ওয়েস্টমিনস্টার পদ্ধতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলে কিছু নেই; কিন্তু বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরের প্রতি আস্থাহীনতার কারণে সংবিধানে যুক্ত হয়েছিল নির্বাচনকালীন এই নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা।
প্রায় তিন দশক আগে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে প্রবল আন্দোলনে এসেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা, তখন ক্ষমতায় থাকা বিএনপির ছিল ঘোর আপত্তি।
আবার এক যুগ পরে আওয়ামী লীগ যখন সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাদ দেয়, তখন আবার এর পক্ষে দাঁড়িয়ে যায় বিএনপি।
আবার সর্বোচ্চ আদালতেরে এক রায়কে ভিত্তি ধরেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাদ দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর এখন আদালতই পুনর্বহাল করল তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে গত তিন দশকজুড়েই আলোচনার বড় বিষয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত করলেও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর সাংবিধানিক শূন্যতার মধ্যে আবার সেই ধরনের একটি এখন প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ক্ষমতায়, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
এরপর একটি রিট আবেদনে হাই কোর্ট মঙ্গলবার দেওয়া রায়ে বলেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করাটা ছিল অবৈধ।
অথচ এক যুগ আগে আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়েছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অবৈধ ও অসাংবিধানিক। কারণে এটা সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থি।
যেভাবে এল
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৯০ সালের আগ পর্যন্ত যে চারটি সংসদ নির্বাচন হয়েছিল, কোনোটিই সেভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
গণআন্দোলনে এইচ এম এরশাদ সরকারের পতনের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন অস্থায়ী সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালে যে নির্বাচনটি হয়েছিল, তা সার্বিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয় সবার কাছে।
ফলে নির্দলীয় সরকার থাকলে ভোট নিরপেক্ষ হয় বলে সাধারণের মধ্যে একটি ধারণা তৈরি হয়েছিল। তবে তা প্রবল হয়ে ওঠে ১৯৯৪ সালের ২০ মার্চ মাগুরা-২ আসনে উপ-নির্বাচনের পর।
তখন বিএনপি ক্ষমতায়। আওয়ামী লীগ নেতা মো. আসাদুজ্জামানের মৃত্যুতে শূন্য ওই আসনে উপ-নির্বাচনে নিজেদের প্রার্থী কাজী সালিমুল হক কামালকে জয়ী করতে বিএনপির তৎপরতা ভোটটি প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে।
সেদিন জাল ভোট আর কেন্দ্র দখলের মহড়ার কথা সংবাদপত্রে শিরোনাম হয়ে আসে। ওই নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে আওয়ামী লীগ সারাদেশে হরতাল ডেকেছিল। দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘কষ্টার্জিত গণতন্ত্রকে বিএনপি গলা টিপে হত্যা করল’।
ওই নির্বাচন ঘিরে বিরোধী দলের অভিযোগে ভিত্তি দিয়েছিল তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি আব্দুর রউফের নির্বাচনী এলাকা থেকে আকস্মিক চলে আসা।
ভোটের আগের দিন ১৯ মার্চ সকালে মাগুরায় গিয়েছিলেন তিনি; কথা ছিল ভোট শেষ করেই তিনি আসবেন। কিন্তু পরিবেশ দেখে বিরক্ত হয়ে ভোটের আগের রাতেই তিনি ঢাকা ফিরে আসেন।
ফেরার পর বিচারপতি রউফ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, “আমি মাগুরায় নির্বাচনের দিন থাকতে গিয়েছিলাম। কিন্তু গিয়ে দেখলাম, সেখানে অনেক মন্ত্রী আছেন, বিরোধীদলীয় নেত্রী আছেন, একশর ওপর এমপি আছেন। আমি আর থাকার প্রয়োজন বোধ করিনি। তাই চলে এসেছি।”
১৯৯১ সালের নির্বাচন আয়োজনে নেতৃত্ব দেওয়া বিচারপতি রউফ সেদিন আর কোনও কথা বলেননি; শুধু বলেছিলেন, “নির্বাচন শেষ হলে কথা বলব।” পরে নিজের মেয়াদ শেষ না করেই নির্বাচন কমিশন থেকে বিদায় নিয়েছিলেন সিইসি রউফ।
ওই নির্বাচনের পর যখন ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসছিল, তখন আওয়ামী লীগ দাবি করে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে না, তাই দরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার।
আওয়ামী লীগের দাবির সঙ্গে একমত হয় জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য সব বিরোধী দল। সংসদ থেকে একযোগে পদত্যাগ করে তারা।
তখন বিএনপি এই দাবি মানতে ঘোর আপত্তি ছিল; তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এমনও বলেছিলেন, পাগল আর শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নয়।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে না হলে নির্বাচন বয়কটের ঘোষণা দেয়। রাজপথে আন্দোলন অব্যাহত রেখে তিন মাসের ২১ বার হরতাল ডাকে, অসহযোগ আন্দোলন করে টানা ৩৯ দিন।
বিএনপি ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের পথে এগোলে তা ঠেকানোর ডাক দিয়ে ১৪ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি হরতাল দেয় আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলো। তাতে সারাদেশে জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়ে। ভোটের দিন ব্যাপক সহিংসতায় ১০ জন নিহত হয়।
সেদিনই শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপতিকে আহ্বান জানিয়ে বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন দিন।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে সমঝোতায় আনতে ভোটের আগেই চলে কূটনৈতিক উদ্যোগ। তখন আওয়ামী লীগের দাবি ছিল, খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ একটি উপদেষ্টা পরিষদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। সেই উপদেষ্টা পরিষদের প্রধান উপদেষ্টার হাতে নির্বাহী ক্ষমতা থাকবে।
অন্যদিকে বিএনপি রাষ্ট্রপতির অধীনে উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করে প্রেসিডেন্টের হাতে নির্বাহী ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল।
দুই পক্ষের আলোচনার ইঙ্গিত পাওয়া যায় ২৩ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে। তিনি বলেছিলেন, ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি হবে যাতে ভবিষ্যৎ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পর বিরোধীদের আন্দোলনের মধ্যেই খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিসাবে পুনরায় শপথ নেন। তার কিছু দিনের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস সদস্য বিল রিচার্ডসন ঢাকায় আসেন। তিনি খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা দুজনের সঙ্গেই বৈঠক করেন এবং সমঝোতায় আসার তাগিদ দেন।
রিচার্ডসন চলে যাওয়ার পর বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতরা উদ্যোগ নেন মধ্যস্থতার। কয়েক দফা বৈঠকের পর ৩ মার্চ ভাষণ নিয়ে জাতির সামনে আসেন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনার জন্য তিনি প্রস্তত। তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের জন্যও সংসদে বিল আনা হবে।
এর দুদিন পরে আলোচনায় বসতে শেখ হাসিনার কাছে যায় খালেদা জিয়ার চিঠি। ১০ই মার্চ বিরোধী দলগুলো আলাদাভাবে রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের সঙ্গে আলোচনায় বসে। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন এবং মে মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানে রাজি হয় বিএনপি।
এদিকে তখনও ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন এবং সংসদ বাতিলের দাবি ছিল বিরোধী দলগুলোর। তখন বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, সংসদেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল পাস হওয়া উচিৎ।
এরপর ১৯ মার্চ ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ বসে শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাসের জন্য। অধিবেশনের চতুর্থ কার্যদিবস ২৪ মার্চ ত্রয়োদশ সংশোধন বিলটি উত্থাপন করা হয়। ২৬ মার্চ ভোররাতে পাস হয় বিলটি।
কিন্তু খালেদা জিয়ার পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনে দেরি হওয়ায় আওয়ামী লীগ আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। এক পর্যায়ে এর সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাও, গঠিত হয় ‘জনতার মঞ্চ’।
শেষে ১৯৯৬ সালের ৩০ মার্চ খালেদা জিয়া পদত্যাগ করেন, ভেঙে দেওয়া হয় ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ। প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার পায় বাংলাদেশ, সেই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে শপথ নেন সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান।
যেভাবে গেল
১৯৯৬ এর পর ২০০১ সালের নির্বাচনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হয়েছিল। এরপর ২০০৬ সালে বিএনপির বিদায়ের সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন নিয়ে দেখা দেয় জটিলতা।
আইন ছিল, সর্বশেষ প্রধান বিচারপতি হবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান। কিন্তু বিএনপি সরকার বিচারকদের অবসরের বয়স বাড়ালে বিচারপতি কে এম হাসানের সেই সরকারের প্রধান হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়। তাতে আওয়ামী লীগ আপত্তি তোলে। তারা কারণ দেখায়, কে এম হাসান এক সময় বিএনপি করতেন, তাই তাকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করতেই বিচারপতিদের বয়স বাড়ানো হয়েছে।
বিতর্ক এড়াতে কে এম হাসান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব নিতে অপরাগতা জানান। তারপর রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দীন আহম্মেদ নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হলে রাজনৈতিক সঙ্কট আরও ঘনীভূত হয়। এক পর্যায়ে ২০০৭ সালে আসে জরুরি অবস্থা; সেই অবস্থায় নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয় ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে। সেই সরকার দুই বছর পর নির্বাচন আয়োজন করলে তাতে জয়ী হয়ে ২০০৯ সালে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার আনার কারিগর আওয়ামী লীগই ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী এনে এই সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে।
আওয়ামী লীগ নেতারা তখন যুক্তি হিসাবে দেখিয়েছিল আপিল বিভাগের রায়, যে রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক বলা হয়েছিল।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যুক্ত করে সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী আনার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আইনজীবী এম সলিম উল্লাহসহ কয়েকজন বিএনপি সরকার আমলেই আদালতে গিয়েছিলেন।
কিন্তু হাইকোর্ট ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বৈধ বলে রায় দেয়। তাতে বলা হয়, “ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধানসম্মত ও বৈধ। এ সংশোধনী সংবিধানের কোনও মৌলিক কাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি।”
সেই রায়ের বিরুদ্ধে রিট আবেদনকারীরা আপিল বিভাগে গিয়েছিল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর ২০১১ সালে মার্চ মাসে আপিল বিভাগে সেই আপিলের শুনানি শুরু হয়। গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার আগে আদালত শীর্ষস্থানীয় আটজন আইনজীবী মত নেয়।
এই অ্যামিচি কিউরিদের মধ্যে টি এইচ খান, কামাল হোসেন, আমীর-উল ইসলাম, মাহমুদুল ইসলাম ও রোকনউদ্দিন মাহমুদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখার পক্ষে মত দেন। রফিক-উল হক ও এম জহিরের মত ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংস্কারের। শুধু আজমালুল হোসেন কিউসি বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
ওই বছরের ১০ মে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ রায়ে বলে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অবৈধ ও অসাংবিধানিক।
রায়ের পর তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছিলেন, “আদালত ত্রয়োদশ সংশোধনীকে সংবিধানের মূল চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক উল্লেখ করে তা বাতিল ঘোষণা করেন।”
তবে রায়ে বলা হয়েছিল, সংবিধান ত্রয়োদশ সংশোধন অসাংবিধানিক ও অবৈধ হলেও জাতীয় সংসদ তার বিবেচনা এবং সিদ্ধান্ত অনুসারে দশম ও একাদশ সাধারণ নির্বাচনকালীন সময়ে প্রয়োজনমতো নতুনভাবে ও আঙ্গিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।
সেই রায়টি সাত বিচারকের আপিল বিভাগের সর্বসম্মত রায় ছিল না। সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে হয়েছিল সেই রায়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পক্ষে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের সঙ্গে একমত পোষণ করেন বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (এস কে সিনহা) ও সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। বিচারপতি এস কে সিনহা আলাদাভাবেও অভিমত লেখেন। তিনি দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার পক্ষে মত দেন। তবে এই সরকারে বিচারপতিদের বাদ দিতে বলেন।
বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে মত দিয়েছিলেন। তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা। শুধু বিচারপতি ইমান আলী বিষয়টি সংসদের ওপর ছেড়ে দিতে মত দেন।
১৬ মাস পর ২০১২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর ৭৪৭ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করে আপিল বিভাগ। তবে পূর্ণাঙ্গ রায়ে পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার বিষয়টি আর ছিল না।
এদিকে সংক্ষিপ্ত রায়ের আগেই সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। এলক্ষ্যে সংসদীয় বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির কো-চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ২০১১ সালের ১০ মে আপিল বিভাগের রায়ের পর বলেছিলেন, তাদের কমিটি সর্বোচ্চ আদালতের এই রায়কে বিবেচনায় নেবে।
এরপর সংসদীয় কমিটির সুপারিশের আলোকে ২০১১ সালের ২৫ জুন সংবিধান সংশোধনের সেই প্রস্তাব সংসদে উত্থাপন করেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ। পাঁচ দিন পর ৩০ জুন সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী বিল সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে পাস হয়। তাতে বাতিল হয়ে যায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের বিপক্ষে অবস্থা নেওয়া বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের ৩৯ জন ও এলডিপির ১ জন সংসদ সদস্য সেদিন সংসদে যাননি। বিলের বিপক্ষে সংসদে লড়াই করে গিয়েছিলেন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ফজলুল আজিম, যিনি এক সময় বিএনপিতে ছিলেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পক্ষে আওয়ামী লীগ তখন যুক্তি দেখিয়েছিল, এটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। শফিক আহমেদ তখন বলেছিলেন, “অগণতান্ত্রিক কোনও সরকার সংবিধানে আপনি রাখতে পারবেন না। উচ্চ আদালত যেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে বাতিল করেছে, সেখানে এটা আমরা সংবিধানে রাখতে পারি না।”
যেভাবে ফিরল
আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর আন্দোলনে নামে বিএনপি, যারা ক্ষমতায় থাকার সময় এর বিরোধিতা করছিল। তত্ত্বাবধায়কের অধীনে না হওয়ায় ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপিসহ অধিকাংশ দল। ২০১৮ সালের নির্বাচনে গেলেও ভোটের পর বিএনপি নেতারা বলেন, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া সম্ভব নয়, তা আবার প্রমাণিত হলো।
অন্যদিকে এক সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলনকারী আওয়ামী লীগ এই ব্যবস্থা ফিরিয়ে না আনার অনড় অবস্থান নেয়। দলটির নেতারা এমনও বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ‘জাদুঘরে’ গেছে, তা আর ফিরিয়ে আনা যাবে না।
২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন আবার বর্জন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি পুনরায় তোলে বিএনপিসহ বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল। কিন্তু আওয়ামী লীগ তা পাত্তা না দিয়েই একতরফা নির্বাচন করে ফেলে।
কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটার পর সংবিধানে না থাকলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদলেই ড. ইউনূসের সরকার শপথ নেয়।
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল চেয়ে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, ড. তোফায়েল আহমেদ, এম হাফিজ উদ্দিন খান, জবিরুল হক ভুইয়া ও জারাহ রহমান।
তারা চারটি যুক্তি দেখান।
প্রথমত, যখন পঞ্চদশ সংশোধনী করা হয়, তখন সংবিধানে একটি অনুচ্ছেদে বলা ছিল, সংবিধানের অনেকগুলো অনুচ্ছেদের সংশোধনী করতে হলে গণভোটের দরকার হবে। কিন্তু সেই গণভোট না করে পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয়, যা অসাংবিধানিক।
দ্বিতীয়ত, পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংবিধানের আইন প্রণয়নের ক্ষমতাকে খর্ব করা হয়েছে। তার কারণ হলো সংবিধান সংশোধন করতে হলে দুই-তৃতীয়াংশ সমর্থন প্রয়োজন। কিন্তু আবার অনেকগুলো অনুচ্ছেদের বিষয়ে বলা হয়েছে, কোনও সংসদ এই অনুচ্ছেদ সংশোধন করতে পারবে না। এটা করে জনগণের সাংবিধানিক অধিকারকে খর্ব করা হয়েছে।
তৃতীয়ত, পঞ্চদশ সংশোধনী সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী। মৌলিক কাঠামের মধ্যে একটা হলো গণতন্ত্র, আরেকটি হলো নিরপেক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচন। দুটি একটি আরেকটির পরিপূরক। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এই দুটিকে খর্ব করা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে অবাধ, নিরপেক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচন থেকে মানুষকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
চতুর্থত, আপিল বিভাগ বলেছিল যে পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্ববধায়ক সরকারের অধীনে হতে হবে, কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনী করে সেই সুযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, যা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
সেই রিট আবেদনে রুল জারির পর ১১ কার্যদিবস শুনানি শেষে ১৭ ডিসেম্বর মঙ্গলবার রায় দেয় বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাই কোর্ট বেঞ্চ।
ফারাহ মাহবুব বিএনপির এক সময়ের মন্ত্রী মাহবুবুর রহমানের মেয়ে, অন্য দেবাশীষ রায়ের বাবা বিএনপির আরেক নেতা, জাতীয় পার্টির আমলের মন্ত্রী নিতাই রায় চৌধুরীর ছেলে।
তাদের দেওয়া রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংক্রান্ত ৫৮ অনুচ্ছেদ (পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ২০ ও ২১ ধারা) বাতিল করে পঞ্চদশ সংশোধনী আনা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে উল্লেখ করা হয়।
রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, “যদিও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা মূল সংবিধানে ছিল না। কিন্তু একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ সংসদ নির্বাচনের অভিপ্রায়ে ১৯৯৬ সালে তা সংবিধানে যুক্ত করা হয়। ফলে এই ব্যবস্থাটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোরই অংশে পরিণত হয়েছে।”
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্তির পর বিগত ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণের আস্থার কোনও প্রতিফলন ঘটেনি বলেও আদালতের পর্যবেক্ষলে বলা হয়।
রায়ে গণভোট ফিরিয়ে এনে বলা হয়েছে, যেহেতু সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তনে গণভোট বাধ্যতামূলক, সেহেতু সংবিধানের প্রস্তাবনায় পরিবর্তন আনাও অসাংবিধানিক হয়েছে। ফলে ১৪২ অনুচ্ছেদ হুবহু পুনস্থাপন করা হলো।
রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। কারণ আজকের রায়ের মধ্যে বলেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার সাংবিধানিকভাবেই বৈধ সরকার।”
এই রায়ের ফলে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসাবে গণ্য হবে বলে মত দেন অ্যাটর্নি জেনারেল।