কিছুদিন আগে ওমানে অনূর্ধ্ব-২১ এশিয়া কাপে পঞ্চম হয়েছে বাংলাদেশ। তাতে নিশ্চিত হয়েছে ২০২৫ সালে যুব বিশ্বকাপ খেলা। হকির যে কোনও পর্যায়ের বিশ্বকাপে এটাই প্রথম অংশগ্রহণ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের। বিশ্বকাপের পরিকল্পনা নিয়ে সকাল সন্ধ্যার রাহেনুর ইসলাম মুখোমুখি হয়েছিলেন হকি ফেডারেশনের অ্যাডহক কমিটির সাধারণ সম্পাদক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) রিয়াজুল হাসান-এর।
প্রশ্ন : সরাসরি বিশ্বকাপে জায়গা পেয়েছে বাংলাদেশের ছেলেদের যুব দল। এটা কি ঝিমিয়ে পড়া হকির টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে?
লে. কর্নেল (অব.) রিয়াজুল হাসান : বাংলাদেশ হকিতে এমন টার্নিং পয়েন্ট অতীতে এসেছে কিন্তু মুখ থুবড়ে পড়েছে। ২০১৩ সালে ওয়ার্ল্ড হকি লিগে দারুণ নৈপুণ্য দেখিয়েছিলেন জিমি, চয়নরা। সেটা কাজে লাগাতে পারেনি হকি ফেডারেশন। সেই ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নেব আমরা। অনেক দিন ধরে একটা বেসিক প্ল্যাটফর্ম পাচ্ছিলাম না, যেটা ধরে এগোতে পারব। এই ফলটা আমাদের সাহায্য করবে।
প্রশ্ন : অনূর্ধ্ব-২১ এশিয়া কাপের ক্যাম্পে খেলোয়াড়রা দৈনিক ভাতা পেয়েছেন ৪০০ টাকা করে। তারাই ওমানে পঞ্চম হয়ে অনূর্ধ্ব-২১ বিশ্বকাপের টিকিট এনে দিয়েছেন বাংলাদেশকে। এর পুরস্কার হিসেবে দলের প্রত্যেকের জন্য ২৪ হাজার টাকার মতো পুরস্কার দিয়েছেন ফেডারেশন সভাপতি। এছাড়া হকির লিগও অনিয়মিত। তাহলে তরুণরা কেন হকি খেলবে?
রিয়াজুল হাসান : দৈনিক ভাতা আর পুরস্কারের অঙ্ক নিয়ে এই মুহূর্তে কিছু বলব না। এটা ফান্ডিংয়ের ওপর নির্ভর করে। আমি শুধু একটাই কথা বলি, আমরা যদি ভালো স্পন্সর পেয়ে যাই, সবকিছুর উন্নতি করা যাবে। বিজয় দিবস হকিতে শেষ বেলায় স্পন্সর হয়ে প্যারাগন গ্রুপ দিয়েছে ৬ লাখ টাকা। এই অঙ্কে টুর্নামেন্ট করতে গেলে টানাটানি হবেই। তারপরও প্যারাগন গ্রুপের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। আমরা চেষ্টা করছি বড় অঙ্কের স্পন্সরের জন্য। হকির ক্লাবগুলোকেও চিঠি দেওয়া হবে যেন আমরা অন্তত এপ্রিলে লিগটা চালু করতে পারি। লিগ নিয়মিত করতে পারলে অবশ্যই তরুণরা আগ্রহী হবে হকিতে।
প্রশ্ন : অনূর্ধ্ব-২১ এশিয়া কাপে বাংলাদেশের ডাগআউটে ছিলেন শুধুই তিনজন- প্রধান কোচ, ম্যানেজার ও ফিজিও। অথচ আধুনিক হকিতে প্রধান কোচের একাধিক সহকারী থাকেন। ভিডিও বিশ্লেষক, ফিজিও, ট্রেইনার থাকেন। বিশ্বকাপেও কি ৩ স্টাফ নিয়ে খেলতে যাবে বাংলাদেশ?
রিয়াজুল হাসান : অবশ্যই এত কম স্টাফ নিয়ে এত বড় মঞ্চে যাওয়াটা বিব্রতকর। কথা দিচ্ছি, বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ডাগআউটে ৩ স্টাফ থাকবে না। বিশ্বকাপ সামনে রেখে আমাদের যে ক্যাম্প হবে, বদলের শুরুটা সেখান থেকেই করব। ক্যাম্পে একজন হেড কোচ থাকবেন। তার সঙ্গে দুই তিনজন অ্যাসিসটেন্ট কোচ থাকবেন। ট্রেইনার থাকবেন, ফিজিও থাকবেন। আর একজন টিম ম্যানেজার থাকবেন। তারা সবাই একসঙ্গে মিলে কাজ করবেন। একসঙ্গে বিশ্বকাপেও যাবেন।
প্রশ্ন : যুব এশিয়া কাপে ম্যানেজার হয়েও কাওসার আলী প্রতিপক্ষ দলের ভিডিও ধারণ করে করেছিলেন, তাও নিজের কেনা ক্যামেরায়। ফুটেজ সংগ্রহ করতে অন্য দেশের ভিডিও বিশ্লেষকের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। সেই ধারের ভিডিও দেখে কোচ সাজিয়েছিলেন ম্যাচের পরিকল্পনা।
রিয়াজুল হাসান : ধারের ভিডিওতে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ, এটা মেনে নিচ্ছি। তবে ছবিটা বদলাবে। কাওসার আলীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি, নিজের কাজ না হলেও দেশের জন্য এভাবে প্রতিপক্ষের খেলার ভিডিও সংগ্রহ করায়। বিশ্বকাপে ভিডিওসহ টেকনিক্যাল সাপোর্ট দেওয়ার জন্য যা যা প্রয়োজন আমরা দিব।
প্রশ্ন : বয়স বেড়ে যাবে বলে এই খেলোয়াড়দের সবাই ডিসেম্বরে ভারতে হতে যাওয়া বিশ্বকাপে অংশ নিতে পারবেন না। তাদের শূন্যস্থান পূরণে আপনাদের ভাবনা?
রিয়াজুল হাসান : এক্ষেত্রে আমরা সৌভাগ্যবান। ওমানে এশিয়া কাপে খেলা সর্বোচ্চ তিনজনকে বিশ্বকাপে পাব না। টুর্নামেন্টের আগে ক্যাম্পে ছিল ৩০ জন। সেখান থেকেই বিকল্প বেছে নেওয়া হবে। সময় যেহেতু আছে, নতুন অন্য কাউকেও পেয়ে যেতে পারি।
প্রশ্ন : কোচ মওদুদুর রহমান শুভ’র হাত ধরে এত বড় সাফল্য পেয়েছেন যুবারা। তিনি কী বিশ্বকাপ ভাবনায় আছেন?
রিয়াজুল হাসান : শুভ’র বিশ্বকাপে কোচ থাকাটা অনিশ্চিত। শুধু শুভ কেন, বিশ্বকাপ টিকিট এনে দেওয়া কোনও খেলোয়াড় থাকবে কিনা, সেটাও অনিশ্চিত। দেখেন শুভ ছিলেন চুক্তিভিত্তিক একটা টুর্নামেন্টের জন্য কোচ। উনি আসলে বিকেএসপিতে কর্মরত। অ্যাডভান্টেজটা ছিল যে, এই দলের অনেকেই বিকেএসপিতে অধ্যয়নরত, কেউ কেউ পাস করে বেরিয়েছে। তাদের সঙ্গে সব সময় কাজ করেছেন শুভ।
প্রশ্ন: বিশ্বকাপে তো প্রায় একই দল থাকবে। সেই ছেলেদের একটা দল হিসেবে তৈরি করেছেন শুভ’ই।
রিয়াজুল হাসান : আমরা ফেডারেশন থেকে শুধু ঐ টুর্নামেন্টের জন্য শুভকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম। বিশ্বকাপ তো বড় মঞ্চ। আমরা যখন বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চে যাব তখন বড় করেই ভাবতে হবে। বিদেশি কোচ নিয়ে আমরা আলোচনা করছি। বিভিন্ন জায়গায় চিঠি দিয়েছি, দেখা যাক কি হয়। আমরা যেহেতু নতুন কোচিং সিস্টেমে যাচ্ছি তাই চেষ্টা করব দেশের যারা ভালো কোচ আছেন তাদের ইন্টারভিউ নেওয়ার। তাদের গ্রেডিং আর অভিজ্ঞতা যাচাই করব। এরপর আমরা কোচের সঙ্গে চুক্তিতে যাব।
প্রশ্ন : বাংলাদেশ-জার্মানি দ্বিপাক্ষিক চুক্তির বিনিময়ে ১৯৯৫ সালে অটো ফিস্টার এসেছিলেন ফুটবলের কোচ হয়ে। তার হাত ধরে সেই বছর মিয়ানমারে চার জাতি টুর্নামেন্টের শিরোপা জিতেছিল বাংলাদেশ। যুব বিশ্বকাপের আগে এমন ক্রীড়া কূটনীতি কাজে লাগানোর ভাবনা আছে আপনাদের?
রিয়াজুল হাসান : একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, বিদেশি কোচ আনলেই সব সমস্যার সমাধান হয় না। আর ফ্রি কোচ ও বেতনভুক্ত কোচের পার্থক্য আছে। আমি এর উত্তর এখন দিতে পারব না। তবে স্বাভাবিকভাবে একটা কোচ যখন আসবে, এখানে যে সময় ব্যয় করবে, পরিবার থেকে দূরে থাকবে। তার তো কিছু পাওয়া উচিত। তারপরও ক্রীড়া কূটনীতির যে কথাটা বললেন, সেটা মাথায় থাকল আমার।
প্রশ্ন : অনূর্ধ্ব-২১ এশিয়া কাপের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে খেলার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। এ নিয়ে একে অন্যের কাঁধে দোষ চাপানোর খেলা চলেছে হকিতে। বিশ্বকাপের আগে খেলোয়াড়রা কি সুযোগ পাবেন বিদেশে খেলে প্রস্তুতি নেওয়ার?
রিয়াজুল হাসান : অবশ্যই বিশ্বকাপের আগে বিদেশি দলের সঙ্গে খেলবে আমাদের যুব দল। আমরা চেষ্টা করব তাদের বিদেশে পাঠানোর। এছাড়া বিদেশি দল দেশে এনে খেলানোর পরিকল্পনা আছে। সব রকম চেষ্টাই করব আমরা। ছেলেদের সর্বোচ্চ সমর্থন দিবে ফেডারেশন। এশিয়া কাপ আর বিশ্বকাপের মধ্যে অনেক পার্থক্য। তবে এটা কবে হবে, না হবে আমরা বলতে পারব না। কোচরা বসবেন, উনারা স্লট বের করে দিবেন। ঐ স্লট অনুযায়ী কাজ হবে। এর আগে সম্ভব না।
প্রশ্ন : ওমানে ১৮ খেলোয়াড়ের সবাই ছিলেন বিকেএসপির সাবেক ও বর্তমান ছাত্র। গত হকি লিগে ১১টি ক্লাবের ২৪৩ জন খেলোয়াড়ের মধ্যে সাবেক ও বর্তমান মিলিয়ে বিকেএসপিরই ১১৫ জন। বিকেএসপি ছাড়া খেলোয়াড় উঠে আসার বিকল্প উৎস তৈরিতে কোনও উদ্যোগ আছে হকি ফেডারেশনের?
রিয়াজুল হাসান : আসলে বিকেএসপিতে যেসব সুবিধা আছে সেসব অন্য জায়গায় নেই। এই ক্ষেত্রে সরকার যতদিন বিকল্প কিছু করে দিতে না পারে আমাদের বিকেএসপির সাহায্য লাগবে। এটা ঠিক ইসা, মুসা, কামাল, হারুনদের মত খেলোয়াড়রা কেউই বিকেএসপিতে পড়েনি। আরমানিটোলা, রাজশাহীর বৈকালী সংঘ, ফরিদপুরের কমলাপুর থেকে অনেক খেলোয়াড় উঠে এসেছিল।
এখন চর্চাটা কমে গেছে। হকি ঢাকা শহর কেন্দ্রিক খেলা হয়ে যাচ্ছে, যা খেলাটার জন্য স্বাস্থ্যকর নয়। আমি দায়িত্বে আসার পর জেলার হকিতে মনোযোগ দিয়েছি। খেলাটার উন্নতি করতে হলে আমাদের জেলা পর্যায়ে ফিরে যেতে হবে। মজার ব্যপার হচ্ছে, জেলাগুলোতে মেয়েদের দলের সংখ্যা বাড়তে দেখছি। ছেলেদেরটা তুলনায় কমছে। এর কারণ আমি জানি না। তবে নারী খেলোয়াড় উঠে আসলে আমাদের বয়সভিত্তিক দল ও জাতীয় দল শক্তিশালী হবে অবশ্যই।
প্রশ্ন : হকির মূল বিশ্বকাপে খেলে ১৬ দল। বাংলাদেশের র্যাঙ্কিং ৩০ এর নীচেই থাকে। আমাদের বর্তমান র্যাঙ্কিং ২৯। যুবারা এখন বিশ্বকাপে, জাতীয় দলের কবে সেই স্বপ্ন পূরণ হবে?
রিয়াজুল হাসান : খেলোয়াড়, ক্লাব, কোচ, ফেডারেশন সবাই মিলে যদি আন্তরিকভাবে কাজ করি তাহলে অবশ্যই ভালো ফলাফল আসবে। অলৌকিক কিছু আশা করা উচিত না। কিন্তু বর্তমান অবস্থা থেকে আমরা আরও উন্নতি করব, এই বিশ্বাস আমার আছে। আশা করছি যুব বিশ্বকাপে ছেলেরা ভালো করলে আবারও জোয়ার আসবে হকিতে।