প্রায় ছয় মাস আগে ঢাকায় ব্যাটারি রিকশা বন্ধ করতে গিয়ে বিক্ষোভের মুখে পিছু হটেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। এবার সেই কাজ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে করতে হবে আদালতের নির্দেশে।
বিচারপতি ফাতেমা নজীব ও বিচারপতি মাহমুদুর রাজীর হাই কোর্ট বেঞ্চ মঙ্গলবার এক আদেশে ঢাকা মহানগর এলাকা ব্যাটারি রিকশা চলাচল তিন দিনের মধ্যে বন্ধ করতে বলেছে।
স্বরাষ্ট্র সচিব, স্থানীয় সরকার সচিব, পুলিশ মহাপরিদর্শক, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্টদের এ আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে।
একইসঙ্গে ব্যাটারি রিকশা চলাচল বন্ধে কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা কেন বেআইনি হবে না, সেই রুলও দিয়েছে আদালত।
প্যাডেল রিকশাচালক মালিকদের এই রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন দুই আইনজীবী এইচ এম সানজিদ সিদ্দিকী ও তাহসিনা তাসনিম মৃদু।
ঢাকায় আগে শুধু প্যাডেল রিকশা চললেও কয়েক বছর ধরে ব্যাটারি রিকশা বেড়েছে। অনিবন্ধিত ব্যাটারি রিকশা নিয়ে তাই ক্ষোভ রয়েছে প্যাডেল রিকশার চালকদের। তারা বলছে, এতে তাদের আয় কমে গেছে।
বৃহত্তর ঢাকা সিটি করপোরেশন প্যাডেলচালিত রিকশা মালিকদের তিনটি সংগঠনের ঐক্য জোটের সভাপতি জহুরুল ইসলাম মাসুম ও সাধারণ সম্পাদক মো. মমিন আলী সম্প্রতি ব্যাটারি রিকশা বন্ধে রিট আবেদনটি করেন।
তারা বলছেন, বর্তমানে ঢাকায় প্রায় ১২ লাখ রিকশা চলাচল করছে, যার বড় একটি অংশ ব্যাটারির। পুরনো প্যাডেলচালিত অনেক রিকশায় ব্যাটারি লাগিয়ে যান্ত্রিক করা হচ্ছে।
আদেশের বিষয়ে ব্যারিস্টার সানজিদ বলেন, “আদেশ পাওয়ার তিন দিনের মধ্যে ঢাকা মহানগরীর সব ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আদালত নির্দেশ দিয়েছেন।”
২০২০ সালের সিটি করপোরেশনের প্রবিধানমালা ও বিদ্যমান আইনে ব্যাটারি রিকশার নিবন্ধন নেওয়ার সুযোগ নেই জানিয়ে তিনি বলেন, “সে কারণে সেগুলো সড়কে চলাচল করা অবৈধ। যেসব ব্যাটারি চালিত রিকশা চলাচল করছে, সেগুলো অবৈধভাবে চলছে।”
ঢাকা শহরে যত্রতত্রভাবে ব্যাটারি রিকশা চলাচলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ায় সেগুলোর চলাচল বন্ধের নির্দেশ গত ১৮ মে দিয়েছিল বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)।
তার আগে ১৫ মে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ আইন ২০১৭-এর অধীনে গঠিত উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম বৈঠকে তৎকালীন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ব্যাটারিচালিত কোনও গাড়ি ঢাকা নগরীতে আর চলবে না।
তারপর বিআরটিএর বিজ্ঞপ্তি জারি হলে ব্যাটারি রিকশা বন্ধে তৎপর হয় পুলিশ। চলে ধরপাকড়।
প্রতিবাদে ১৯ মে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ শুরু করে ব্যাটারি রিকশার চালকরা। সেদিন মিরপুরে দিনভর সড়ক অবরোধ করে রাখে তারা। পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ, অগ্নিসংযোগ, বাস ভাঙচুরের মতো ঘটনাও ঘটে।
এসব ঘটনায় পল্লবী, কাফরুল ও মিরপুর মডেল থানায় চারটি মামলা হয়। সেসব মামলায় আসামি করা হয় ২ হাজার ৭০০ জনকে; গ্রেপ্তার হয় ৪২ জন।
সাধারণ মানুষের পাশাপাশি রাজনীতিকরাও তখন ব্যাটারি অটোরিকশা বন্ধের সিদ্ধান্তের সমালোচনা শুরু করেন। বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ব্যাটারি রিকশার চালকদের ওপর সরকার ‘স্টিম রোলার’ চালাচ্ছে।
এরপর সরকার সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটে। ওবায়দুল কাদের জানান, নিম্ন আয়ের মানুষের কথা চিন্তা করে ঢাকা নগরীতে ব্যাটারি রিকশা চলাচলের অনুমতি দিতে বলেছেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এরপর থেকে ব্যাটারি রিকশা অবাধেই চলছে ঢাকায়। তবে ভিআইপি সড়কে এই রিকশাগুলো উঠত না। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাটারি রিকশা ভিআইপি সড়কেও উঠতে শুরু করে। এমনকি বিমানবন্দরেও তা উঠে গেল তৎপর হয় অন্তর্বর্তী সরকার।
সাড়ে ৩ মাস পর এখন ব্যাটারির রিকশাগুলোর চলাচল বন্ধ করতে আদালতের নির্দেশনা এল।
ব্যাটারি রিকশার সমস্যা কোথায়?
অনেক আগে থেকেই বলা হচ্ছে, সড়কে তিন চাকার এ ধরনের যান দুর্ঘটনার জন্য অনেকাংশে দায়ী। বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকেও দেওয়া হচ্ছে এর পরিসংখ্যান।
কিন্তু এ খাতে যেহেতু সরকারের রাজস্ব আদায়ের সুযোগ আছে এবং নিম্ন মধ্যবিত্তের যাতায়াতেও সুবিধা মেলে, তাই অনেকেই এ ধরনের যান বন্ধের বিরোধিতাও করে আসছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছে, ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলোর জন্য একটি নকশা নির্দিষ্ট করে দেওয়া প্রয়োজন। নিরাপত্তা বাড়াতে এর নকশার সংস্কার প্রয়োজন। নিরাপত্তা ত্রুটিগুলো সংশোধন করার পাশাপাশি চলাচলেও শৃঙ্খলা আনতে হবে।
ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের অটোমোবাইল টেকনোলজি বিভাগের চিফ ইনস্ট্রাক্টর ও বিভাগীয় প্রধান (দ্বিতীয় শিফট) প্রকৌশলী মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার ব্রেকিং সিস্টেমের দুর্বলতার সমাধানে বেশি জোর দেন।
তিনি গত মে মাসে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এসব অটোরিকশার মূল সমস্যা হলো এর গতি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা খুবই দুর্বল। এর গতির তুলনায় ব্রেকিং সিস্টেম কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।”
দু্ই ধরনের রিকশার তুলনা করে মোশারফ বলেন, “আমাদের দেশে প্রচলিত ব্যাটারিচালিত রিকশার নকশা অন্যান্য পায়ে টানা সাধারণ রিকশার মতোই। সমস্যা হচ্ছে সাধারণ রিকশার ডিজাইন দ্রুত গতিতে চলার উপযোগী নয়। সাধারণ রিকশায় মোটর লাগিয়ে দ্রুতগতিতে চালানো হচ্ছে বলেই দুর্ঘটনা ঘটছে অনেক সময়।
“এসব বাহন দ্রুতগতিতে চলতে গিয়ে ব্যালান্স হারিয়ে উল্টে যায় অনেক সময়; বেশি গতির কারণে বাঁক নেওয়ার সময়ও উল্টে যেতে পারে। এছাড়া জরুরি মুহূর্তে ব্রেক কষে থামতে না পারার কারণে অন্য গাড়ি বা পথচারীর সঙ্গে সংঘর্ষ হয়।”
ব্যবহৃত ব্যাটারিগুলো নিয়ে তিনি বলেন, “এসব অটোরিকশায় ব্যবহৃত ব্যাটারির জীবনকালও খুব বেশি নয়। অর্থাৎ ব্যাটারিগুলো বেশিদিন ব্যবহার করা যায় না। নষ্ট হয়ে যাওয়া সেসব ব্যাটারি কীভাবে ধ্বংস করা হয়, কেউ জানি না। এসব ব্যাটারি পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে।”
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান তখন সকাল সন্ধ্যাকে বলেছিলেন, “অটোরিকশার মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয় পায়ে টানা রিকশার বডিতে মোটর লাগানো রিকশাগুলো। সাধারণ রিকশার পেছনের চাকার সঙ্গে একটি মোটর লাগানো হয়, আর যাত্রী সিটের নিচে থাকে ব্যাটারি। রিকশার হ্যান্ডেলের সঙ্গে যুক্ত একটি সুইচ। মোটর লাগিয়ে জোরে চালানোর সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এসব রিকশায় দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা বেশি থাকে।”
ব্যাটারি রিকশাগুলোর ‘ব্রেকিং সিস্টেম’র দুর্বলতা চিহ্নিত করে তিনি বলেন, “সাইকেলে বা রিকশাতে আমরা যে ব্রেক দেখি, তা হলো ‘ইউ’ ব্রেক। এই ব্রেকে চাকার দুই পাশে দুটি ব্রেক প্যাড থাকে, যা রিমকে চাপ দিয়ে গতি নিয়ন্ত্রণ করে। এই ব্রেকের কার্যকারিতা খুবই কম, ভেজা চাকায় এই ব্রেক খুবই কম কাজ করে।”
সাইকেল কিংবা পায়ে টানা রিকশার ইউ ব্রেক ঠিক হলেও তা ব্যাটারি রিকশার জন্য প্রযোজ্য নয় বলে জানান তিনি। কিন্তু দাম তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় ব্যাটারি রিকশাতেও সেই ব্রেক ব্যবহার করা হয় বলে তা ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় বলে তার মত।
তবে শুধু দুর্ঘটনার কারণ দেখিয়ে এ রিকশা একেবারে বন্ধ করা আর সম্ভব নয় বলে মনে করেন বুয়েটের এই শিক্ষক। এর কারণও ব্যাখ্যা করেছেন তিনি।
হাদিউজ্জামান বলেন, “২০০৯-২০১০ সাল থেকে এরা (ব্যাটারি রিকশা) নিয়ন্ত্রণহীনভাবে সড়কে নেমেছে। বাড়তে বাড়তে এদের সংখ্যা এখন অনেক বেশি হয়ে গেছে। বর্তমানে সঠিক সংখ্যা কেউই বলতে পারে না। সারাদেশে কেউ বলেন ২০ লাখ, কেউবা দাবি করেন ৫০ লাখ।
“তাই এখন এর সঙ্গে বিশাল একটি জনগোষ্ঠির জীবন-জীবিকার বিষয় জড়িয়ে গেছে। হুট করে এসব রিকশা বন্ধ করলে অনেকেই পথে বসে যেতে পারেন।”
এছাড়া হুট করে এসব রিকশা বন্ধ করলে যাত্রীদের যাতায়াতের সমস্যা বাড়ার পাশাপাশি রিকশা ভাড়া বেড়ে যেতে পারে বলেও তার আশঙ্কা।
তাই ব্যাটারি রিকশা একেবারে বন্ধ না করে নিয়ন্ত্রণে জোর দিয়ে হাদিউজ্জামান বলেন, “বর্তমানে একটি অটোরিকশা তৈরি করতে এক থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। এর সঙ্গে আর ২০-২৫ হাজার টাকার বিনিয়োগ বাড়ালেই রিকশাগুলোকে নিরাপদ করা সম্ভব।
“এর ব্রেকিং সিস্টেম ও কাঠামোগত দুর্বলতার সমস্যার সমাধান করে সেগুলোকে চলাচলের অনুমতি দেওয়া উচিৎ।”
তবে এসব রিকশা মহাসড়ক বা প্রধান সড়কে চলাচলের বিরোধিতা করছেন সব বিশেষজ্ঞই।