জেলা প্রশাসক নিয়োগে জনপ্রশাসন সচিব মোখলেস উর রহমানের বিরুদ্ধে ওঠা আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ নিয়ে দিনভর সরব মূলধারার গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার কী ব্যবস্থা নেয় বা সরকারের অবস্থান কী, তা জানতেও আগ্রহের কমতি নেই।
এমন বাস্তবতায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলো, ঘটনা খতিয়ে দেখতে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হবে। সেই কমিটির প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করেই নেওয়া হবে পরবর্তী পদক্ষেপ।
বৃহস্পতিবার ঢাকার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কমিটি গঠনের কথা জানান প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন উপপ্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার ও অপূর্ব জাহাঙ্গীর।
যে প্রতিবেদন থেকে এই আর্থিক অনিয়মের অভিযোগের উৎপত্তি সেটি প্রকাশ করেছে দৈনিক কালবেলা। পত্রিকাটির প্রিন্ট ও অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়, তিন কোটি টাকার ক্যাশ চেক দিয়ে ডিসি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
কালবেলার পত্রিকা সংস্করণের খবররে শিরোনাম ছিল, ‘আমার 5c হলেই চলবে, স্যার 10c রাখব’। একই সংবাদ অনলাইন সংস্করণে শিরোনাম দেওয়া হয়েছে, ‘ডিসি নিয়োগ কেলেঙ্কারি : আমার টাকা-পয়সার প্রতি লোভ নেই, ৫ কোটি হলেই চলবে’।
পদায়নের রিপোর্টের পর অভিযোগ নিয়ে আরও একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে গণমাধ্যমটি।
যদিও এই অভিযোগ অসত্য ও ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান। অবসর থেকে সম্প্রতি যাকে ফিরিয়ে এনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয় সরকার।
সিনিয়র এই সচিবের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেন, “একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি হবে। সেখানে কিছু জ্যেষ্ঠ সাংবাদিককেও অন্তর্ভুক্ত করতে চাচ্ছি। এই রিপোর্টটা ঠিক ছিল কিনা, রিপোর্টে যে অভিযোগ এসেছে সেগুলো ঠিক কিনা তা খতিয়ে দেখা হবে। কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
কালবেলার প্রতিবেদনটির সত্যতা যাচাই করা হচ্ছে জানিয়ে শফিকুল আলম বলেন, “পত্রিকগুলো যেভাবে রিপোর্ট করছে সেই রিপোর্টের আলোকে আমরা বলতে পারি, আমরা সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে বিশ্বাস করি। ঠিক একইভাবে এ মুহূর্তে আমরা আশা করব যে পত্রিকগুলো যেন তাদের সংবাদ পরিবেশনায় কোনও ধরনের ডিসইনফরমেশন না ছড়ায়।”
৮ আগস্টের আগে দেশের সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় এমন সুবর্ণ সময় আর আসেনি বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করতে প্রধান উপদেষ্টার আহ্বানের প্রসঙ্গ টেনে প্রেস সচিব বলেন, তবে সমালোচনা করতে গিয়ে যেন ভুল বা মিথ্যা তথ্য ছড়ানো না হয়, সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।
ডিসি নিয়োগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অস্থিরতা চলছে কিনা, সে সম্পর্কে জানতে চান সাংবাদিকরা।
সেখানে কোনও অস্থিরতা দেখছেন না জানিয়ে শফিকুল আলম বলেন, “১৫ বছর ধরে একটা স্বৈরাচার ছিল। তাদের অনেকে সহযোগী ছিল। এ সরকার চাইবে না তারা আবারও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পজিশনে থাকুক। এটাকে সামনে রেখে আমরা দেখছি কাকে কোথায়…তারপরও কিছু মিসটেক হয় না তা তো নয়।
“পুরো প্রশাসনে হাজার হাজার আমলা আছে। এখন একটা-দুইটা বদলি-প্রমোশন দেখে যদি আপনি মনে করেন প্রশাসন অস্থিরতা চলছে, এটা ঠিক না।”
সংবাদ সম্মেলনে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকের সিদ্ধান্ত সম্পর্কেও জানান প্রেস সচিব।
বৈঠকে চারটি খসড়া নীতির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সেগুলো হলো, পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪ এর খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন; মালদ্বীপের কারাগারে আটক সাজাপ্রাপ্ত বাংলাদেশি বন্দিদের ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে বন্দি বিনিময় শীর্ষক চুক্তির খসড়া অনুমোদন; বাংলাদেশ ও কাতার সরকারের মধ্যে সই করা বন্দি বিনিময় শীর্ষক চুক্তি অনুসমর্থনের প্রস্তাব অনুমোদন এবং রপ্তানি নীতি ২০২৪-২৭ এর খসড়ার অনুমোদন, যেখানে বছরে ১১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
মালদ্বীপের সাজা খাটা যাবে বাংলাদেশে
মালদ্বীপ এবং কাতারের সঙ্গে বন্দি বিনিয়ম চুক্তি হয়েছে জানিয়ে শফিকুল আলম বলেন, “বাংলাদেশি ভাই-বোন যারা কাতার বা মালদ্বীপে সাজাপ্রাপ্ত তাদেরকে আমর ফিরিয়ে আনতে পারব। বাকি সাজার মেয়াদ তারা বাংলাদেশের মাটিতে সম্পূর্ণ করতে পারবেন।”
বর্তমানে মালদ্বীপে ৮০ জন সাজাপ্রাপ্ত বাংলাদেশি রয়েছে বলেও জানান তিনি।
বিভিন্ন পোশাক কারখানায় অস্থিরতার প্রসঙ্গে প্রেস সচিব জানান, বিষয়টি নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হয়েছে। এ সমস্যার সমাধান করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। শিগগিরই এ সংক্রান্ত ইতিবাচক পদক্ষেপ দেখা যাবে বলেও জানান তিনি।
এছাড়া সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত ছয়টি কমিশনের পাঁচটি পূর্ণাঙ্গ হয়েছে জানিয়ে তিনি শফিকুল আলম বলেন, শিগগিরই পূর্ণাঙ্গ কমিশনের নাম ঘোষণা করা হবে। দু-একদিনের মধ্যে ষষ্ঠ কমিশনও পূর্ণাঙ্গ হয়ে যাবে।
প্রথম সংলাপ বিএনপির সঙ্গে
বিএনপির সঙ্গে সংলাপের মধ্য দিয়ে শনিবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক শুরু হবে বলে জানান প্রেস সচিব।
দুপুর আড়াইটা থেকে একটানা বৈঠক চলবে বলেও জানান তিনি। সংলাপে বাংলাদেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো অংশ নেবে। তবে কতদিন সংলাপ চলবে সে বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
অবসরে ২ হাইকমিশনার, ৪ রাষ্ট্রদূত
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত দুই হাইকমিশনার ও চার রাষ্ট্রদূতকে বাংলাদেশে ডাকা হয়েছে জানিয়ে উপপ্রেস সচিব আজাদ মজুমদার বলেন, “মূলত তাদের অবসর প্রক্রিয়াধীন। ডিসেম্বর মাসে তারা অবসরে যাবেন। অবসরের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে তাদের ডাকা হয়েছে। এর মধ্যে দুজন হাইকমিশনার নয়াদিল্লী ও যুক্তরাজ্য থেকে ফিরবেন। এর বাইরে চার রাষ্ট্রদূতকে ব্রাসেলস, পর্তুগাল, ক্যানবেরা ও জাতিসংঘের স্থায়ী মিশন থেকে বাংলাদেশে ফিরতে বলেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।”
এসময় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনিযুক্ত উপাচার্য শুচিতা শারমিনের নিয়োগ প্রসঙ্গে প্রশ্ন তোলেন এক সংবাদিক।
তিনি বলেন, শুচিতা শারমিন আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী ছিলেন। তাহলে এখন তিনি কোন প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পেলেন?
জবাবে শফিকুল আলম বলেন, “এটা নিয়ে আপনারা লেখেন। আপনারা লিখলে যথাযথ কর্তৃপক্ষ দৃষ্টিপাত করবে। একটা দুইটা বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে সামনে এনে সাধারণীকরণ করবেন না।”