প্রতিদিনই একটু একটু করে বদলাচ্ছেন রাকিব হোসেন। এদেশের তারকাহীন ফুটবলে মনে রাখার মতো গোল ও মুভ আছে এই উইঙ্গারের। তার পায়ে মাঝে মধ্যে ম্যাচের ভাগ্য বদলে যায়। কারও কারও চোখে তিনি এখন তারকাও। নিজের চেষ্টা, খেলাটির প্রতি ভালবাসা ও আত্মনিবেদনেই বসুন্ধরা কিংসের এই ফরোয়ার্ডের রং বদল। তবে রাকিব ব্রাজিলিয়ান-সঙ্গের কথাও বলছেন বিশেষভাবে।
শনিবার মোহামেডানকে ২-১ গোলে হারিয়ে বসুন্ধরা কিংস টানা পঞ্চম লিগ শিরোপা জয়ের রেকর্ড গড়েছে। এটা স্বাধীন বাংলাদেশে তো বটেই, স্বাধীনতার আগে থেকে শুরু ঢাকা লিগেও এমন নজির নেই। এই জয়ের অন্যতম কারিগর রাকিব হোসেন! কথাটা বিস্ময়কর শোনাচ্ছে!
এদেশর ঘরোয়া ফুটবলে যা কিছু ভাল সবই বিদেশীদের দখলে থাকে। কারণ প্রত্যেক দলে গোলমুখে থাকেন তারাই। বসুন্ধরা কিংসের বিদেশী ফরোয়ার্ডদের দাপটে এক দেশি ফুটবলার নিজেকে মেলে ধরেছেন আলাদাভাবে। রাকিব ৯ গোল করে লিগের চতুর্থ সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছেন। লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতা সতীর্থ ব্রাজিলিয়ান দরিয়েলতনের চেয়ে ৪টি কম আর আরেক ব্রাজিলিয়ান তারকা রবসন রবিনহোর চেয়ে ২টি বেশি। সুতরাং তার পারফরম্যান্সকে লঘু করার সুযোগ নেই।
কিভাবে এটা সম্ভব? যে দল রবসন-দোরিয়েলতন-মিগেলের মতো ভয়ঙ্কর ব্রাজিলিয়ান ত্রয়ীর ওপর ভর করে সেখানে এক দেশি ফুটবলারের বিস্ফোরণ ঘটার সুযোগই থাকে না। রাকিবও আসলে ভাবেননি, “ব্রাজিলিয়ান ফরোয়ার্ডলাইনের সঙ্গে খেলে এত গোল করতে পারবো, এটা আমিও ভাবিনি। রবসন-দোরিয়েলতনের সামর্থ্য অনেক বেশি। তাদের সঙ্গে খেলে আমারও যে উন্নতি হয়েছে সেটা আমি বুঝতে পারছি। ভাল ফুটবলারদের সঙ্গে খেললে উন্নতি করার সুযোগ থাকে অনেক।”
ভাল বিদেশীর সঙ্গে খেললে দেশি খেলোয়াড়দের উন্নতি হয়। তারা শিখতে পারে বিদেশীদের কাছ থেকে। কথাটা অনেকখানি টেক্সটবুকের কথার মত শোনাতো এতদিন। কারণ এর নজির খুব একটা নেই ঢাকার ফুটবলে। বলা হয়, ১৯৯২ সালে আবাহনীর রুশ ফুটবলার সের্গেই জুকভের সঙ্গে খেলেই জাকির দুর্দান্ত মিডফিল্ডার হয়ে উঠেছিলেন। অনেকদিন বাদে রাকিবের মুখে শোনা গেল ব্রাজিলিয়ান সঙ্গের গল্প,“আমাদের তিন ব্রাজিলিয়ান সবসময় আমাকে উৎসাহ দেয়।
গোলে শট করতে বলে। মুভে কখন বল পায়ে রাখতে হয় এবং কখন কোথায় ছাড়তে হয়, এ ব্যাপারগুলো নিয়ে তারা টিপস দেয়। ওদের সঙ্গে তাল মেলাতে গেলে এগুলো খুব দরকার। তাদের সঙ্গে খেলে আমি প্রতি ম্যাচেই শিখছি। বড় ব্যাপার হলো, আমার পায়ে বল দিয়ে তারা ভরসা করতে পারে। নইলে এমন বিদেশীদের ভিড়ে আমি ৯ গোল করতে পারতাম না।”
আসলে ভাল ফুটবলারের সান্নিধ্যের উপযোগিতা সবসময় থাকে। কেউ তাদের কাছ থেকে নিতে জানে, কেউ জানে না। রাকিব এই সুযোগটা ভালভাবে নিয়েছেন এবং নিজেকে আরো শাণিত করেছেন। এই ফরোয়ার্ডের বেলায় আসলে সৎসঙ্গে স্বর্গবাস হয়েছে। এটা বসুন্ধরা কিংসের এই উইঙ্গারও বুঝতে পারেন, “আমি নিজে উপলব্ধি করি, এখন আগের চেয়ে আত্মবিশ্বাসী। আমার খেলা আগের চেয়ে ভাল হয়েছে। যে কোন খেলোয়াড়ের জন্য এটা খুব জরুরি।”
গত বছর থেকেই রাকিবের খেলায় শুরু হয়েছে নতুন ম্যাজিক। জুনে ভারতে অনুষ্ঠিত সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে তার পারফরম্যান্স ছিল দেখার মতো। ভুটানের বিপক্ষে প্রায় শূন্য ডিগ্রি থেকে দুর্দান্ত এক গোলের পাশাপাশি মালদ্বীপের বিপক্ষে বাংলাদেশের জয়েও আছে তার একটি গোল। সুবাদে ১৪ বছর পর সাফের সেমিফাইনালে ওঠে বাংলাদেশ। সেখান থেকে নিজেকে আলাদা করে চেনানো শুরু রাকিব বলছেন,“আমার ছোট ক্যারিয়ারে সবচেয়ে এগিয়ে রাখবো সাফে ভুটান ও মালদ্বীপের বিপক্ষে বাংলাদেশের ম্যাচ দুটোকে। দুই ম্যাচেই আমি ভাল গোল করেছি। এই দুটো ম্যাচের সঙ্গে অন্য কোনও ম্যাচের তুলনা হয় না।”
এরপর সেই ম্যাজিকটা জারি রেখেছেন ঘরোয়া ফুটবলেও। তাই বসুন্ধরা কিংস প্রেসিডেন্ট ইমরুল হাসান তার কথা বলেন আলাদা করে, “রাকিব অনেক উন্নতি করেছে। বোঝা যায়, খেলার প্রতি তার প্যাশন আছে, বড় খেলোয়াড় হওয়ার চেষ্টা আছে।” তেমনি ২৫ বছর বয়সী এই ফুটবলারও বিশেষ ধন্যবাদ দেন তার ক্লাবকে, “আমার ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের জন্য আমাদের ক্লাবকেও কৃতিত্ব দিতে হবে। ক্লাবের পেশাদারিত্ব, ইতিবাচক পরিবেশ, খেলোয়াড়দের ভাল খেলার সুযোগ তৈরি করে দেয়। কিংসে একজন ফুটবলারকে যেভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করে সেটা আর কোনও ক্লাব করে কিনা জানি না।”
খেলোয়াড় ও ক্লাব, একে অন্যের পরিপূরক। ক্লাবেই জন্ম হয় বড় খেলোয়াড়ের। পাশে ভাল বিদেশী থাকলে বড় হওয়ার সুযোগটা আরো বেড়ে যায় বৈকি।