Beta
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪

ইলিশে কড়াই গরমের আগেই ফেইসবুক গরম

ইলিশ
সব বাঙালির রসনায়ই কাঙ্ক্ষিত ইলিশ মাছ।
[publishpress_authors_box]

রপ্তানির অনুমতি সবে মিলেছে, তবে পশ্চিমবঙ্গের হেঁশেলে বাংলাদেশের ইলিশ পৌঁছনোর আগেই তা নিয়ে সরগরম হয়ে উঠেছে সোশাল মিডিয়া।

সিদ্ধান্ত বদলে ভারতের ইলিশ রপ্তানি কেন করছে সরকার? এই প্রশ্ন তোলার সঙ্গে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের পুরনো একটি ফেইসবুক পোস্টও ছড়িয়ে পড়েছে ওয়ালে ওয়ালে।

আওয়ামী লীগ সরকার আমলে ২০১৯ সালে ইলিশ রপ্তানির সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় লিখেছিলেন- “৫০০ মেট্রিক টন ইলিশ! বিপুল পরিমাণ ইলিশ ভারতে রপ্তানি করে তাদের কেন খুশি করা হচ্ছে?”

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন নিয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আকতারকে প্রশ্নের মুখে পড়তে হলো। ব্যাখ্যা দিতে হলো বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদকেও।

বাংলাদেশের ভৌগলিক নির্দেশক বা জিআই পণ্য যে কূটনীতিরও অংশ, তা ১১ দিন আগে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির একটি প্রতিবেদনেও উঠে আসে।

আবার দেশের বাজারে ইলিশের আকাশছোঁয়া দাম নিয়েও সোশাল মিডিয়ায় চলছে আলোচনা। সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী সরকারকে নোটিসও পাঠিয়েছেন রপ্তানির সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা দিতে। সব মিলিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ছড়ার ‘নাচছে ইলিশ মাছ’ এর মতো অবস্থা।

সাগরের মাছ ইলিশ প্রজনন মৌসুম হলে ডিম ছাড়তে নদীতে আসে; তখনই সেই ইলিশ ধরা পড়ে জেলেদের জালে। বাঙালির রসনায় সুস্বাদু ইলিশ তখন ওঠে পাতে।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে গত কয়েক বছর ধরে দুর্গাপূজার সময় ভারতে ইলিশ রপ্তানি হয়ে আসছিল। শুধু তাই নয়, শেখ হাসিনা ইলিশ উপহারও পাঠাতেন ভারতের কেন্দ্রীয় ও রাজ্যের বিভিন্ন নেতাকে।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে, তাদের সঙ্গে নয়া দিল্লির সম্পর্ক এখনও উষ্ণ নয়।

তার মধ্যে মৎস্য উপদেষ্টা ফরিদা জানান, এবার দুর্গাপূজায় ভারতে ইলিশ রপ্তানি হবে না।

তার ঘোষণার পর রাহমান নাসির উদ্দিন নামে একজন ফেইসবুকে লেখেন- “আমি উপদেষ্টা ফরিদা আকতারের সাথে একমত। দেশের মানুষকে না-খাইয়ে ইলিশ বিদেশে পাঠানো যাবে না। হিসাব সোজা। ইলিশ আগে দেশের মানুষ খাবে; তারপর ব্যবসা ও বন্ধুত্ব।”

বিপরীতে মাহবুব কবির সজল নামে আরেকজনের পোস্ট আসে- “ভারত থেকে এত পণ্য আমদানি করি। কিছু ইলিশ রপ্তানি করলে সমস্যা কোথায়? বরং এই সুযোগে যারা দাম বাড়াচ্ছে তাদের ঠেকান।”

পক্ষে-বিপক্ষে এমন আলোচনা চলার মধ্যেই গত শনিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে ভারতে ৩ হাজার টন ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন দেয়।

তা নিয়ে আবার ফেইসবুকে সরবতার মধ্যে ইমরান হোসেন নামে একজন লিখেছেন- “ইলিশ একটি পলিটিক্যাল মাছ। এটা নিয়ে আর পোষ্ট দেওয়া যাবে না।”

ইলিশ কূটনীতি নিয়ে বিবিসিও প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল।

প্রশ্নের মুখে দুই উপদেষ্টা

প্রজনন মৌসুমে ইলিশ শিকার বন্ধ রাখা নিয়ে রবিবার সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এলে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে পড়েন উপদেষ্টা ফরিদা।

সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “বিশেষ অনুরোধের প্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভারতে ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে। এটা তাদের সিদ্ধান্ত।”

“আমার বক্তব্যের বিষয়ে আমি আগের অবস্থানেই আছি,” বলেন তিনি।

তাছাড়া উৎপাদনের তুলনায় সামান্য পরিমাণে ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দেওয়ার কথাও বলেন ফরিদা।

কলকাতা ও বাংলাদেশের মৎস্য ব্যবসায়ীদের বিশেষ অনুরোধে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এই রপ্তানির অনুমোদন দেয়।

তানিয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদও রবিবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে পড়েন।

তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনে বলেন, “এগুলো (রপ্তানি বন্ধ রাখা) যারা ইমোশোনাল কথাবার্তা বলে, যারা বলে বলুক।”

‘অনেক বিবেচনা করে’ এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এটার জন্য আমি অনেক বাহবাও পেয়েছি।”

প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের উদাহরণ দিতে গিয়ে সালেহউদ্দিন বলেন, “তারা পেঁয়াজ দিচ্ছে না? এসব ইমোশনাল কথাবার্তা বলে লাভ কী?”

সাবেক সংবাদকর্মী শরিফুল হাসান এনিয়ে ফেইসবুকে লিখেছেন, “আমি বলব, ইলিশ যখন দিছেন দেন। কিন্তু সম্পর্কটা উইন-উইন করেন।

“আওয়ামী লীগ কিংবা কোনও আমলে সম্পর্কটা উইন-উইন ছিল না। ট্রানজিট থেকে শুরু করে অনেক কিছু আমরা দিয়েছি, কিন্তু বিপরীতে পেয়েছি কম। এসব নিয়ে অতীতে অনেক লিখেছি, সবসময় বলেছি আমাদের বাংলাদেশের স্বার্থ দেখা উচিৎ।”

ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক লেনদেনের তথ্য ঘাঁটলে দেখা যায়, দেশটিতে পণ্য রপ্তানির তুলনায় বাংলাদেশ আমদানি করে অনেক বেশি।

সম্প্রতি ভারত থেকে আড়াই লাখ ডিম আমদানি করেছে বাংলাদেশ। তাছাড়া বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য গত কয়েক মাস ধরে নিয়মিত দেশটি থেকে কাঁচা মরিচ আমদানি করা হচ্ছে।

এদিকে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মাহমুদুল হাসান ভারতে ইলিশ রপ্তানি বন্ধ করতে সরকারকে আইনি নোটিস পাঠিয়েছেন। ২০২২ সালেও একইভাবে নোটিস পাঠিয়েছিলেন তিনি।

সচিবালয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে রবিবার ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন সংক্রান্ত জাতীয় টাস্কফোর্স কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি উপদেষ্টা ফরিদা আখতার।

ইলিশ রপ্তানির চালচিত্র

অতীতে কোনও বছরই অনুমোদনের সমপরিমাণ ইলিশ রপ্তানি হতে দেখা যায়নি। ২০১৯ সালে যখন প্রথমবার ভারতে ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন দেওয়া হয়, তখন ৫০০ টন অনুমোদনের বিপরীতে রপ্তানি হয়েছিল ৪৭৬ টন।

রবিবার সচিবালয়ে ফরিদা আখতারও সাংবাদিকদের বলেন, যে পরিমাণ ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন দেওয়া হয় সেই পরিমাণ রপ্তানি কোনও বছরই হয়নি।

দেশের বাণিজ্য নীতিমালা অনুযায়ী ইলিশ মাছ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা ছিল এক সময়। ২০১৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত জাতীয় রপ্তানি নীতিতে (২০১৫-১৮) ইলিশ মাছ শর্ত সাপেক্ষে রপ্তানিযোগ্য পণ্যের তালিকায় আনা হয়। পরের দুটো রপ্তানি নীতিতেও তা একই রকম থাকে।

দেশে প্রথম ইলিশ রপ্তানির অনুমতি দেওয়া হয় ২০১৯ সালে। ওই বছর বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে প্রতি কেজি ইলিশ ৬ ডলার (বাংলাদেশের ৫০৭ টাকা) দরে প্রথম তিন চালান পাঠানো হয়েছিল। পরে অবশ্য তা প্রতি কেজি ১০ ডলারে উন্নীত হয়।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যে দেখা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪৭৬ টন বা ৪ লাখ ৭৬ হাজার কেজি ইলিশ রপ্তানি হয়েছিল। তাতে আয় হয় সাড়ে ৩৯ লাখ ডলার।

২০২০-২১ অর্থবছরে ১ হাজার ৬৯৯ টন ইলিশ রপ্তানি করে আয় হয় ১ কোটি ৬৪ লাখ ডলার। তখন প্রতি কেজি ইলিশ মাছ আকার ভেদে ১০, ৬ ও ৮ ডলার দামে রপ্তানি হয়েছিল।

২০২১-২২ অর্থবছরে ১ হাজার ২৩০ টন ইলিশ রপ্তানি করে আয় হয় ১ কোটি ২৪ লাখ ডলার। প্রতি কেজির রপ্তানি মূল্য ছিল ১০ ডলার।

২০২২-২৩ অর্থবছরে ১ হাজার ৩৯১ টন ইলিশ রপ্তানি করে আয় হয় ১ কোটি ৩৮ লাখ ডলার।

সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ৭৯টি প্রতিষ্ঠানকে ৩ হাজার ৯৫০ টন ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন দিলেও বেনাপোল ও আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে সব মিলিয়ে রপ্তানি হয় প্রায় ৮০২ টন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের আয় হয়েছিল ৮০ লাখ ডলার।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ ইলিশ রপ্তানি হয়েছে, তা মোট আহরণের শূন্য দশমিক ২৯ শতাংশ।

ইলিশ মাছ মিলছে বাজারে, তবে দাম চড়া।

দেশের বাজারের হালচাল

মৎস্য উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেছিলেন, আগে দেশের মানুষ ইলিশ পাবে, তারপর রপ্তানির সিদ্ধান্ত।

চলতি বছর ৫ লাখ ৩০ হাজার টন ইলিশ আহরণ সম্ভব বলে মনে করছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে থেকে ৩ হাজার টন ইলিশ রপ্তানি হলে তার প্রভাব দেশের বাজারে পড়বে না বলে উপদেষ্টা ফরিদা ও সালেহউদ্দিন উভয়ই মনে করেন।

তবে বাজারে ইলিশের যে দাম এখন, তাতে মধ্যবিত্তের পক্ষেও কেনা দায়।

এক কেজি ওজনের ইলিশের দাম ১৭০০-১৮০০ টাকা। এই দাম দিয়ে পাতে ইলিশ তোলা কত জন মানুষের পক্ষে সম্ভব? সেই প্রশ্নও আসছে সোশাল মিডিয়ায়।

ঢাকার কাঁচাবাজারগুলোতে বর্তমানে ছোট আকারের (২০০ গ্রাম -২৫০ গ্রাম) ইলিশের দাম কেজিপ্রতি ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকা।

রবিবার ঢাকার নিউ মার্কেট কাঁচাবাজারে ইলিশের দরদাম করছিলেন লালমাটিয়ার বাসিন্দা আরিফুল ইসলাম। তিনি সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এক কেজি ইলিশ কেনার জন্য প্রায় দুই হাজার টাকা খরচ করতে হবে- এটা তো ভাবতেও পারছি না। আমাদের মতো স্বল্প আয়ের লোকজন এই দামে কীভাবে ইলিশ খাবে?”

ভারতে রপ্তানির কারণে দাম বেড়ে যাচ্ছে কি- বাজার বিশ্লেষণে তাও ঠিক মনে হওয়ার সুযোগ নেই।

কারণ বরাবরই দেখা যায়, বড় ইলিশই শুধু রপ্তানি হয়। অর্থাৎ এক কেজি সাইজের বেশি ওজনের ইলিশ। তাহলে এর চেয়ে ছোট সাইজের ইলিশের দাম কেন কমছে না? সেই প্রশ্নও এসে যায়।

বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদেরই দুষছেন।

আবার এই কথাও সোশাল মিডিয়ায় আসছে, দাম যতই হোক না কেন, এক শ্রেণীর ক্রেতার জন্য তা বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। অর্থাৎ ইলিশে রসনা বিলাসের সামর্থ্য সবার এখন নেই।  

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত