সিনেমার নিজস্ব যে ভাষা রয়েছে, গত শতকের ৯০ দশকে সেটির একটি বড় বাঁক বদল ঘটে। বিশেষ করে, হলিউডের সিনেমার জন্য এই দশকটি ছিল মাইলফলক।
কম্পিউটার প্রযুক্তির ব্যাপক অগ্রগতি আর স্পেশাল ইফেক্ট হলিউড মুভিকে নিয়ে যায় অন্য স্তরে। সে সময় কম বাজেটের ‘স্বাধীন চলচ্চিত্র’ ধারাও অর্জন করে জনপ্রিয়তা। নব্বই দশকের বহু সিনেমাই আজ পেয়েছে ক্লাসিকের মর্যাদা। এই নব্বইয়ের দশকেই হলিউডপ্রেমী দর্শকরা পায় দারুণ কিছু ফ্র্যাঞ্চাইজি মুভি। আজকের বহু হলিউড তারকার শুরুটাও এই দশকেই।
এই দশকে মুক্তি পেয়েছে বহু জনপ্রিয় সিনেমা। ‘টাইটানিক’ -এর মতো ব্লকবাস্টার কিংবা ‘দ্য ব্লেয়ার উইচ’ এর মতো হরর সিনেমা দিয়েই এই দশকে সিনেমা নির্মাণের ভাষা বদলে যাওয়া ব্যাপারটি আমরা বিশ্লেষণ করতে পারি। নির্মাণের এই নতুন ভাষা দিয়েই বেশ কিছু সিনেমা ৯০ দশককে করেছিল বাজিমাত। এই দশককে দিয়েছিল অনন্য বৈশিষ্ট্য।
গত শতকের ৯০ দশকের তেমন আইকনিক ১০ সিনেমা সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক-
ক্লুলেস (১৯৯৫)
বেভারলি হিলস হাই স্কুলের ছাত্রী (অ্যালিসিয়া সিলভারস্টোন) শের হরোয়িটজ। একে তো সুন্দরী তার ওপর ধনী। আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের শের হরোয়িটজ খুব সহজেই যে কাউকে তার কাজ করিয়ে নিতে পারে। কিন্তু এটা আসল গল্প নয়। গল্পটা মূলত শুরু হয়, যখন অন্য স্কুল থেকে বদলি হয়ে এল ‘তাই’ (ব্রিটানি মার্ফি) নামের একটি মেয়ে। গোবেচারা এই মেয়ের সঙ্গী হতে গিয়েই শের আবিষ্কার করে নিজের কিছু সত্য।
অ্যামি হ্যাকারলিং নির্মিত ১২ মিলিয়ন বাজেটের এই ছবিটি বক্স অফিসে আয় করে ৮৮ মিলিয়ন ডলার।
টয় স্টোরি (১৯৯৫)
অ্যানিমেটেড মুভি ‘টয় স্টোরি’ মুক্তি পায় ১৯৯৫ সালে। নির্মাণ করেন জন লাসেটার।
কিছু পুতুল চরিত্রের গল্প নিয়ে ‘টয় স্টোরি’। শান্ত-ভদ্র কাউবয় পুতুল উডি (কণ্ঠ দিয়েছেন টম হ্যাঙ্কস)। যে একটি পুতুল দলের দলনেতা। পুতুলগুলো তাদের মালিককে বেশ আনন্দেই রেখেছিল। কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো দশাসই সাইজের পুতুল বায লাইটইয়ারের (টিম অ্যালেন-এর কন্ঠে) আগমনে। এই পুতুল দ্রুত মালিকের পছন্দের পাত্রে পরিণত হলে উডি হিংসায় জ্বলতে থাকে। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা জমে উঠতে না উঠতেই তারা সিড নামের এক উন্মাদের পাল্লায় পড়ে, যে কিনা পুতুলদের নির্যাতন করে আনন্দ পায়। আর তখনই বায আর উডির মধ্যে গড়ে ওঠে ঐক্য।
দারুণ সাড়া জাগানো গত শতকের এই অ্যানিমেটেড মুভিটি আজও একই রকম আবেদন ধরে রেখেছে। সারাবিশ্বে ৩৭৩ মিলিয়ন ডলার আয় করে।
প্রযুক্তিগত দিক ছাড়াও সিনেমা হিসেবে ‘টয় স্টোরি’ অসম্ভব মজার এবং ভীষণ কল্পনাপ্রবণ। ‘টয় স্টোরি’ আবেগে দোলা দেওয়া এক চলচ্চিত্র।
এটি ছিল বিশ্বের প্রথম কম্পিউটার অ্যানিমেটেড মুভি এবং অ্যানিমেশন স্টুডিও পিক্সারেরও প্রথম কাজ।
দ্য ব্লেয়ার উইচ প্রজেক্ট
চলচ্চিত্রের তিনজন ছাত্র পৌঁছে গেল মেরিল্যান্ড নামের ছোট্ট এক শহরে। উদ্দেশ্য- ‘ব্লেয়ার উইচ’ নামে চালু থাকা শহরের এক কিংবদন্তী নিয়ে তারা সিনেমা বানাবে। সেই লক্ষ্য নিয়ে তারা যাত্রা শুরু করে শহরকে ঘিরে থাকা বনের দিকে। ধারণা করা হতো, বনের মাঝেই মিলবে ভয়ঙ্কর কিছুর অস্তিত্ব। তাদের সঙ্গী ছিল ছোট ভিডিও ক্যামেরা আর প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস।
‘দ্য ব্লেয়ার উইচ প্রজেক্ট’ কে বলা হয় পৃথিবীর অন্যতম সেরা হরর সিনেমা। সীমিত বাজেটের সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৯৯ সালে। সারাবিশ্ব কাঁপিয়ে দেওয়া এই সিনেমা সে সময় প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সুপার-ডুপার হিট এই সিনেমাটি যৌথভাবে নির্মাণ করেন ড্যানিয়েল মায়রিক এবং এদুয়ার্দো সানচেজ।
দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন
ব্যক্তিগত জীবনে একজন সফল ব্যাংকার অ্যান্ডি ডুফ্রেইন। স্ত্রী হত্যার দায়ে যার স্থান হয় জেলখানায়। সেখানে গিয়ে তার পরিচয় ঘটে আরেক বন্দি রেড এর সাথে। রেড তার শান্ত স্বভাবের কারণে অপর বন্দিদের কাছে ছিলেন শ্রদ্ধার পাত্র। গল্পে দুজনের মাঝে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। আর বন্ধুত্বের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায় গল্প।
ব্যাংকার অ্যাডি ডুফ্রেইনের চরিত্রে অভিনয় করেন টিম রবিন্স। আর রেড এর চরিত্রে অভিনয় করেন মর্গান ফ্রিম্যান।
আইএমডিবি-তে সর্বোচ্চ রেটিং পাওয়া ‘দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন’-কে নিখুঁত নির্মাণ এবং দুর্দান্ত গল্পের জন্য সেরা সিনেমার একটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বক্স অফিসে মুখ থুবড়ানোর পর ক্লাসিক হয়ে ওঠা ‘দ্য শশাঙ্ক রিডেম্পশন’ -কে ৯০ এর দশকের সিনেমা নিয়ে আলোচনা হলে এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব। ১৯৯৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই সিনেমার পরিচালক ফ্র্যাঙ্ক ড্যারাবন্ট।
টাইটানিক
১৯১২ সালের এক বিখ্যাত সামুদ্রিক দুর্ঘটনার প্রেক্ষাপটে নির্মিত হয় ‘টাইটানিক’। গল্প এগিয়ে যায় নিম্নবিত্ত শিল্পী জ্যাক ডসোন এবং অভিজাত রোজ ডেউইট বুকাটার পরিণয়কে সঙ্গে নিয়ে। এটি ছিল দুজনেরই প্রথম সমুদ্র যাত্রা। ডসোনের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও আর রোজের চরিত্রে কেট উইন্সলেট।
কিন্তু ‘অজেয়’ বলে বিবেচিত জাহাজ টাইটানিকের সঙ্গে তাদের পরিণয়েরও সলিল সমাধি ঘটে।
১৯৯৭ সালে মুক্তি পাওয়া সিনেমাটি এক যুগেরও বেশি সময় ধরে দখল করে রেখেছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি আয় করা সিনেমার স্থান। টানা ৫৪ সপ্তাহ ধরে সিনেমা হলে দর্শক ধরে রাখা এই ‘টাইটানিক’-কে পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম সফল সিনেমা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি নির্মাণ করেছিলেন জেমস ক্যামেরন।
স্ক্রিম
এক কিশোরীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর ক্যালিফোর্নিয়ার এক শান্ত শহর হয়ে ওঠে অশান্ত। সহসা সংবাদ মাধ্যমের মনযোগের কেন্দ্রে চলে আসে শহরটি। খবর চাউড় হয়ে যায়- শহরে নাকি আতঙ্ক ছড়াচ্ছে এক সিরিয়াল কিলার। এমন সময় সিডনি প্রেসকট (নেভ ক্যাম্পবেল) এবং তার বন্ধুরা বুঝতে পারে যে তারাও হতে পারে এই সিরিয়াল কিলারের পরবর্তী লক্ষ্য। তাই সিডনিকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে একজন ডেপুটি শেরিফ এবং এক রিপোর্টার।
১৯৯৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘স্ক্রিম’ হলিউডের অন্যতম আলোচিত হরর মুভি।
দ্য মেট্রিক্স
থমাস অ্যান্ডারসন (কিয়ানু রিভস) দিনের বেলা একজন গোবেচারা স্বভাবের কম্পিউটার প্রোগ্রামার। কিন্তু রাতে তিনি আন্ডারওয়ার্ল্ডের একজন হ্যাকারে পরিণত হন, যার নাম ‘নিও’। মানব জাতির অস্তিত্বের প্রশ্নটি সমাধান করতে গিয়ে নিও এক জটিল পরিস্থিতিতে পড়ে যায়। আর তখন সাইবার স্পেসে ঘটতে থাকা অবিশ্বাস্য সব বিপদ সামলাতে হয় নিওকে।
‘দ্য মেট্রিক্স’ সাই-ফাই জনরার ইতিহাসের এক বাঁক বদল। এই সিনেমার মধ্য দিয়ে সায়েন্স ফিকশন জনরার চলচ্চিত্রের ধারণায় ঘটে আমূল পরিবর্তন।
১৯৯৯ সালে সিনেমাটি মুক্তি পায়।
ফাইট ক্লাব
অনিদ্রায় ভোগা নামহীন এক চরিত্র পালানোর চেষ্টা করছেন তার করুণ বাস্তবতা থেকে। আর পালাবার পথে তার দেখা হয়ে যায় ডারডেন নামের আরেক চরিত্রের সঙ্গে। ডারডেন একজন অ্যানার্কিস্ট, পেশায় সাবান ব্যবসায়ী। নামহীন ওই চরিত্র আর ডারডেন মিলে পরে গড়ে তোলে ফাইট ক্লাব।
নামহীন তরুণের চরিত্রে এতে অভিনয় করেছেন এডওয়ার্ড নরটন আর ডারডেনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন ব্র্যাড প্রিট।
‘ফাইট ক্লাব’-কে বলা হয় হলিউডের অন্যতম মাস্টারপিস। ডেভিড ফিঞ্চার নির্মিত এই সিনেমাটি ১৯৯৯ সালে মুক্তি পায়।
গুডফেলাস
‘গুডফেলাস’ গল্প হেনরি হিলের (রে লিওটা) জীবন আর অভিজ্ঞতাকে ঘিরে। গল্পের হেনরি হিল শুরু ১৯৬০ এবং ৭০-এর দশকের একজন খুদে গ্যাংস্টার হিসেবে। তার দুই সহযোগী টমি এবং জিমি (রবার্ট ডি নিরো) এমন সব ঘটনা ঘটায় যেগুলো গল্পে নিয়ে আসে ক্লাইমেক্স।
যেকোনো দৃষ্টিকোণ থেকেই ‘গুডফেলাস’ একটি নিখুঁত নির্মাণ। পরিচালক মার্টিন স্করসেসে মাস্টারপিস নির্মাণে দারুণ দক্ষ। আর এই কাজে গত শতকের ৮০ এবং ৯০ এর দশকে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। তবে ‘গুডফেলাস’ তার সেরা কাজ।
পাল্প ফিকশন
হিটম্যান জুলস (স্যামুয়েল এল জ্যাকসন) এবং ভিনসেন্ট (জন ট্র্যাভোল্টা) -এর ওপর চুরি হওয়া একটি ব্রিফকেস ফেরত আনার দায়িত্ব বর্তায়। এই কাজ করতে গিয়ে বিচিত্র ধরনের বিপজ্জনক সব ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তাদের। এদের একজন বুচ (ব্রুস উইলিস), এবং তাদের ‘বস’এর স্ত্রী মিয়া (উমা থারম্যান)।
৯০ দশকে দারুণ সব সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল। তবে ‘পাল্প ফিকশন’-এর মতো সিনেমা খুব বেশি নেই। গত শতকের সিনেমা হয়েও ‘পাল্প ফিকশন’ কালোত্তীর্ণ। ‘এটি এমন এক সিনেমা যার মতো ঠিক আরেকটি এখনও তৈরি করা সম্ভবই হয়নি। পরিচালক কোয়েন্টিন ট্যারেন্টিনো চরিত্র এবং সংলাপ নির্মাণের ক্ষেত্রে বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।