Beta
শুক্রবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
শুক্রবার, ২০ ডিসেম্বর, ২০২৪

৩৯ বছর গেল, হরেন্দ্রনাথের আদালতে ঘোরার শেষ হবে কবে

হরেন্দ্রনাথ চন্দ্র।
হরেন্দ্রনাথ চন্দ্র।
[publishpress_authors_box]

তিনটি মামলা হয়েছিল ৩৯ বছর আগে, দুটিতে খালাস পেয়েছেন, কিন্তু একটি আছে ঝুলে; আর তাই আদালতের বারান্দায় ঘোরাই শেষ হচ্ছে না হরেন্দ্রনাথ চন্দ্রের। ‘জাস্টিস ডিলেইড ইজ জাস্টিস ডিনাইড’- এই অমর বাণীই যেন সত্যি হতে চলেছে তার ক্ষেত্রে।

হরেন্দ্রনাথ এক সময় রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকে চাকরি করতেন। তহবিল তছরুপের অভিযোগে ৩৯ বছর আগে চাকরি হারান তিনি। এরপর তার বিরুদ্ধে তিনটি মামলা হয়।

দুটি মামলা থেকে খালাস পেলেও ব্যাংকের করা বাকি একটি মামলায় তিনি নিম্ন আদালত এবং হাই কোর্টে খালাস পেলেও আপিল বিভাগে তা ঝুলে আছে।

হরেন্দ্রনাথের বিশ্বাস, তার খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে দণ্ড চেয়ে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আপিল বিভাগে আপিল করেছে। কিন্তু ইচ্ছা করেই শুনানি করছে না।

“তারা বুঝতে পারছে যে এ মামলায় জিততে পারবে না। তারা ভাবছে, রায়ের আগে যদি আমি মারা যাই তাহলে টাকা-পয়সা দেওয়া লাগবে না। এ জন্যই শুনানি করছে না,” বলেন তিনি।

হরেন্দ্রনাথের এই মামলার বিষয়ে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কোনও বক্তব্য সকাল সন্ধ্যা জানতে পারেনি।

আদালতে মামলাজট বাংলাদেশে সব সময়ে আলোচিত একটি বিষয়। সুপ্রিম কোর্টের তথ্য অনুযায়ী, আপিল বিভাগে বিচারাধীন এখন ২৭ হাজারের বেশি মামলা। হাইকোর্টে ঝুলছে ৫ লাখের বেশি মামলা। আর অধস্তন আদালতগুলোতে মামলার সংখ্যা ৩৭ লাখের বেশি।

সব মিলিয়ে ৪২ লাখের বেশি মামলা আদালতে রয়েছে নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। তারই একটিতে ভুগছেন হরেন্দ্রনাথ।

ব্যাংকের চাকরি হারিয়ে এক সময় বাস কাউন্টারে টিকেট বিক্রি করে সংসার চালিয়েছেন হরেন্দ্রনাথ। তাতে সামাজিক ও পারিবারিকভাবে হেয় হতে হয় তাকে। দুই মেয়েকেও বিয়ে দিতে নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। কিন্তু মামলার পেছনে ভিটেমাটিসহ সব খরচের পর আর কোনও উপায় ছিল না তার।

৪০ বছর বয়সে চাকরিটি হারিয়েছিলেন হরেন্দ্রনাথ। যৌবনের চোকাঠ পেরিয়ে এখন তিনি ৭৯ বছরের বৃদ্ধ। জীবনের সময় ফুরিয়ে এলেও মরার আগে প্রমাণ করতে চান নিজের নির্দোষিতা। চান হারানো সম্মান ফিরে পেতে।

কুষ্টিয়ার খোকসার হেলালপুর গ্রামের বাসিন্দা হরেন্দ্রনাথ বিএ পাস করে ১৯৭৯ সালে সোনালী ব্যাংকে ক্যাশিয়ার-কাম ক্লার্ক পদে যোগ দেন। তিন বছর পর পদোন্নতি পেয়ে সিনিয়র ক্যাশিয়ার-কাম ক্লার্ক হন। এর পর তাকে ব্যাংকের ঢাকার যাত্রাবাড়ী শাখায় বদলি করা হয়।

যাত্রাবাড়ী শাখায় থাকা অবস্থায় ১৯৮৫ সালে সোনালী ব্যাংকের তহবিল তছরুপের অভিযোগ ওঠে হরেন্দ্রনাথ চন্দ্রসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে।

তার বিরুদ্ধে করা মামলার নথিপত্র থেকে জানা যায়, তখন রেমিটেন্স সংক্রান্ত ১৬ লাখ ১৬ হাজার ১০০ টাকা যাত্রাবাড়ী শাখা থেকে ব্যাংকের লোকাল অফিসে স্থানান্তর করা হয়। সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তা সিল-স্বাক্ষরসহ লিখিতভাবে সমুদয় অর্থ বুঝে নেয়।

এরপর ১৯৮৫ সালে ব্যাংকের বিভাগীয় তদন্তে ওই টাকা পাওয়া যায়নি বলে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। এ অভিযোগের ভিত্তিতে পরের বছর ১৯৮৬ সালে হরেন্দ্রনাথসহ ৯ জনকে চাকরিচ্যুত করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

এদিকে, ১৯৮৫ সালেই হরেন্দ্রনাথসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরো মামলা করে। এ মামলার বিচারে ১৯৮৬ সালের ১৫ নভেম্বর রায়ে হরেন্দ্রনাথসহ সবাই খালাস পান।

এদিকে, গ্রাহকের টাকা জমা না দেওয়ার অভিযোগে অন্য একটি মামলায় ১৯৮৬ সালে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে স্থাপিত সামরিক আদালতের বিচারে হরেন্দ্রনাথের সাত বছর কারাদণ্ড হয়। একই আদালত থেকে অন্যান্যদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

তিন বছর কারাগারের পর ১৯৯০ সালে মুক্তি পান হরেন্দ্রনাথ।

সুপ্রিম কোর্ট, ন্যায়বিচারের প্রতীক দাঁড়িপাল্লা রয়েছে যার মনোগ্রামে।

এইচ এম এরশাদ সরকারের পতনের পর বিশেষ সামরিক আদালতের সব কার্যক্রম বাতিল করে উচ্চ আদালত। এর ফলে হরেন্দ্রনাথসহ সবাই সেই মামলায় খালাস পান।

এরপর সামরিক আদালতে দেওয়া সাজার বিরুদ্ধে এবং চাকরি হারানোর ক্ষতিপূরণ চেয়ে ২০১২ সালে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন হরেন্দ্রনাথ। রিট আবেদনের শুনানি শেষ হলেও অর্থঋণ আদালতে মামলা বিচারাধীন থাকার কারণে রায় ঘোষণা হয়নি।

এর আগেই ১৯৮৮ সালে সোনালী ব্যাংকের তহবিল থেকে ১৬ লাখ ১৬ হাজার ১০০ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে অর্থ ঋণ আদালতে হরেন্দ্রনাথসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে রেখেছিল ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।

হরেন্দ্রনাথের অভিযোগ, গোপনে করা ওই মামলায় একতরফা রায় হয়।

রায়ে তাদের দোষী সাব্যস্ত করে সমুদয় অর্থ ফেরত দেওয়ার আদেশ দেয় আদালত। এর বিরুদ্ধে আবেদন (মিস কেস) করেন হরেন্দ্রনাথ। ১৯৯২ সালের ১৯ আগস্ট ঢাকার জেলা জজ আদালত আপিল গ্রহণ করেন; একই সঙ্গে বিচারিক আদালতের আদেশ বাতিল করেন।

এরপর ওই রায়ের বিরুদ্ধে সোনালী ব্যাংক ২০১৯ সালে হাই কোর্টে আপিল করে। ২০২২ সালের ২৯ আগস্ট সেই আপিল খারিজ করে দেয় হাই কোর্ট।

গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের আবেদন (লিভ টু আপিল) করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এরপর থেকে ব্যাংক মামলাটির শুনানির কোনও উদ্যোগ নেয়নি।

তবে হরেন্দ্রনাথ শুনানির জন্য ইতোমধ্যে আপিল বিভাগে তিনবার আবেদন করেছেন। এখন শুনানির জন্য আদালতের কার্যতালিকার ১৪ নম্বর ক্রমিকে রয়েছে। আগামী সপ্তাহ আদালতে মামলাটি শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।

৩৩ বছর ধরে এ মামলা লড়ে আসা হরেন্দ্রনাথ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমারসহ বিবাদীদের ৮ জনের সবাই বিভিন্ন সময় মারা গেছেন। একমাত্র আমিই বেঁচে আছি।”

২০২৩ সালে হরেন্দ্রনাথের হয়ে এই মামলাটি পরিচালনার জন্য সরকারি সংস্থা আইনগত সহায়তা কেন্দ্র (লিগ্যাল এইড) থেকে দায়িত্ব পান ব্যারিস্টার ওমর ফারুক।

ব্যারিস্টার ওমর ফারুক।

তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ২ নম্বর আদালতে মামলাটি শুনানির জন্য সসয় নির্ধারণ হয়েছিল। সেই সময় প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি দৈনন্দিন কার্যতালিকায় ওঠানোর নির্দেশ দেন। এর পর আপিল বিভাগের ২ নম্বর আদালত না বসায় মামলাটির শুনানি হয়নি।

“গত ৫ আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের পর আপিল বিভাগ নতুন করে গঠিত হলে মামলাটি প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নজরে আনা হয়। তিনি মামলাটির গুরুত্ব অনুধাবন করে শুনানির জন্য আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় রাখার নির্দেশ দেন।”

দীর্ঘদিন এই মামলা চালাতে গিয়ে হরেন্দ্রনাথের সহায়-সম্বল হারানোর কথা এই আইনজীবীও বলেন।

“সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ অহেতুক ৪০ বছর নিরীহ এই ব্যক্তিকে মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করছে। জেতার সম্ভাবনা না থাকা সত্ত্বেও মামলার প্রতিটি ধাপে আপিল করছে।”

হরেন্দ্রনাথ বলেন, “আমার ফসলি সম্পত্তি সব বিক্রি করে দিতে হয়েছে। আমার ভিটাবাড়িও বিক্রি করে দিতে হয়েছে। যে সম্পত্তি বিক্রি করেছি, তার মূল্য এখন আনুমানিক আড়াই কোটি টাকা। আমি এখন একজন ভূমিহীন। কেরানীগঞ্জে বড় মেয়ের বাসায় থাকি।”

ব্যাংকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, “আমাকে ব্যাংক হয়রানি করছে। এ মামলা জজ কোর্টে জিতেছি, হাই কোর্টেও জিতেছি, এখন আপিল বিভাগে চলছে। এরা এই কেস করে রেখেছে, কিন্তু মুভ করে না। এরা চায় মামলাটা পড়ে থাকুক।”

সামরিক আদালতের দেওয়া দণ্ডে জেলখাটা এবং চাকরির ক্ষতিপূরণ চেয়ে ২০১২ সালে যে রিট আবেদন করেছিলেন হরেন্দ্রনাথ, তা ২০১৬ সালে শুনানি শেষে রায় হওয়ার পর্যায়ে গিয়েছিল।

হরেন্দ্রনাথ বলেন, “তখন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আবেদন দেয় যে, আমিসহ আরও ৯ জনের নামে নিম্ন আদালতে অর্থ আত্মসাতের মামলা আছে। যেটা এখন আপিল বিভাগে শুনানির জন্য রয়েছে। এটা শেষ না হওয়া পযন্ত হাই কোর্টের রায় ঘোষণা স্থগিত রাখে।”

এ মামলা নিষ্পত্তি হলে ব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করবেন জানিয়ে তিনি বলেন, “পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে আমাকে মর্যাদাহানি করা হয়েছে, সম্পত্তি হারাতে হয়েছে। সব ক্ষতিপূরণ চাইব।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত