Beta
বুধবার, ২২ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
বুধবার, ২২ জানুয়ারি, ২০২৫

এক হচ্ছে হোন্ডা ও নিসান; লক্ষ্য কী

Honda_Nissan_1
[publishpress_authors_box]

চীনা গাড়ি শিল্পের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য জাপানের বড় দুই কোম্পানি হোন্ডা ও নিসান একীভুত হওয়ার পরিকল্পনা করছে। গাড়ি শিল্পে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসার চলমান পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়ার মধ্যে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে যাচ্ছে।

কোম্পানি দুটি একত্রিত হলে তারা টয়োটা, ফোর্ড, ফোক্সভাগেন ও জেনারেল মটরসের মতো বিশ্বের সবচেয়ে বড় গাড়ি উৎপাদকদের আরেকটি হয়ে উঠতে পারে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের টেসলা ও চীনের বিওয়াইডির সঙ্গে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা অর্জন করবে।

বিক্রির দিক থেকে টয়োটা ও ফোক্সভাগেনের পর বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম গাড়ি নির্মাতা হিসাবে আবির্ভূত হতে পারে হোন্ডা-নিসান। বর্তমান তৃতীয় স্থানটি দক্ষিণ কোরিয়ার হিয়ন্দে ও কিয়ার অধিকারে রয়েছে।

হোন্ডার সিইও তোশিহিরো মিবে বলেন, ‘চীনা শক্তির উত্থান’ মোকাবেলার জন্য সম্ভাব্য বহু শত কোটি ডলারের চুক্তি এই মিলন পরিকল্পনার প্রধান চালিকাশক্তি। তিনি বলেন, “প্রতিদ্বন্দ্বীদের কাছে পরাজিত হওয়ার ঝুঁকি এড়াতে ২০৩০ সালের মধ্যে একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন।”

কোম্পানি দুটি জানিয়েছে, তারা সোমবার একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। আর এই মিলনে মিতসুবিশিও যোগ দেবে, যার বৃহত্তম শেয়ারহোল্ডার নিসান। তিনটি কোম্পানির প্রধান নির্বাহীরা টোকিওতে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

তিনটি কোম্পানি একসঙ্গে তাদের সম্পদ ব্যবহার করে অন্যান্য বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিযোগীদের, যেমন টেসলা বা বিওয়াইডির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারবে।

বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজারে চীন নির্মিত গাড়ির প্রভাব বাড়ছে, যার মধ্যে বিওয়াইডি প্রধান। এর গাড়িগুলো বিশ্বের কিছু বিখ্যাত গাড়ি কোম্পানির জন্যও হুমকি হয়ে উঠেছে।

মিবে সাংবাদিকদের বলেন, “চীনা শক্তির উত্থান এবং উদীয়মান শক্তির প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। এতে গাড়ি শিল্পের কাঠামো বদলে যাচ্ছে।”

তিনি জানান, আগামী জুনের মধ্যে নিসান ও হোন্ডার আনুষ্ঠানিক একীভুতকরণ চুক্তি সই হবে। আর ২০২৬ সালের আগস্টের মধ্যে চুক্তি সম্পন্ন করে নতুন হোল্ডিং কোম্পানির শেয়ার টোকিও স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত করা হবে।

জাপানের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বৃহত্তম গাড়ি নির্মাতা হোন্ডা ও নিসান একীভুত হলে তা হবে ২০২১ সালে ফিয়াট ক্রাইসলার অটোমোবাইলস ও পিএসএ-র মিলনের পর বৈশ্বিক গাড়ি শিল্পের সবচেয়ে বড় একীভূতকরণ। সেই মিলনে ৫২ বিলিয়ন ডলারের চুক্তিতে স্টেলানটিস সৃষ্টি হয়েছিল।

হোন্ডা ও নিসানের কর্মকর্তারা জানিয়েছে, একীভুত হওয়ার মাধ্যমে দুটি কোম্পানি সম্মিলিতভাবে ৩০ ট্রিলিয়ন ইয়েন (১৯১ বিলিয়ন ডলার) বিক্রয় এবং ৩ ট্রিলিয়ন ইয়েনের বেশি পরিচালন মুনাফা অর্জনের লক্ষ্য রাখবে।


চীনে বাড়তি প্রতিযোগিতার ফলে চ্যালেঞ্জে গাড়ি শিল্প

চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় গাড়ি তৈরিকারী বড় জাপানি কোম্পানিগুলো পিছিয়ে পড়ছে। সস্তা শ্রম ও কম উৎপাদন খরচ চীনের স্থানীয় কোম্পানিগুলোকে আরও দ্রুতগতিতে কাজ করতে এবং তাদের পণ্য বিদেশি প্রতিদ্বন্দ্বীদের তুলনায় কম দামে বিক্রি করতে সক্ষম করে তুলেছে।

এতে তারা ক্রেতাদের কাছে আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। ফলে চীন বৈদ্যুতিক গাড়ি শিল্পে বিশ্বের সবচেয়ে বড় উৎপাদকে পরিণত হয়েছে। বিওয়াইডি কো. এবং অন্যান্য চীনা কোম্পানি যেমন এক্সপেং, নিও, লি অটো-র তৈরি বৈদ্যুতিক ও হাইব্রিড গাড়ির জনপ্রিয়তা, একসময় যেসব বাজারে জাপানি গাড়ি নির্মাতারা নেতৃত্ব দিত, সেগুলোতে তাদের স্থান দখল করে নিয়েছে।

গত অক্টোবর মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কর্মকর্তারা বলেছিল, চীনা সরকার তার বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতাদের অনুচিৎভাবে ভর্তুকি দিচ্ছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন চীন থেকে বৈদ্যুতিক গাড়ি আমদানির উপর বেশি শুল্ক আরোপের ঘোষণাও দেয়। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে শুল্ক ১০% থেকে ৪৫% বাড়ানো হবে।

তবে এ নিয়ে ইউরোপে উদ্বেগও রয়েছে যে, এতে বৈদ্যুতিক গাড়ির দাম বেড়ে যেতে পারে, যা ক্রেতাদের জন্য গাড়ি কেনা আরও কঠিন করে তুলতে পারে।

জাপান সরকার ২০১৯ সাল থেকে হুঁশিয়ার করে আসছিল যে চীনা গাড়ি শিল্পের উল্লম্ফনে তাদের গাড়ি শিল্প অস্তিত্বের হুমকিতে পড়বে। সে সময় তারা হোন্ডা ও নিসানকে একত্রিত হওয়ার এবং সম্ভাব্য সংযুক্তি নিয়ে আলোচনা করারও পরামর্শ দেয়।

চীনের গাড়ি শিল্প গত কয়েক বছরে রপ্তানির ক্ষেত্রে ব্যাপক বৃদ্ধি দেখছে। একটি শিল্প সংগঠন দাবি করেছে, ২০২৩ সালে চীন বিশ্বের শীর্ষ গাড়ি রপ্তানিকারক হিসাবে জাপানকে অতিক্রম করেছে।

হোন্ডা, নিসান ও মিতসুবিশি একীভুত হলে এই তিনটি গাড়ি প্রস্তুতকারকের বাজার মূল্যের ভিত্তিতে নতুন হোল্ডিং কোম্পানিটির মূল্য ৫০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।

এই একীভূত কোম্পানি টয়োটা ও জার্মানির ফোক্সভাগেনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারবে। টয়োটাও এরই মধ্যে জাপানের মাজদা ও সুবারুর সঙ্গে প্রযুক্তিগত অংশীদারত্ব গড়ে তুলেছে।

তবে হোন্ডা, নিসান ও মিতসুবিশি একত্রিত হলেও টয়োটাই জাপান ও বিশ্বের শীর্ষ গাড়ি উৎপাদক হিসাবে রয়ে যাবে। ২০২৩ সালে টয়োটা ১ কোটি ১৫ লাখ গাড়ি তৈরি করেছে।

আর এই তিনটি ছোট কোম্পানি একত্রিত হলে প্রায় ৮০ লাখ গাড়ি উৎপাদন করতে পারবে। ২০২৩ সালে হোন্ডা ৪০ লাখ, নিসান ৩৪ লাখ এবং মিতসুবিশি মোটরস ১০ লাখের কিছু বেশি গাড়ি তৈরি করেছে।


প্রতিযোগিতা মোকাবেলার সক্ষমতা

নিসানের সিইও মাকোতো উচিদা জানান, নিসান ও হোন্ডার মোট বিক্রি ১৯১ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।

গত মার্চে এই দুটি জাপানি গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি বৈদ্যুতিক গাড়ি (ইভি) নিয়ে একটি কৌশলগত অংশীদারত্ব গঠনের জন্যও আলোচনা শুরু করে।

মিবে বলেন, “আলোচনা শুরু হয়েছে, কারণ আমরা বিশ্বাস করি, ২০৩০ সালের মধ্যে আমাদেরকে উদীয়মান শক্তি এবং বর্তমান প্রতিদ্বন্দ্বীদের মোকাবিলা করার জন্য সক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে। অন্যথায়, আমরা পরাজিত হবো।”

তিনি আরও বলেন, এই চুক্তিটি নিসানকে উদ্ধার করার জন্য নয়, যেটি বিক্রি কমে যাওয়ার কারণে সংগ্রাম করছে।

নভেম্বর মাসে নিসান জানিয়েছিল, তারা প্রায় ৯ হাজার কর্মী ছাটাই করছে যা তাদের বৈশ্বিক কর্মশক্তির প্রায় ৬ শতাংশ। এ ছাড়া তারা চীন ও যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রয় কমে যাওয়ায় বৈশ্বিক উৎপাদনও ২০% কমিয়ে দেবে।

এক সময় জাপানের গাড়ি তৈরির শক্তির প্রতীক নিসান তার দীর্ঘদিনের সিইও কার্লোস ঘোশনের গ্রেপ্তারের পর গত কয়েক বছর ধরে টিকে থাকার সংগ্রাম করছে।

২০১৯ সালে কার্লোস ঘোশন জাপান থেকে পালিয়ে যান। তার বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ আনা হয়েছিল এবং বর্তমানে তিনি ইন্টারপোলের রেড নোটিসের আওতায় রয়েছেন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কাছে তার অবস্থান জানিয়ে গ্রেপ্তারের অনুরোধ করা হয়েছে।

ডিসেম্বরে লেবাননে অবস্থানরত ঘোশন সাংবাদিকদের বলেছেন, হোন্ডার সঙ্গে নিসানের একীভুত হওয়ার পরিকল্পনা হলো উদ্বেগ ও হতাশার ফলস্বরূপ একটি পদক্ষেপ।

তবে মিবে বলছেন, যেকোনো মিলন পরিকল্পনা নিসানের পুনরুদ্ধারের ওপর নির্ভর করবে।


মার্চে হোন্ডা ও নিসান তাদের বৈদ্যুতিক গাড়ি ব্যবসায় সহযোগিতার ব্যাপারে সম্মত হয়েছিল এবং আগস্টে তাদের সম্পর্ক আরও গভীর হয়। সেসময় তারা ব্যাটারি এবং অন্যান্য প্রযুক্তিতে একসঙ্গে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়।

তবে, এই চুক্তিটি জাপানে তীব্র রাজনৈতিক পর্যালোচনার অধীনে আসতে পারে। কারণ এটি অনেক কর্মী ছাঁটাইয়ের কারণ হতে পারে। আর নিসান সম্ভবত ফরাসি গাড়ি কোম্পানি রেনো (renault) সঙ্গে তার জোট ভাঙবে।

কোম্পানি দুটি তাদের ব্র্যান্ড বজায় রেখেই গাড়ির প্ল্যাটফর্ম শেয়ার এবং নতুন হাইব্রিড ও বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরি করার জন্য সহযোগিতা করতে চায়। হোন্ডা ও নিসান গবেষণা ও উন্নয়ন কার্যক্রম একত্রিত করে সফটওয়্যার এবং বৈদ্যুতিক গাড়ি একসঙ্গে তৈরির পরিকল্পনাও করেছে।

নিসান আর্থিক সংকটে রয়েছে এবং বাজারে এর অবস্থান পুনরুদ্ধার করা প্রয়োজন, বিশেষ করে ফ্রান্সের রেনো থেকে আলাদা হওয়ার পর। গত মাসে, কোম্পানিটি ৯.৩ বিলিয়ন ইয়েন (প্রায় ৬০ মিলিয়ন ডলার) লোকসান ঘোষণা করেছে।

কোম্পানি দুটি বিভিন্ন বাজার এবং প্রযুক্তিতে তাদের সুনির্দিষ্ট সহযোগিতা কাজে লাগানোর পরিকল্পনাও করছে।

উদাহরণস্বরূপ, নিসান ইউরোপীয় বাজারে শক্তিশালী। কিন্তু হোন্ডা আর ইউরোপে গাড়ি উৎপাদন করে না। নিসান শক্তিশালী বডি-অন-ফ্রেম গাড়ি তৈরি করে, এবং হোন্ডা অসাধারণ পেট্রোল ইঞ্জিন প্রস্তুতকারক, যা গাড়ি তৈরি করার পাশাপাশি অন্যান্য কার্যক্রমেও দক্ষ।

সংবাদসূত্র : বিবিসি, রয়টার্স

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত