Beta
রবিবার, ৭ জুলাই, ২০২৪
Beta
রবিবার, ৭ জুলাই, ২০২৪

আসামের বন্যা বাংলাদেশের জন্য কতটা শঙ্কার

সিলেটে সুরমা নদীতে পানি কমলেও কুশিয়ারায় বেড়েছে। এ নদীর তীরবর্তী ফেঞ্চুগঞ্জ বাজার প্লাবিত হয়েছে। এতে দুর্ভোগ বেড়েছে মানুষের।
সিলেটে সুরমা নদীতে পানি কমলেও কুশিয়ারায় বেড়েছে। এ নদীর তীরবর্তী ফেঞ্চুগঞ্জ বাজার প্লাবিত হয়েছে। এতে দুর্ভোগ বেড়েছে মানুষের।
Picture of প্রতিবেদক, সকাল সন্ধ্যা

প্রতিবেদক, সকাল সন্ধ্যা

বাংলাদেশের উত্তরে ভারতের আসাম এখন দ্বিতীয় দফা বন্যার কবলে, রাজ্যটিতে পরিস্থিতি ক্রমশ ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। সেখানে অতিবৃষ্টিতে ব্রহ্মপুত্রসহ প্রধান কয়েকটি নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার অনেক উপর দিয়ে বইছে।

ব্রহ্মপুত্র নদ আসাম হয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। এছাড়া বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের নদী সুরমা ও কুশিয়ারার জলধারাও আসাম হয়ে এসেছে।

ফলে আসামের বন্যার পানি নামার সময় বাংলাদেশও প্লাবিত হয়। সেই পানি এবার বাংলাদেশেও বন্যা ঘটাতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরাও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী এরই মধ্যে বন্যা মোকাবেলায় আগাম প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।

বন্যা কবলিত আসামের মরিগাঁও জেলার মানুষকে সহায়-সম্বল নিয়ে ভিটে ছেড়ে যেতে হচ্ছে।

আসামে ভয়াবহ বন্যা

বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয় আসামের চেরাপুঞ্জিতে। এবার বর্ষায় গোটা রাজ্যেই প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে। অতিবৃষ্টিতে সেখানকার নদীগুলোর পানি বাড়ায় রাজ্যটির ৩৫ জেলার মধ্যে ২৩ জেলাই বুধবার পর্যন্ত বন্যাকবলিত হয়েছে। সেখানে ব্রহ্মপুত্রসহ কয়েকটি নদীর পানি বিপৎসীমার অনেক ওপরে।

আসামে দ্বিতীয় ধাপের এই বন্যায় দুর্গত প্রায় সাড়ে ১১ লাখ মানুষ। এবার বন্যা, ভূমিধস ও ঝড়ে সেখানে প্রাণ হারিয়েছেন ৪৮ জন। রাজ্যটিতে প্রায় ৩ লাখ মানুষ ঘরভিটে ছেড়ে ৪৯০টি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন।

বাংলাদেশেও পরিস্থিতির অবনতির শঙ্কা

আসামের বন্যার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন আবহাওয়াবিদরা। তারা বলছেন, অব্যাহত বৃষ্টি ও আসাম থেকে আসা পানিতে দেশের প্রধান নদীগুলোর পানি বেড়ে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। 

ব্রহ্মপুত্র ভারত থেকে বাংলাদেশে ঢুকেছে কুড়িগ্রাম জেলা দিয়ে। ফলে এই জেলাতেও বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানিয়েছে, ধরলা নদীর পানি বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ও ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

মঙ্গলবার বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার সঙ্গে সংযুক্ত নদ-নদীর পানির সমতল বাড়ছে, যা আগামী ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। গঙ্গা-পদ্মা নদীর পানির সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে।

আবহাওয়া সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন উজানে আগামী ২৪ ঘণ্টায় ভারি বৃষ্টির আভাস রয়েছে। এসময় উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানির সমতল সময় বিশেষে বেড়ে কিছু পয়েন্টে স্বল্পমেয়াদে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে।

আগামী ২৪ ঘণ্টায় দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের মুহুরী, ফেনী, হালদা, সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদীর পানির সমতল সময় বিশেষে বেড়ে বিপৎসীমার কাছাকাছি প্রবাহিত হতে পারে। সেইসঙ্গে আগামী ২৪ ঘণ্টায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলার কিছু নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির সামান্য অবনতি হতে পারে। মৌলভীবাজার জেলার বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে।

সিলেটে বন্যা কবলিত মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে।

সিলেট অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি আগে থেকেই নাজুক। দ্বিতীয় দফায় ফের তলিয়েছে সুনামগঞ্জ, এমনকি যেসব এলাকা থেকে পানি নেমে গিয়েছিল সেসব জায়গাও ফের প্লাবিত হয়েছে।

এর কারণ হিসেবেও ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জিতে ভারি বর্ষণের কথা বলেছেন সুনামগঞ্জের পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী-২ ইমদাদুল হক। তিনি বলেন, চেরাপুঞ্জিতে ভারি বর্ষণের কারণে আবারও বন্যা সৃষ্টি হয়েছে। 

উজানের ঢল ও অতিবৃষ্টিতে সিলেটে দ্বিতীয় ধাপের বন্যা প্রলম্বিত হচ্ছে, যা ভোগান্তি বাড়িয়েছে দুর্গত মানুষের।

সুরমা কুশিয়ারার পানি সিলেট জেলার ৬টি পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বুধবার বিকাল থেকে সুরমা নদীর পানি কিছুটা কমতে শুরু করলেও কুশিয়ারা নদীর পানি ক্রমশ বাড়ছে। কুশিয়ারা তীরবর্তী উপজেলাগুলোর রাস্তাঘাট, হাঠ বাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানিবন্দি থাকায় চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন মানুষ।

সিলেট জেলা প্রশাসনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, জেলার ১৩টি উপজেলায় বন্যা আক্রান্ত লোকসংখ্যা ৬ লাখ ৪৯ হাজার ৩৩৮ জন। ১০টি উপজেলার ১৯৭টি আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করছেন ৮ হাজার ৮২৮ জন মানুষ। প্রলম্বিত বন্যার কারণে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশনের অভাবের পাশাপাশি দেখা দিয়েছে নানা পানিবাহিত রোগ।

সম্প্রতি সিলেটের গোয়াইনঘাটে সারিগোয়াইন নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন

পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “সিলেটে বৃষ্টি বেশি এবং ভারতের মেঘালয় ও আসামে অতিরিক্ত বৃষ্টি হওয়ার কারণে এবার সিলেট ও সুনামগঞ্জে বারবার এমন বন্যা হচ্ছে।”

দেশে জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বন্যা হতে পারে বলে আভাস দিয়ে তিনি বলেন, “তবে যদি এ সময়ে মেঘালয়ে ও উজানে বেশি বৃষ্টি হয়, আর তখনই উজানের পানি নেমে আসবে, সঙ্গে রয়েছে বৃষ্টির পানি। কিন্তু ধারণক্ষমতার চাইতে পানি বেশি হয়ে গেলে তখন লোকালয় তো স্বাভাবিকভাবেই প্লাবিত হবে।

“এবারও তাই হবে। যেভাবে বৃষ্টি এবং পাশের দেশে বন্যা হচ্ছে, তাতে করে আমাদের দেশেও এবারে এর প্রভাব পরবে এবং সেটা ভয়ংকরভাবেই হবে।”

ড. আইনুন নিশাত বলেন, “আমাদের চারপাশের নদীগুলোর উৎস এবং অববাহিকা দেখি… তাহলেই সেটা বোঝা যায় এবং সবসময় তাই হয়ে এসেছে। এবার যদি এভাবেই বৃষ্টি হতে থাকে, চারপাশের নদীগুলোতে পানি বাড়তে থাকে, বাঁধগুলো ঠিক মতো কাজ না করে, বাঁধের ব্যবস্থাপনা যদি না ঠিক করা হয়ে থাকে, তাহলে এবার বন্যা হবে এবং সেটা দীর্ঘস্থায়ী হবে বলেই আমার অভিজ্ঞতা বলছে।”

“ঢাকাসহ সারাদেশের বড় নদী বলেন, ছোট জলাশয় বলেন, খাল বিল বলেন… সব তো ভরাট… পানি যাবে কোথায়? নিষ্কাশন হবে কীভাবে? পানি উপচে ঢাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হবে, প্রভাব পড়বে পুরো ঢাকায়, পুরো দেশে,” বলেন আইনুন নিশাত।

জলবায়ু নিয়ে কাজ করা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের নির্বাহী পরিচালক এম জাকির হোসাইন খান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “এল নিনোর প্রভাবে এবার বৃষ্টি অতিরিক্ত হবে—এটা আগেই বলা হয়েছিল। এবং সেটাই হয়েছে, সামনে আরও হবে।

“জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দেশে ডিফরেস্ট্রেশন (বন নিধন), অপরিকল্পিত নগরায়ন, খাল-বিল-নদীগুলোতে পানি নিস্কাশন ব্যবস্থা না থাকার কারণে দেশের বন্যা পরিস্থিতির বার বার এমন অবনতি হচ্ছে। সেইসঙ্গে রয়েছে ভারত থেকে আসা বন্যার পানি। এসব পানি নামার সঠিক ব্যবস্থাপনাটা দেশে নেই।”

“পানি যেভাবে নেমে যাওয়ার দরকার, সেটা হচ্ছে না এসব কারণে। খাল, বিল, নদীসহ সব জলাশয়তো দখল হয়ে ভরাট হয়ে গেছে, পানিটা নামবে কোন দিক দিয়ে?”

পানি নামার প্রক্রিয়ার যদি সঠিক সমাধান না হয় তাহলে ভবিষ্যতে বন্যার প্রকোপ আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন এম জাকির হোসাইন খান।

তিনি বলেন, “ভারতে প্রবল বন্যা হচ্ছে, এই অতিরিক্ত পানি যখন আর তারা ধারণ করতে পারবে না, তখন সে পানি ছেড়ে দেবে, সেই পানিতে বন্যা হবে দেশেও এবং সেটা প্রোলং (প্রলম্বিত) হবে। উত্তরাঞ্চলে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে ব্যাপক খারাপ অবস্থা হতে পারে।”

আবহাওয়া অধিদপ্তর দীর্ঘ মেয়াদি পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, জুলাই মাসে গড়ে ৫২৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হওয়ার আভাস রয়েছে, যা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। এ মাসে বঙ্গোপসাগরে একটি বা দুটি লঘুচাপ সৃষ্টি হতে পারে, যার মধ্যে একটি মৌসুমী নিম্নচাপে পরিণত হতে পারে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বর্তমানে যে ধারায় নদীর পানি বাড়ছে, সেটি জুলাইয়ের ১০ তারিখ পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। এরপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসার সম্ভাবনাই বেশি। তাতে করে দীর্ঘ মেয়াদে বন্যার শঙ্কা নেই।

“তবে আগস্ট মাসেও মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বৃষ্টি এদেশে হয়ে থাকে। এর সঙ্গে ভারতের উজানের বৃষ্টি হলে বন্যা আবারও দেখা দিতে পারে।”

ভারি বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে পরপর দুই বার বন্যার কবলে সিলেট। ছবি : সকাল সন্ধ্যা

আগাম প্রস্তুতির নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর 

মঙ্গলবার (২ জুলাই) জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বৃষ্টি যেভাবে বাড়ছে, তাতে আগস্টে দেশে বন্যা হতে, পরিস্থিতি মোকাবেলায় এখন থেকেই প্রস্তিুতি নিতে হবে। 

একনেক সভা-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনার কথা জানান পরিকল্পনামন্ত্রী আব্দুস সালাম।

মন্ত্রী বলেন, “বিভিন্ন মাধ্যমে পরিবেশিত সংবাদ এবং আবহাওয়াবিদদের মতে বৃষ্টির ধারা দেখে প্রধানমন্ত্রী ধারণা করছেন, এ বছর দেশে বন্যা হতে পারে।

“আমাদের দেশ বন্যাপ্রবণ। তাই তিনি (প্রধানমন্ত্রী) আমাদের সবাইকে বলেছেন প্রস্তুত থাকতে। যদি বন্যা হয়েই যায়, তাহলে আমরা যেন প্রস্তুতি অনুযায়ী যথাসময়ে কাজ করতে পারি।”    

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত পরিকল্পনা সচিব সত্যজিত কর্মকার এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, উজানে যেভাবে বৃষ্টি বাড়ছে, তার একটা ইফেক্ট আমাদের ওপরে পড়বে। আগস্টে একটা বন্যার আশঙ্কা করছেন তিনি।”

সচিব বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর বার্তা হচ্ছে, বন্যার জন্য আমরা যেন প্রস্তুতি নিয়ে রাখি। দেশের মানুষকে রক্ষা করার জন্য আমাদেরকে আগে থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত