কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এক মাসের বেশি ব্যাংকের লেনদেন ছিল তলানিতে। তাছাড়া অভ্যুত্থানে টানা ১৫ বছর দেশ শাসন করা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটলে দলটির প্রভাবশালী অনেক নেতার ব্যবসা-বাণিজ্যও থমকে যায়। এতে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে নেওয়া তাদের ঋণের টাকাও আটকে যায়। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিলেও ব্যবসায়িক পরিবেশ ও আস্থা এখনও পুরোপুরি ফেরেনি। এরপরও বছরজুড়ে কিছু ব্যাংক ভালো পরিচালন মুনাফা করেছে বলে তথ্য মিলছে।
অথচ পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কয়েকটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর হাতে থাকা ডজনখানেক ব্যাংক থেকে নামে বেনামে ঋণ নিয়ে তা পাচার করার ফলে ব্যাংকগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে বলে তথ্য বের হলে গোটা ব্যাংক খাত ঘিরেই এক ধরনের শঙ্কা তৈরি হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নরও জানান, দেশের ১০-১২টি ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে বসে আছে।
এমন পরিস্থিতিতেও ২০২৪ সালে কিছু ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। আওয়ামী লীগের সরকার পতনের পর যেখানে পুরো ব্যাংক খাত নিয়েই তৈরি হয়েছিল শঙ্কা, সেখানে বছর শেষে কিছু ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় কীভাবে এত প্রবৃদ্ধি হলো?
ব্যাংক নির্বাহীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুর্বল ব্যাংকগুলোর গ্রাহকরা সবল ব্যাংকে চলে আসায় এই ব্যাংকগুলো তাদের প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি আমানত সংগ্রহ করতে পেরেছে। এর মধ্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ থেকে দফায় দফায় বাড়িয়ে ১৬ শতাংশে উন্নীত করায় আয় বেড়েছে ব্যাংকগুলোর। আবার কিছু ব্যাংকে টাকা তোলার হিড়িক পড়লে ওই ব্যাংকগুলোকে অন্য ব্যাংক থেকে নগদ টাকা ধার করতে হয়। ফলে এ থেকেও ব্যাংকগুলো বাড়তি আয় করতে পেরেছে।
বিদায়ী বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব ১ জানুয়ারির মধ্যে চূড়ান্ত করেছে দেশের বেশিরভাগ ব্যাংক। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে প্রায় ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে ব্র্যাক ব্যাংক। ২০২৩ সালে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল ১ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকা। মুনাফায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭২ দশমিক ২৯ শতাংশ।
২০২৪ সালে ২ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে পূবালী ব্যাংক, আগের বছর যা ছিল ১ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা। মুনাফায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫১ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
গত আগস্টের পর থেকে আমানতে রেকর্ড প্রবৃদ্ধির খবর দিচ্ছিল দি সিটি ব্যাংক। বছর শেষে দেখা যায়, ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফায় আগের বছরের তুলনায় ৬৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ২০২৩ সালে বেসরকারি এই ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ছিল ১ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা, যা ২০২৪ সালে বেড়ে ২ হাজার ২৮৭ কোটি টাকায় উঠেছে। ব্যাংকটির ইতিহাসে এত বেশি পরিচালন মুনাফা আগে কখনও হয়নি।
পরিচালন মুনাফায় ৬১ দশমিক ৭১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের। ২০২৪ সালে ব্যাংকটি ২ হাজার ২৮৫ কোটি টাকার পরিচালন মুনাফা করেছে। ২০২৩ সালে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা ছিল ১ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ব্যাংক এশিয়া ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, ইস্টার্ন ব্যাংক ১ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা, প্রাইম ব্যাংক ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক (এমটিবি) ১ হাজার ১১০ কোটি টাকা, শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংক ১ হাজার ৫০ কোটি টাকা, এক্সিম ব্যাংক ৯৭৫ কোটি টাকা, প্রিমিয়ার ব্যাংক ৮৫০ কোটি টাকা, ওয়ান ব্যাংক ৮৩০ কোটি টাকা, মার্কেন্টাইল ব্যাংক ৬৪৪ কোটি টাকা ও চতুর্থ প্রজন্মের মেঘনা ব্যাংক ২০৪ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে।
ব্যাংকগুলোর মধ্যে কেবল প্রিমিয়ার ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা আগের বছরের তুলনায় কিছুটা কমেছে। বাকি ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা আগের বছরের থেকে বেড়েছে।
এদিকে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে সোনালী ব্যাংক আলোচিত বছরে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছে বলে জানা গেছে। রূপালী ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা হয়েছে ৫৭৫ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে ব্যাংকটি ৫৬০ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করেছিল।
বুধবার সন্ধ্যা নাগাদ কিছু ব্যাংকের ২০২৪ সালের হিসাব-নিকাশ চূড়ান্ত না হওয়ায় সব ব্যাংকের পরিচালন মুনাফার তথ্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
প্রসঙ্গত, পরিচালন মুনাফা ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা নয়। আয় থেকে ব্যয় বাদ দিয়ে যে মুনাফা থাকে সেটিকেই বলা হয় পরিচালন মুনাফা। পরিচালন মুনাফা থেকে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ও অন্যান্য ঝুঁকিবাহিত সম্পদের বিপরীতে প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) সংরক্ষণ এবং সরকারকে কর পরিশোধ করতে হয়। প্রভিশন ও কর-পরবর্তী যে মুনাফা অবশিষ্ট থাকবে তা ব্যাংকের প্রকৃত বা নিট মুনাফা।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা প্রকাশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কিছু বিধি-নিষেধ রয়েছে। এ কারণে ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরীণ সূত্র থেকে এই মুনাফার তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল ব্যাংক খাতে লুটপাটের। ২০১৭ সালে এস আলম গ্রুপ ইসলামী ব্যাংক নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর থেকে ব্যাংক দখলের এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিল। এই সময়ে দেশের ব্যাংক খাত থেকে অন্তত দুই লাখ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ রয়েছে আওয়ামী ঘনিষ্ট কয়েকটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। সুশাসনের অভাবে এক ডজনের বেশি ব্যাংক নাজুক হয়ে পড়ে।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশের ব্যাংক খাত সংস্কারের উদ্যোগ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আহসান এইচ মনসুর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব নেওয়ার পর দেশের বেসরকারি খাতের ১২টি ব্যাংকের পর্ষদ ভেঙে দেওয়া হয়। পরিবর্তন আসে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর পর্ষদ ও ব্যবস্থাপনায়।
এমন পরিস্থিতিতে আস্থাহীনতা থেকে দুর্বল ব্যাংকগুলোর গ্রাহকরা আমানত তুলে নিতে শাখাগুলোতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। তবে বেশিরভাগ ব্যাংকই গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী টাকা ফেরত দিতে পারেনি। ওই পরিস্থিতি মোকাবিলায় দুর্বল ব্যাংকগুলোকে টিকিয়ে রাখতে টাকা ছাপিয়ে ধার দেওয়ার উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
ব্যাংক নির্বাহীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাতে নগদ টাকা বেশি থাকা ব্যাংকগুলোই পরিচালন মুনাফার দিক থেকে এগিয়ে আছে। এই ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগের প্রধান খাত ছিল সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ড। তাছাড়া ঋণের বিপরীতে ১৫-১৬ শতাংশ সুদ সবল ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফায় গতি এনেছে বলে মনে করছেন তারা।
শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোসলেহ উদ্দীন আহমেদ সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “প্রধানত তিনটি কারণে পরিচালন মুনাফা বেড়েছে। প্রথমত সুদের হার বৃদ্ধি, ৯ শতাংশ থেকে ১৬ শতাংশ। দুই, বিদেশি মুদ্রার দর ছিল ঊর্ধ্বমুখী। ফলে যারা আগে ডলার কিনে রাখতে পেরেছে, রেমিটেন্স ও ডলার কেনাবেচা থেকে তারা ভালো আয় করতে পেরেছে।
“তৃতীয় কারণটি হলে, গত বছর বেশ কয়েকটি ব্যাংকের দুর্বল হয়ে পড়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে। এই ব্যাংকগুলোর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আমানত অন্য সবল ব্যাংকে চলে যায়। ফলে ওই ব্যাংকগুলোর তারল্য বেড়েছে। তাছাড়া গত বছর সরকার অনেক বেশি ঋণ নিয়েছিল ব্যাংক খাত থেকে। এর বিরপীতেও ব্যাংকগুলো ভালো আয় করেছে।”
দি সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) ভাইস চেয়ারম্যান মাসরুর আরেফিন বলেন, সবল ব্যাংকগুলোর মুনাফা ভালো হওয়ারই কথা। কারণ এই ব্যাংকগুলো কিছুটা কম সুদহারে আমানত পেয়েছে। দুর্বল ব্যাংক তুলনামূলক বেশি সুদ অফার করেও আমানত ধরে রাখতে পারেনি। আবার এই বছরেই ঋণের সুদহারের ঊর্ধ্বসীমা তুলে দেওয়ায় ঋণ ও বিনিয়োগ থেকে ভালো আয় করেছে ব্যাংকগুলো।
তিনি জানান, সবল ব্যাংকগুলোর মোট সুদ আয়ের ৬০-৭০ শতাংশ আসছে ঋণ থেকে। ২০ শতাংশের মতো এসেছে সরকারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগ থেকে। বাকিটা আন্তঃব্যাংক টাকা ধার দিয়ে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির কারণে ব্যাংক ঋণের পাশাপাশি সরকারি ট্রেজারি বিল-বন্ডের সুদহারও গত দুই বছর ধরে বেশ চড়া। চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত স্বল্পমেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহারও ১১-১২ শতাংশ। এ কারণে ব্যাংকগুলো বেসরকারি খাতকে ঋণ না দিয়ে সরকারকে ঋণ দিতে বেশি উৎসাহ দেখাচ্ছে।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের এমডি সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “হাতে পর্যাপ্ত তারল্য থাকা ব্যাংকগুলো ট্রেজারি বিল-বন্ডে বিনিয়োগ করে ভালো মুনাফা পেয়েছে। বিল-বন্ডে এখন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকেরও প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ আছে। কিছু ব্যাংকের বিল-বন্ডে বিনিয়োগ আমাদের চেয়ে দুই-তিন গুণ বেশি। এ কারণে ওই ব্যাংকগুলোর পরিচালন মুনাফা বেড়েছে।”