
ভবনটি নির্মাণকারী হিসেবে আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের নাম আসার পর একদিন আগে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে জানায়, ভবনটির সার্বিক তত্ত্বাবধান করছিল ‘গ্রিন কোজি কটেজ স্পেস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন।’
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, “বিল্ডিংয়ের মালিক আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ নয়। শুধু জয়েন্ট ভেঞ্চারে নির্মাণ কাজটি (ডেভেলপার হিসেবে) আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ সম্পন্ন করেছে।
“২০১৫ সালে অর্থাৎ ৯ বছর আগে ভবনটির নির্মাণ কাজ শেষ হলে মালিকানাও হস্তান্তর করা হয়। বর্তমানে ভবনটির কার্যক্রম পরিচালনাসহ সার্বিক তত্ত্বাবধান করছে ‘গ্রিন কোজি কটেজ স্পেস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন।”
সাধারণত কোনও নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান কোনও ব্যক্তিগত জায়গায় অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে ভবন নির্মাণ করে থাকে। এরপর ফ্ল্যাট ভাগাভাগি করে নেয়। নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত তাদের ফ্ল্যাটগুলো বিক্রি করে দেয়।
সেক্ষেত্রে সাত তলা গ্রিন কোটি কটেজের বিভিন্ন ফ্ল্যাটগুলোর একাধিক মালিক হওয়ার কথা। তারা আলাদাভাবেই নিজেদের জায়গা ভাড়া দিয়েছেন বিভিন্ন দোকান ও রেস্তোরাঁকে।
অগ্নিকাণ্ডের পর স্থানীয় বিভিন্নজনের সঙ্গে কথা বলে ‘গ্রিন কোজি কটেজ স্পেস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন’ বিষয়ে কোনও ধারণা পাওয়া যায়নি। এই সমিতির অস্তিত্ব নিয়েও সন্দেহ করেছেন কেউ কেউ।
এমনই একজন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “ফ্ল্যাট মালিকদের সঙ্গে আমিন মোহাম্মদ গ্রুপের প্রতিনিধিদের মাঝেমধ্যে বৈঠক হতো। আর ভবনকেন্দ্রিক সব কিছু ম্যানেজার দেখতেন।”
ফ্ল্যাট মালিক যারা, অগ্নিকাণ্ডের পর তাদের কেউ দেশ ছেড়েছেন বলেও দাবি করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি।
রাজউক কোথায়
ব্যস্ত বেইলি রোডে এই ভবনটি রেস্তোরাঁ বসানোর জন্য অনুমোদিত নয় বলে অগ্নিকাণ্ডের পর জানা যাচ্ছে। আরও নানা অনিয়মের কথাও বেরিয়ে আসছে।
আগুন নেভানোর পর রাজউক জানিয়েছিল, ভবনটিতে অফিস করার অনুমোদন নেওয়া হয়েছিল, রেস্তোরাঁ করার জন্য নয়। ভবনটি অকুপেন্সি সার্টিফিকেট নেয়নি। এছাড়া তারা কিছু অননুমোদিত কনস্ট্রাকশন করেছিল।
তবে আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ দাবি করছে, বিল্ডিং কোডসহ সব নিয়ম মেনেই ৯ বছর আগে তারা ভবনটি নির্মাণ করে দিয়েছিল।
“এই নির্মাণ প্রক্রিয়ায় রাজউকের বিল্ডিং কোডসহ সংশ্লিষ্ট সকল নিয়ম অনুসরণ করা হয়েছে,” বলা হয় বিজ্ঞপ্তিতে।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভবন মালিকদের সায় নিয়েই ভবনের রেস্তোরাঁ মালিকরা জননিরাপত্তার তোয়াক্কা না করে নিচতলায় বিপুল পরিমাণ গ্যাস সিলিন্ডার মজুত করে। শুরু থেকেই গ্যাস সিলিন্ডারগুলো নিচতলায় সিঁড়ির প্রায় বেশিরভাগ অংশ জুড়ে রাখা হতো।
এই অগ্নিকাণ্ড তদন্তে তদন্তে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে প্রধান করে একটি কমিটি করা হয়।
রাজউকের পক্ষ থেকেও ৭ সদস্যের আলাদা তদন্ত কমিটি হয়েছে। ভবনটির নকশা ও অনুমোদন প্রক্রিয়া পরীক্ষা করে দেখবে তদন্ত কমিটি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ত্রুটি পেলে তা শনাক্ত করবে এবং দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করবে।
রাজউকের পরিচালক (প্রশাসন) মো. মমিন উদ্দিন স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে শুক্রবার একথা জানানো হলেও তদন্ত কমিটির সদস্য কারা, সে বিষয়ে কিছু লেখা ছিল না।
তদন্তের অগ্রগতি জানার জন্য সোমবার ফোনে মমিন উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। তবে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
আগুনে পোড়া ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে অনেকে সোমবারও ক্ষোভ জানাচ্ছিলেন ভবন তদারককারী কর্তৃপক্ষ রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট অন্য সংস্থাগুলোর ভূমিকা নিয়ে।
পুরান ঢাকার বাসিন্দা মনিরুল হক বাবু নামে একজন বলেন, “চোর তো চুরি করতেই চাবে। কিন্তু চোর ধরার দায়িত্ব যাদের ছিল, তারা যদি তা না করে তাহলে কীভাবে হবে?
“রাজউক, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস- তারা সবাই যদি তাদের দায়িত্ব ঠিকমত পালন করে তাহলেই তো এরকম ঘটনা আর ঘটে না।”
অগ্নিকাণ্ডের পর ভবনটিতে অনিয়মের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরে রাজউকের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, “তারা যখন জানতই, তখন ব্যবস্থা নিল না কেন? তারা ওই সময় ব্যবস্থা নিলে এতগুলো মানুষ মারা যায়? তারা তো দায় এড়াতে পারে না।
“শুধু রেস্টুরেন্ট মালিকদের গ্রেপ্তার করলে হবে না, যারা এটি করার অনুমতি দিয়েছে তাদেরও তো গ্রেপ্তার করতে হবে।”
অগ্নিকাণ্ডের পর রাজউকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, গ্রিন কোজি কটেজে ২০১৯ সালে একবার অভিযান চালিয়ে ভবনের অননুমোদিত অংশ ভেঙে দিয়েছিল তারা।
মেয়ে ভিকারুননিসা নূন স্কুলে পড়ার কারণে প্রত্যেক দিনই সামিয়া বেগমকে আসতে হয় বেইলি রোড। সোমবার স্কুলে থেকে ফেরার পথে মা-মেয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন ভবনটির কঙ্কাল।
ভবন মালিকদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না- শোনার পর পাল্টা প্রশ্নে সামিয়া বলেন, “আমরা বলে কী করব? আমাদের কথায় কিছু হয়? ভবন মালিক যারা, তাদের তো নিশ্চয়ই অনেক টাকা, তাদের কি আর আইনের আওতায় আনা হবে?”
রাজউককে দায়ী করে তিনি বলেন, “রাজউক বা সরকার কি দায় এড়াতে পারে? আমার নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব তাদের ছিল, তারা কি সেটা দিতে পারছে? নাকি কিছু টাকার জন্য কিছু ব্যক্তি আমাদেরকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে?”
পোড়াবাড়ি দেখতে ভিড়, ক্ষোভ
পুড়ে যাওয়া গ্রিন কোজি কটেজ এখনও ঘিরে রেখেছে পুলিশ।আশপাশের ভবনগুলোতে কর্মব্যস্ততা শুরু হয়েছে। এরই মাঝে উৎসুক মানুষের ভিড় করছে পোড়াবাড়ি দেখতে।
তবে পুলিশ কাউকেই ভবনে ঢুকতে দিচ্ছে না। দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা জানিয়েছেন, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কাউকে ভবনে ঢুকতে দেওয়া হবে না।
ভবনটির নিচতলার এক পাশে ছিল মোবাইল ফোনের দোকান গ্যাজেট অ্যান্ড গিয়ার। সেই দোকানের মালিক রাহাত মিয়া শুভ এখনও জানেন না, তার কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে।
সোমবার সকালে ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এখনও তো ভেতরেই ঢুকতে পারলাম না। আমার কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে- তাও জানি না। অপেক্ষা করতাছি যদি ঢোকা যায়।”
প্রায় দেড় কোটি টাকার মোবাইল ফোন, ফোনের পার্টস দোকানে ছিল বলে দাবি করেন রাহাত মিয়া শুভ।
অগ্নিকাণ্ডের দিন খুব ব্যস্ততার মধ্যে ছিলেন গ্রিন কোজি কটেজের বিপরীতে ‘ঠাণ্ডা গরম’ নামের এক জুস পার্লারের কর্মী মো. শাকিল হোসেন।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, “রাত ৯.৪০ এর দিকে হঠাৎ আগুনের কথা কানে আসে। দোকান থেকে বেরিয়ে দেখি- গ্রিন কোজি কটেজের গেটের কাছে আগুন। কিন্তু আগুন দেখে মনে হয়েছিল ছোট আগুন, নিভে যাবে।
“দোকানে ঢুকব, এমন সময় শুনি জোরে জোরে আওয়াজ। যেন বোম ফাটতাছে। তারপর নিজের চোখের সামনে দেখলাম পুরো বিল্ডিংটা পুড়ে গেল। তখন আমরা যারা আশেপাশে ছিলাম আমাদের জন্যও আগুন নেভানো সম্ভব ছিল না।”
“ভাই বিশ্বাস করেন- সেই রাতে ঘুমাতে পারিনি। এখনও পোড়া গন্ধ মনে হয় নাকে লেগে রয়েছে,” বলেন শাকিল।