মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে নতুন মোড় বাংলাদেশে ফের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ক্ষেত্র তৈরি করেছে। অনেক রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ঢুকেও পড়েছে। কিন্তু এই সংখ্যাটি কত, তা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সুস্পষ্ট তথ্য মিলছে না।
১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গার সঙ্গে আর কত যোগ হয়েছে, তা নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একেক উপদেষ্টার কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে একেক রকম তথ্য।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সোমবার বিজিবি সদর দপ্তরে এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নে জানান, নতুন করে ৬০ হাজার রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
তবে এর সময়কাল নিয়ে তিনি বলেন, এই সংখ্যক রোহিঙ্গা ঢুকেছে গত দেড় থেকে দুই বছরে।
একদিন আগে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের কাছ থেকে এসেছিল ভিন্ন রকম তথ্য। তিনি ৬০ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কথা বললেও সময়কাল জানিয়েছিলেন গত দুই মাস।
পাঁচ মাস আগে দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সোমবার ৬০ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের তথ্যটি জানানোর সময় শুরুতে বলেছিলেন, এটা ২০১৭ সালের পর থেকে।
এসময় পাশ থেকে একজন কর্মকর্তা তাকে নিচু স্বরে কিছু বললে তিনি সময়কাল পরিবর্তন করে বলেন, এটা গত দেড় থেকে দুই বছরের মধ্যে।
এদিকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি সংখ্যাটি বলেছেন ৮০ হাজার। তিনি গত ১৮ ডিসেম্বর কায়রোয় মালয়েশিয়ার মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে তথ্যটি দেন বলে সরকারি সংবাদ সংস্থা বাসসে সেদিন প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়।
প্রধান উপদেষ্টা ৮০ হাজার অনুপ্রবেশের ক্ষেত্রে সময়কাল নির্দিষ্ট না করে বলেছিলেন, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে নতুন করে ৮০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সামরিক বাহিনীর নিপীড়নের মুখে ২০১৭ সালের আগস্টে বাংলাদেশ সীমান্তে নামে রোহিঙ্গা ঢল। তাতে কয়েক মাসেই ৭ লাখের বেশি শরণার্থী হয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। এর আগে থেকেই ছিল ৩ লাখের মতো। শরণার্থী জীবন কাটানো রোহিঙ্গাদের ঘরে নতুন সন্তান আসায় সংখ্যাটি এখন ১২ লাখ ছাড়িয়ে গেছে বলে ধারণা করা হয়।
এই রোহিঙ্গাদের বেশিরভাগই আছে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ার শরণার্থী শিবিরে। কিছু রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর ভাসানচরে নেওয়া হয় কয়েক বছর আগে।
প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে গত কয়েক বছর ধরেই চলছে গৃহযুদ্ধ। তাতে বিভিন্ন রাজ্যের কর্তৃত্ব হারাচ্ছে জান্তা সরকার। বাংলাদেশ লাগোয়া রাজ্য রাখাইনও এখন বিদ্রোহী দল আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে।
বৌদ্ধ নেতৃত্বাধীন আরাকান আর্মির সঙ্গে মুসলমান জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের বিরোধ থাকায় নতুন করে শরণার্থী অনুপ্রবেশ ঘটছে।
বিজিবি সদর দপ্তরে বিজিবি সপ্তাহ-২০২৪ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম মিয়ানমারের পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “আপনাদের বুঝতে হবে, সেখানে যুদ্ধ চলছে। স্বাভাবিক পরিবেশ না।”
এর আগে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ বলেছিলেন, নতুন করে শরণার্থীর ভার নেওয়া বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভবপর নয়।
একই কথা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাও বলেন, তবে তার মধ্যেও রোহিঙ্গা ঢুকে পড়া নিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের নীতিগত অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয় নাই। আমরা কোনোভাবেই রোহিঙ্গাদের নতুন করে প্রবেশ করতে দেব না। যেহেতু ওই এলাকায় যুদ্ধ হচ্ছে, মানবিক দিক বিবেচনা করে সবাইকে পাঠানো যায় নাই। কিছু লোক ঢুকেছে। কিন্তু ম্যাক্সিমাম লোকজনকে আমরা পাঠিয়ে দিয়েছি। যারা বয়স্ক কিংবা ছোট, তাদেরই ঢুকতে দেওয়া হয়েছে।”
রোহিঙ্গা সংকটের কারণে লাখ লাখ শরণার্থীর ভার বহন করে সবচেয়ে বেশি ভুগছে বাংলাদেশ। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের চুক্তি হলেও কোনও শরণার্থীকে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো যায়নি।
এর মধ্যে ২০০২ সালে মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটে। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা নেয় সামরিক বাহিনী। এখন আবার বিদ্রোহী দলগুলো শক্তিশালী হয়ে ওঠায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে।
অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “আপনারা জানেন, মংড়ু (রাখাইন রাজ্যের শহর) পতনের পর থেকে আমাদের সাথের সীমান্ত আরাকান আর্মির সাথে। এতে আমাদের যোগাযোগ ঘাটতি তৈরি হয়েছে৷ এদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। যোগাযোগ করা হচ্ছে ইনফরমালি। আমাদের সরকার চেষ্টা করছে, যত তাড়াতাড়ি পারা যায় সমস্যা সমাধানের জন্য।”
বিজিবি সদর দপ্তরের এই অনুষ্ঠানে উপদেষ্টা জানান, দেড় দশক আগে পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের সময়কার হত্যাকাণ্ড পুনঃতদন্তে কমিশন গঠন চূড়ান্ত হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার স্বাক্ষর করেছেন, এখন প্রজ্ঞাপন জারি হবে।
সাত সদস্যের এই কমিশনে সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর সাবেক মহাপরিচালক এ এল এম ফজলুর রহমান নেতৃত্ব দেবেন বলে উপদেষ্টা জানান।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ফজলুর রহমান বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০০১ সালের জুলাই পর্যন্ত বিডিআরের মহাপরিচালক ছিলেন।
তার দায়িত্ব পালনের সময়ই ২০০০ সালে টেকনাফে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সীমান্তে সংঘর্ষ হয়েছিল। ২০০১ সালে কুড়িগ্রামের রৌমারী সীমান্তে বিডিআর-বিএসএফ সংঘাতের সময়ও তিনিই ছিলেন বাহিনীর দায়িত্বে।