Beta
বৃহস্পতিবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫
Beta
বৃহস্পতিবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫

ভারতে মুসলিম জনসংখ্যার বিস্ফোরণের দাবি কতটা সত্য

নয়াদিল্লির জামা মসজিদে গত রমজান মাসের শেষ শুক্রবারে জুমার নামাজ পড়ছেন মুসলমানরা। ছবি: এপি।
নয়াদিল্লির জামা মসজিদে গত রমজান মাসের শেষ শুক্রবারে জুমার নামাজ পড়ছেন মুসলমানরা। ছবি: এপি।
[publishpress_authors_box]

সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদ (ইএসি) প্রকাশিত একটি নতুন কার্যপত্রে দাবি করা হয়েছে, দেশটির জনসংখ্যায় মুসলমানদের অংশ ১৯৫০ সাল থেকে ৪৩ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে।

ভারতের উত্তপ্ত জাতীয় নির্বাচনী প্রচারের মধ্যেই রিপোর্টটি প্রকাশ করা হলো। এবারের লোকসভা নির্বাচনে হিন্দু ভোটারদের মধ্যে গত নির্বাচনের মতো মোদী জোয়ার না ওঠায় বিজেপি নেতারা প্রচারে মুসলিমবিদ্বেষী কথাবার্তা সামনে আনছে।

প্রথম দফার ভোটের পর থেকেই তারা প্রচার চালাচ্ছে, কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলগুলোর জোট ক্ষমতায় ফিরলে হিন্দুদের সম্পদ কেড়ে নিয়ে মুসলিমদের দিয়ে দেওয়া হবে। এমনকি বিরোধীরা ক্ষমতায় গেলে মুসলমানরাই দেশ শাসন করবে বলেও ভয় দেখানো হচ্ছে।

ঠিক এমন এক সময়ে এসে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করায় এর বিরুদ্ধে সমালোচনা হচ্ছে। কারণ বিজেপির বিভিন্ন অংশ প্রতিবেদনটির এই বক্তব্যকে আরও ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রচার করছে। জনসংখ্যার দিক দিয়ে হিন্দুদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হুমকিতে রয়েছে- হিন্দুত্ববাদীদের এই পুরনো বয়ানের সত্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য তারা প্রতিবেদনটিকে প্রমাণ হিসাবে ব্যবহার করছে।

কার্যপত্রটিতে আসলে কী দাবি করা হয়েছে এবং বাস্তবতা কী বলে? ভারতের মুসলিম জনসংখ্যা কি সত্যিই হিন্দুসহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের তুলনায় দ্রুতগতিতে বাড়ছে? আর কেনইবা প্রতিবেদনটি সমালোচনার মুখে? আসুন খুঁজে দেখা যাক।

কার্যপত্রটিতে কী বলা হয়েছে

প্রতিবেদনটিতে ১৯৫০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যাগত প্রবণতা দেখানো হয়। এটি বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় তথ্যের একটি বিনামূল্যের অনলাইন ডাটাবেজ অ্যাসোসিয়েশন অফ রিলিজিয়ন ডেটা আর্কাইভ (এআরডিএ) এর পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে।

এতে উপসংহার টানা হয়, ১৯৫০-২০১৫ সাল সময়কালে ভারতে মুসলিম জনসংখ্যার অংশ ৪৩.১৫ শতাংশ বেড়েছে এবং মোট জনসংখ্যার ৯.৮৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৪.০৯ শতাংশে পৌঁছেছে। বিপরীতে, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনসংখ্যার অংশ ৭.৮২ শতাংশ কমে মোট জনসংখ্যার ৮৪.৬৮ শতাংশ থেকে ৭৮.০৬ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থাৎ, ১৯৫০ সালে যেখানে ভারতের মোট জনসংখ্যার ৮৪.৬৮ শতাংশ ছিল হিন্দু, সেখানে ২০১৫ সালে তারা ৭৮.০৬ শতাংশে নেমে আসে।

প্রতিবেদনে আরও দেখানো হয় যে, ওই সময়ের মধ্যে ভারতে খ্রিস্টানদের জনসংখ্যার অংশও ৫.৩৮ শতাংশ বেড়ে মোট জনসংখ্যার ২.২৪ শতাংশ থেকে ২.৩৬ শতাংশে উন্নীত হয়। শিখদের জনসংখ্যার অংশও ৬.৫৮ শতাংশ বেড়ে মোট জনসংখ্যার ১.৭৪ শতাংশ থেকে ১.৮৫ শতাংশে দাঁড়ায়। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে, ভারতের বৌদ্ধ জনসংখ্যার অংশও বেড়ে মোট জনসংখ্যার ০.০৫ শতাংশ থেকে ০.৮১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।

এতে উপসংহারে টানা হয় যে, গবেষণা চালানো ১৬৭টি দেশের সবকটিতেই সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় বিশ্বাসের জনসংখ্যার অংশ হ্রাস পেয়েছে। দেশগুলোর মধ্যে ভারতের কয়েকটি প্রতিবেশী দেশও রয়েছে, যেমন, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান এবং বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রীলঙ্কা ও ভুটান।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ভারতে একাধিক ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর জনসংখ্যা বৃদ্ধি ছিল ‘তাদের কল্যাণে নেওয়া দেশটির সরকারের ক্রমবর্ধমান বিভিন্ন পদক্ষেপের’ প্রতিফলন।

কার্যপত্রে দাবি করা হয়, এই তথ্য থেকে প্রমাণিত হয় যে, ভারতে ‘সংখ্যালঘুরা শুধু সুরক্ষিতই নয় বরং সমৃদ্ধিও লাভ করছে। যদিও একাধিক আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন ও র‌্যাঙ্কিং দেশটির ধর্মীয় স্বাধীনতার পতনের বিষয়ে সতর্ক করেছে।

তবে কার্যপত্রটি যে সময়ে প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে এর উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক বলেই মনে করেন অনেক অর্থনীতিবিদ।

যুক্তরাজ্যের বাথ ইউনিভার্সিটির উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ এবং ভিজিটিং প্রফেসর সন্তোষ মেহরোত্রা আল জাজিরাকে বলেন, “কার্যপত্রটি বিজেপি সরকারের প্রচারণার সহায়ক হিসেবে কাজ করছে, কোনও গবেষণা তুলে ধরার জন্য নয়।”

প্রতিবেদনটির বিরুদ্ধে সমালোচনার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আল জাজিরা এর দুই সহ-লেখক এবং একাধিক বিজেপি মুখপাত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল, কিন্তু তারা হয় কোনও প্রতিক্রিয়া জানাননি বা মন্তব্য করতে রাজি হননি।

সংখ্যাগুলো কতটা বাস্তব

প্রতিবেদনটি একটি ছোট সমীক্ষার তথ্যের ভিত্তিতে বানানো হয়েছে, ভারতের দশকীয় জাতীয় আদমশুমারির ভিত্তিতে নয়, যা সর্বশেষ ২০১১ সালে পরিচালিত হয়। কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে ২০২১ সালের আদমশুমারি স্থগিত করা হয়, কিন্তু মোদি সরকার তা সম্পন্ন করার জন্য এখনও কোনও সময়সূচি ঘোষণা করেনি।

জনসংখ্যাবিদরা সাধারণত আদমশুমারির তথ্যকে বেশি শক্তিশালী বলে মনে করেন। কারণ অল্প সংখ্যক মানুষের ওপর চালানো সমীক্ষার ফলাফলে পুরো দেশের বাস্তব চিত্র নাও উঠে আসতে পারে।

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির জনসংখ্যাবিদ এবং মেরি স্কলোডোস্কা-কিউরি ফেলো আশিস গুপ্তা বলেছেন, “আদমশুমারির কোনও বিকল্প নেই এবং এই অনুপস্থিত ডেটা ছাড়া কোনও নীতিও তৈরি করা যাবে না। এটি বর্তমানে তহবিল বরাদ্দ থেকে শুরু করে নীতি গঠনের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। কিন্তু এতে ভারতে গত ১৪ বছরের কোনও পরিবর্তন হিসাবে ধরা হয়নি।”

সমালোচকরা বলছেন, কার্যপত্রটিতে ওই সময়ের মধ্যে হিন্দু জনসংখ্যার প্রকৃত বৃদ্ধিকে উপেক্ষা করা হয়েছে এবং মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে ভুলভাবে তুলনা করা হয়েছে। ১৯৫১ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে মুসলিম জনসংখ্যা ৩ কোটি ৫৪ লাখ থেকে বেড়ে ১৭ কোটি ২০ লাখে উন্নীত হয়। একই সময়ে হিন্দু জনসংখ্যা ৩০ কোটি ৩০ লাখ থেকে ৯৬ কোটি ৬০ লাখে উন্নীত হয়। তার মানে মুসলিমদের তুলনায় হিন্দু জনসংখ্যা পাঁচ গুণ বেশি বেড়েছে।

গুপ্তা বলেন, এসব সমস্যা কার্যপত্রটির বিশ্বাসযোগ্যতা কমায়। তিনি বলেন, “কার্যপত্রটিতে তিলকে তাল বানানো হয়েছে। এটি প্রচারণা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তৈরি করা হয়েছে এবং একে পাণ্ডিত্যের প্রকাশ হিসেবে দেখা উচিৎ হবে না।”

মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির গুজব

ভারতের মুসলমানরা ‘জনসংখ্যা জিহাদ’ করছে বলে হিন্দুত্ববাদীরা দীর্ঘদিন ধরেই একটি ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচার করে আসছে। এই তত্ত্ব মতে, ভারতীয় মুসলমানরা জনসংখ্যায় হিন্দুদেরকে ছাড়িয়ে যাওয়ার জন্য বেশি বেশি সন্তান জন্ম দেয়।

অথচ বাস্তবে সরকারের নিজস্ব তথ্য মতেই, ভারতের সকল প্রধান ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে মুসলিমদের উর্বরতার হার সবচেয়ে দ্রুত কমেছে। যেখানে ১৯৯২ সালে মুসলিম নারীরা গড়ে ৪.৪১টি করে সন্তান জন্ম দিত, সেখানে ২০২১ সালে তা ২.৩৬টিতে নেমে এসেছে। অন্যদিকে, হিন্দু নারীদের গড় সন্তান জন্মদানের হার ৩.৩০টি থেকে ১.৯৪টিতে নেমে এসেছে।

গুপ্তা বলেন, প্রতিবেদনটিতে মুসলিমদের জন্মহার কমে যাওয়ার এই বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।

কার্যপত্রটির সমালোচকরা বলছেন, এটি একটি বিকৃত রাজনৈতিক বয়ানকে বিশ্বাসযোগ্যতা দেয়।

মেহরোত্রা বলেন, রাজনীতিবিদরা যখন মুসলিমবিদ্বেষী ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলো প্রচার করেন, তখন সেটাকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু ইএসি থেকে প্রকাশিত একটি কার্যপত্র বেশ বিশ্বাসযোগ্যতা বহন করে।

তিনি বলেন, “মোদী সরকার তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য রাষ্ট্রের সম্পদের অপব্যবহার করছে। গত ১০০ বছর ধরে হিন্দুত্ববাদীরা মুসলিম জনসংখ্যা সম্পর্কে মিথ্যা ভয় দেখিয়ে আসছে। আর এই কার্যপত্রটি সেই প্রচারণাতেই ইন্ধন যোগালো।”

রিপোর্টটি কেন গুরুত্বপূর্ণ

দফায় দফায় লোকসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণের পাশাপাশি মোদী ভারতের ২০ কোটি মুসলমানের বিরুদ্ধে তার বিদ্বেষমূলক বক্তৃতাও দ্বিগুণ করেছেন। তিনি তাদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলে অভিহিত করেছেন এবং ‘বেশি বেশি সন্তান উৎপাদনকারী’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। যদিও পরে এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব মন্তব্য করার কথা অস্বীকার করেছেন।

নতুন সরকারি প্রতিবেদনটির মাধ্যমে ‘ভারতে হিন্দুদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হুমকির মধ্যে রয়েছে’ বিজেপির এই ভিত্তিহীন প্রচারণায় নতুন করে ইন্ধন যোগানো হয়েছে।

বিজেপির জাতীয় তথ্য বিভাগের দায়িত্বে থাকা অমিত মালভিয়া এক্সে এক পোস্টে প্রতিবেদনটির বরাত দিয়ে বলেছেন, দেশকে যদি বিরোধী কংগ্রেস দলের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে ‘হিন্দুদের জন্য আর কোনও দেশ থাকবে না’।

মোদীর মন্ত্রিসভার আরেক মন্ত্রী, অভিনেত্রী স্মৃতি ইরানি বলেছেন, প্রতিবেদনটি ‘হিন্দুদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার প্রমাণ’ এবং কংগ্রেসের উত্তরাধিকার ‘হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি নির্যাতন ও অসম্মান’।

গুপ্তা বলেন, ইএসির কার্যপত্রটি ‘ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোকে অমানবিকীকরণের জন্য ব্যবহৃত ভয়গুলোতে ইন্ধন যোগাচ্ছে। এটি অনেকটা কৌশলগত অনুশীলন- এটি প্রচারের জন্য করা হচ্ছে।”

ভারতীয় মিডিয়ার কিছু অংশও প্রতিবেদনটির উপসংহারগুলোকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রচার করছে। স্বাধীন থিঙ্ক ট্যাঙ্ক পপুলেশন ফাউন্ডেশন অফ ইন্ডিয়া উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, কিছু গণমাধ্যম মুসলিমদের জনসংখ্যা বাড়ার বিষয়ে অহেতুক ভীতি ছড়াচ্ছে। থিঙ্ক ট্যাঙ্কটি তাদের ব্যাখ্যাগুলোকে শুধু ভুল নয় বরং বিভ্রান্তিকর ও ভিত্তিহীন বলেও আখ্যায়িত করেছে।

তথ্যসূত্র : আল জাজিরা

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত