আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রশাসনে ব্যাপক রদবদলের ধাক্কা লাগে স্বাস্থ্য খাতেও; তবে তাতেও যেন কাটছে না এ খাতের অচলাবস্থা। দেশের স্বাস্থ্য খাত নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকও (ডিজি) বারবার বদল হচ্ছে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার খুরশীদ আলম স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পান ২০২০ সালের ২৬ জুলাই। তার চাকরির নিয়মিত মেয়াদ ছিল সে বছরেরই ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। পরে ২০২৩ সালের ১০ জানুয়ারি তাকে মহাপরিচালক পদে দুই বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয় সরকার।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় খুরশীদ আলমের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে।
এরপর থেকে এখন পর্যন্ত স্বাস্থ্যের সর্বোচ্চ এই পদে বদল এসেছে তিনবার। কিন্তু কিসের ভিত্তিতে এই বদল বা কেন এই পদে এত অস্থিরতা—তা নিয়ে মুখ খুলছেন না দায়িত্বশীলদের কেউ।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্যখাত সংশ্লিষ্ট একাধিক চিকিৎসক ও চিকিৎসক নেতা বলছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যখাতের সর্বোচ্চ এই পদে আগের সরকারের আর্শীবাদপুষ্ট কাউকে মানতে নারাজ বর্তমান সরকার সমর্থিতরা। তারা মনে করছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের কাউকে দিয়ে তাদের ‘পারপাস সার্ভ’ হবে না, তাই এই পদে বসাতে হবে তাদের পছন্দের কাউকে।
সরকার পতনের পর ১১ আগস্ট থেকে স্বাস্থ্য অধিপ্তরের সামনে বিক্ষোভ শুরু হয় বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডার অ্যাসোসিয়েশনের ব্যানারে। দুদিন পর মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাশার খুরশীদ আলমের পদত্যাগসহ বিভিন্ন দাবিতে অধিদপ্তরের সামনেই শুরু হয় অবস্থান ধর্মঘট। এক পর্যায়ে সেখানে যোগ দেন অন্য কর্মচারীরাও। তাদের দাবি ছিল– আওয়ামী লীগ সমর্থক কর্মকর্তাদের সরাতে হবে বিভিন্ন পদ থেকে। সেদিন থেকেই অধিদপ্তর অচল হয়ে পড়ে, যা এখনও পুরোপুরি সচল হয়নি।
সরকার ১৭ আগস্ট মহাপরিচালক খুরশীদ আলমের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করে পরদিন অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক রোবেদ আমিনকে ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালকের দায়িত্ব দেয়। কিন্তু একদিন পরই (১৯ আগস্ট) স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুরজাহান বেগমের সামনেই তার বিরুদ্ধে স্লোগান ওঠে। উপদেষ্টার উপস্থিতিতেই কথা কাটাকাটি, ধাক্কাধাক্কি চলে। নিয়ন্ত্রণহীন পরিস্থিতির মধ্যে উপদেষ্টা কথা বলতে চাইলেও বিক্ষোভকারীরা কারও কথা শোনেননি।
বিএনপিপন্থী চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব) স্বাস্থ্য অধিদপ্তর শাখার সভাপতি ডা. ফারুক হোসেন তখন সকাল সন্ধ্যাকে বলেছিলেন, “কোনও দুর্নীতিবাজ, ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর, যারা ছাত্র আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসাসেবা ব্যাহত করেছে, তাদের অধিদপ্তরে চাই না। বর্তমান ডিজিকে পদে রেখে আমরা কাজ করতে পারব না।”
স্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে ‘নীতিভ্রষ্ট’ ব্যক্তিকে অনতিবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে বলে রোবেদ আমিনকেও চান না বলে সেসময় জানিয়েছিলেন তিনি।
তাহলে মহাপরিচালক পদে কাকে চাইছেন—এমন প্রশ্ন করা হয় ড্যাব সভাপতি ডা. হারুণ আল রশীদকে। জবাবে সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেছিলেন, “রোবেদ আমিন ছাড়া কি দেশে আর কোনও লোক নেই? লটস অব মানুষ রয়েছে, যারা ক্যাপাবল। আমরা তাকে গ্রহণ করব।”
টানা বিক্ষোভের মুখে অধ্যাপক রোবেদ আমিনকে সরিয়ে গত ১২ অক্টোবর নিয়োগ দেওয়া হয় অধ্যাপক ডা. নাজমুল হোসেনকে। আওয়ামী লীগ আমলের স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. টিটো মিঞা স্বেচ্ছা অবসর চাইলে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান অধ্যাপক নাজমুল হোসেন। সাথে তাকে স্বাস্থ্য অধিপ্তরের অতিরিক্ত দায়িত্বও দেওয়া হয়।
তবে এর এক মাস চারদিন পর বদল আসে এই পদে। অধিদপ্তরের নতুন মহাপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) হিসেবে নিয়োগ পান অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর। তিনি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের শিশু সার্জারি বিভাগের প্রধান ছিলেন। ত্রয়োদশ বিসিএসের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়া জাফর ২০১৩ সালে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান। গত ১৬ অক্টোবর তিনি স্বাস্থ্যের ডিজি হিসেবে অফিস শুরু করেছেন।
তবে জানা গেছে, নতুন মহাপরিচালক ড্যাব সভাপতির ‘সুপারিশে’ ডিজি হয়েছেন। যদিও সুপারিশের কথা অস্বীকার করে তিনি জানিয়েছেন, নতুন ডিজিকে নিয়ে তাদের ‘অবজেকশন’ নেই।
কিন্তু আপনার সুপারিশে নতুন ডিজির নিয়োগ কিনা– এই প্রশ্নে তিনি প্রথমে বলেন, “সুপারিশে হলে তো বহু আগেই এটা হতো। এত আন্দোলন হলো সরকারের মদদপুষ্টদের নিয়ে, তখন তো এটা হয়নি।
“আর জাফর তো (নতুন মহাপরিচালক) যোগ্য, এত বছরের বঞ্চিত। সে মোস্ট সিনিয়র পারসন। ভীষণ অ্যাকাডেমিশিয়ান, ওয়ান অব দ্য বেস্ট পেডিয়াট্রিক সার্জন, পেডিয়াট্রিক সার্জন সোসাইটির শীর্ষপদে রয়েছেন। তিনি রিনাউন্ড এবং অনেস্ট। তাকে নিয়ে কোনও অবজেকশন নেই।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একাধিক বিভাগীয় প্রধানরা বলেন, ডা. জাফর ২০১৩ সালে অধ্যাপক হলেও পরবর্তী পদোন্নতি অধ্যক্ষ গ্রেড-২ এবং ডিজি গ্রেড-১ থেকে বঞ্চিত। অথচ আওয়ামী লীগ সরকারে তার চেয়ে অনেক জুনিয়র ডিজি, এডিজি, মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ পেয়েছেন।
২০০০ সাল থেকে তাকে ঢাকার বাইরে রাখা হয়েছিল, ২০০৮ সালে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যোগ দেন, তিনি একইসঙ্গে শিশু সার্জারি এবং জেনারেল সার্জারি বিভাগের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী হলেও ঢাকা মেডিকেল কলেজে অধ্যাপক পদে পদায়নে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন।
ডা. হারুণ আল রশীদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, জাফরকে চিনি গত ১৫ বছর ধরে। কিন্তু স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে তার মতো অ্যাকাডেমিশিয়ানকে কোথাও পাইনি। তিনি তো এত বছর বঞ্চিত ছিলেন।”
তিনি বলেন, “বিগত বছরগুলোতে স্বাস্থ্যখাতে অরাজকতা হয়েছে, যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চিত করা হয়েছে, কেবল দলীয় নিয়োগ হয়েছে। আমরা চাই এসব বৈষম্যের অবসান হোক। যিনি এসব কাজ করবেন না, নিয়ম মাফিক সব হবে, এমন মানুষ আমরা চেয়েছি।
“আমাদের কাছে জানতে চেয়েছিল কারা হতে পারে এ পদে যোগ্য। আমরা তখন কয়েকজনের নাম সুপারিশ করেছিলাম।”
তাহলে কি আপনার সুপারিশেই তিনি ডিজি হলেন কিনা জানতে চাইলে তিনি ফের বলেন, “তালিকায় আরও কয়েকজনের নাম ছিল, সেখানে জাফরের নামও বলা হয়েছিল বোধহয়।”
নতুন মহাপরিচালকের ঘনিষ্ঠ আওয়ামী লীগ ঘরানার একজন চিকিৎসকও নাম প্রকাশ না করার শর্তে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “তিনি (আবু জাফর) অনেক সিনিয়র। অথচ তাকে কোথাও দেওয়া হয়নি, তার পরের ব্যাচের অনেকেই অনেক পদ পেয়েছে, মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ হয়েছে। কিন্তু তিনি দীর্ঘকাল তার যোগ্যতা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, সবচেয়ে বেশি সময় বঞ্চিতের তালিকায় তিনি শীর্ষেই থাকবেন।”
তার ভাষ্য, ড্যাবের আন্দোলন ছিল– আওয়ামী লীগের আশীর্বাদপুষ্ট কাউকে নেওয়া যাবে না। তাহলে ড্যাবের কোনও ‘পারপাস সার্ভ’ হবে না। যদি নতুন ডিজি ড্যাব সমর্থিত না হয়, তাহলে তারা লাভবান হবে না।
কোনও পদে যখন-তখন একজনকে বসিয়ে আরেকজনকে সরিয়ে দেওয়ার বিষয়টিকে মিউজিক্যাল চেয়ারের সঙ্গে তুলনা করেন তিনি।
ওই চিকিৎসক বলেন, “সরকার পতনের পর থেকে ডিজি চেয়ারটা মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো হয়ে গেছে, এটা সত্যি।”
তিনি বলেন, “নতুন ডিজি ড্যাব সমর্থিত হলেও তিনি খুবই ভালো অ্যাকাডেমিশিয়ান, সৎ মানুষ। তাকে দিয়ে কোনও অন্যায় করানো কঠিন হবে। তবে আসলে এটাও একেবারে শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারছি না।”
আওয়ামী লীগ সমর্থিত চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাচিপ (স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ) এর সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “২০০১ সালের পর নগ্ন দলীয়করণ শুরু হয়েছিল, তার প্রভাবই সুদূর প্রসারীভাবে দেশের সকল সেবাখাতে পড়েছে। এর ফলে কোনও প্রাতিষ্ঠানিক উৎকর্ষতার চাইতে রাজনীতির দখলদারিত্বে সবাই মনোযোগী। এর কারণেই সেবা, দক্ষতা কম্প্রোমাইজ হচ্ছে।”