দেশের অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে বড় ভূমিকা রাখা চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ২০২৪ সালে পণ্যবোঝাই কন্টেইনার উঠানামার নতুন রেকর্ড গড়ার কথা বলেছে, যদিও আগের বছরের চেয়ে ২৩৬টি কন্টেইনার জাহাজ কম ভিড়েছে।
জাহাজ কম আসার পরও দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরটি কীভাবে কন্টেইনার উঠানামায় রেকর্ড গড়ল, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে সংশ্লিষ্ট অনেকে।
চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্যই বলছে, ২০২১ সালের পর ২০২৪ সালে সবচেয়ে কম জাহাজ ভিড়েছে বন্দরটিতে। ২০২১ সালে পণ্যবাহী জাহাজ বন্দরে ভিড়েছিল ৪,২০৯টি; ২০২৩ সালে ভিড়েছিল ৪,১০৩টি। আর ২০২৪ সালে ভিড়েছে ৩,৮৬৭টি কন্টেইনার জাহাজ। আগের বছরের তুলনায় কন্টেইনার জাহাজ আসা কমেছে ২৩৬টি; আর শতাংশের হিসাবে কমেছে সোয়া ৬ শতাংশ।
তবে চট্টগ্রাম বন্দর ২০২৪ সালে কন্টেইনার উঠানামার যে প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে, তা ৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ। ফলে ২৩৬টি জাহাজ কম ভেড়ার পরও এবার এত প্রবৃদ্ধি কীভাবে হলো বা কন্টেইনার উঠানামায় রেকর্ড কীভাবে গড়ল—সেই প্রশ্ন আলোচনায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
বন্দর কর্তৃপক্ষের যুক্তি হচ্ছে, আগের বছরের তুলনায় ২০২৪ সালে বড় আকারের জাহাজ বেশি ভিড়েছে, একইসঙ্গে এসব জাহাজে সর্বোচচ পরিমাণ কন্টেইনার বোঝাই করা হয়েছে। এতে কম জাহাজ দিয়ে বেশি পণ্য পরিবহন হয়েছে।
বন্দর ব্যবহারকারী অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহনে জাহাজের মেইন লাইন (এমএলও) অপারেটররা যে হিসাব করে তার সঙ্গে বন্দরের তথ্যের বিরাট ফারাক আছে। আবার চট্টগ্রাম বন্দর মূলত একটি কন্টেইনারকে চারবার পর্যন্ত উঠানামার হিসাব কষে দেখায়। যেমন একটি কন্টেইনার যদি পাঁনগাও ইনল্যান্ড কন্টেইনার টার্মিনালে যায়, তাহলে দুবার কন্টেইনার উঠানামার হিসাব হয়; আর যদি ফিরে আসে তাহলে দুবার উঠানামার হিসাব করা হয়। অর্থাৎ বিদেশ থেকে একটি কন্টেইনার চট্টগ্রাম বন্দরে নেমে পাঁনগাও গিয়ে আবার ফেরত আসতে চারবার উঠানামার হিসাব করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। কমলাপুর আইসিডিতে ট্রেনে যে কন্টেইনার চট্টগ্রাম থেকে আসা-যাওয়া করে তার উঠানামার হিসাবও হয় চারবার। বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোতে আসা-যাওয়া কন্টেইনারকেও চারবার হিসাব কষে বন্দর। কিন্তু বন্দর থেকে যে আমদানি পণ্যের কন্টেইনার সরাসরি ডেলিভারি হয়, সেটির হিসাব হয় একবার। আবার একই কন্টেইনার রপ্তানি পণ্য নিয়ে আসলে ধরা হয় একবার।
চট্টগ্রাম বন্দর অভিমুখে যেসব দেশি-বিদেশি শিপিং প্রতিষ্ঠান জাহাজ পরিচালনা করে, তাদের হিসাবে, ২০২৪ সালে আমদানি-রপ্তানির খালি কন্টেইনার পরিবহন হয়েছে ২৮ লাখ ২৯ হাজার একক। আর চট্টগ্রাম বন্দর ২০২৪ সালে কন্টেইনার উঠানামার হিসাব দেখাচ্ছে ৩২ লাখ ৭৫ হাজার একক। ফলে দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উঠানামার ফারাক প্রায় সাড়ে চার লাখ একক কন্টেইনার।
জাহাজের এক মেইন লাইন অপারেটর সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমাদের কন্টেইনার পরিবহনের হিসাব একেবারেই নিখুঁত। জাহাজে যত কন্টেইনার এনেছি, সেটি জেটিতে নামানো একবার এবং জাহাজে তুলে নিয়ে যাওয়া আরেকবার। মোট দুবার হ্যান্ডলিং হিসাব করি। সেই কন্টেইনার পাঁনগাতে যাক, আর কলমাপুর আইসিডিতে যাক। এই হিসাবের মধ্যে আমদানিপণ্যভর্তি কন্টেইনার যেমন আছে, রপ্তানি কন্টেইনারও তেমন আছে। তেমনি আছে খালি কন্টেইনার আনার হিসাবও। ফলে সেই হিসাবে কোনও গড়মিল নেই।”
শিপিং লাইনে এমন সব এক্সপার্ট আছেন, যারা এসব বিষয়ে জানেন, তুলনামূলক বিশ্লেষণ করেন। তাদের মতে, বন্দর কর্তৃপক্ষ এফিসিয়েন্ট সার্ভিসের বদলে রেকর্ড গড়ার দিকেই বেশি মনোযোগী থাকে। এতে দ্রুত বাহবা নেওয়া যায়, নিজেদের প্রকাশের বেশি সুযোগ থাকে। আবার ৩০ লাখের বেশি কন্টেইনার উঠানামা দেখানো গেলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ইনসেনটিভের বিষয় থাকে।
সি কম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমীরুল হক সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “রেকর্ড গড়ার দিকে (বন্দর কর্তৃপক্ষ) অনেক বছর মনযোগ দিয়েছে। এখন কত দ্রুত সার্ভিস দেওয়া যায় বন্দরের উচিত সেদিকেই বেশি মনযোগী হওয়া।
“কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস কতটা কমানো যায়, সেদিকেই মূলত নজর দিয়ে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। এটা করতে পারলে দেশের অর্থনীতি লাভবান হবে। আর ভালো সার্ভিস দিতে গিয়ে প্রতিবছরই নতুন রেকর্ড গড়বে। রেকর্ডের পেছনে দৌঁড়াতে হবে না।”
চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার উঠানামার ৬৪ শতাংশ হয়েছে নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) ও চিটাগাং কন্টেইনার টার্মিনাল (সিসিটি)—এই দুটি টার্মিনালে। দুটি টার্মিনালই এখন সক্ষমতার বেশি পণ্য উঠানামা করছে। বন্দরে আসা সবচেয়ে বড় জাহাজ ভেড়ে এই দুটি টার্মিনালে; সবচেয়ে দ্রুতগতির পণ্য উঠানামা হয়ও এই দুটিতে। প্রতিবছর কন্টেইনার উঠানামায় এনসিটি-সিসিটির নির্ভরতা বাড়ছে। কিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত নিলে এসব টার্মিনালেই আরও দক্ষতা বাড়ানোর সুযোগ আছে; আছে পণ্য উঠানামার পরিমাণ বাড়ানোর সুযোগ।
এই দুটি টার্মিনাল পরিচালনা করছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার রুহুল আমিন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “জেটিতে যখন একটি জাহাজ ভেড়ে তখন ১২-১৬ ঘণ্টার মধ্যেই আমরা আমদানি কন্টেইনার নামিয়ে ফেলি। কিন্তু রপ্তানি কন্টেইনার বোঝাই করতেই বেশি সময় লাগে। রপ্তানিকারকদের ‘কাট অব টাইম’ যদি সঠিকভাবে মেইনটেইন করা হতো, তাহলে ৭২ ঘণ্টায় ছাড়া জাহাজ ৪৮ ঘণ্টায় ছেড়ে যেতে পারতো।
“অর্থাৎ একটি জাহাজে ২৪ ঘণ্টা সাশ্রয় হতো। আর সাশ্রয়ী সময়ে আরও নতুন জাহাজ ভেড়াতে পারতাম। ফলে একই সক্ষমতা দিয়ে আমরা বেশি কন্টেইনার উঠানামা করাতে পারতাম।”
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কী বলছে
২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে ২৩৬টি জাহাজ কম আসার পর ২ লাখ ২৪ হাজার একক কন্টেইনার বাড়তি উঠানামা হলো কীভাবে—এ প্রশ্নের জবাবে বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিবহন বিভাগ বলছে, দুই কারণে জাহাজ কম আসার পরও কন্টেইনার উঠানামার রেকর্ড হয়েছে। তুলনামূলক বড় জাহাজ ভিড়েছে এবং একই জাহাজে বেশি পণ্য পরিবহন হয়েছে। পাশাপাশি ভারত থেকে ছোট জাহাজে পণ্য আসার পরিমাণও কমেছে।
বিশ্বের বিভিন্ন বন্দর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে ৯৮টি কন্টেইনার জাহাজ চলাচলের অনুমতি আছে। এরমধ্যে ৯০টির মতো জাহাজ নিয়মিত চলাচল করে। আগে ১৫০০ থেকে ১৮০০ একক কন্টেইনার পরিবহন সক্ষমতার জাহাজ বেশ ছিল। এখন ২০০০-২২০০ সক্ষমতার কন্টেইনার জাহাজ বেশি আসছে। ২৫০০ একক কন্টেইনার ধারণ ক্ষমতার জাহাজ আসছে চট্টগ্রাম বন্দর জেটিতে।
বন্দরের পরিবহন বিভাগের প্রধান এনামুল করিম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমরা বড় জাহাজ জেটিতে আনতে উৎসাহিত করি, নতুন জাহাজ চলাচলের অনুমোদনের ক্ষেত্রে বড় জাহাজকে প্রাধান্য দিই। এর ফলে দেখা গেছে ২০০০ একক ধারণ ক্ষমতার জাহাজ আগে ছিল ২-৩টি, এখন বেড়ে হয়েছে ১০টি। ২০০০-২৫০০ একক ধারণ ক্ষমতার জাহাজ বেড়ে হয়েছে ১০টি। এখন ২৭০০-২৮০০ একক ধারণ ক্ষমতার জাহাজ আসছে পণ্য নিয়ে।
“বিভিন্ন জাহাজের মেইন লাইন অপারেটরদের মধ্যে ‘কমন ক্যারিয়ান’ এগ্রিমেন্ট নিয়ে আমরা কড়াকড়ি করেছি। ফলে এক জাহাজ অন্য ক্যারিয়ারের পণ্য পরিবহন করছে। এর ফলে সব জাহাজই ফুল লোড বা পূর্ণ সক্ষমতা নিয়ে চলাচল করছে। এতে জাহাজ কম আসলেও কন্টেইনার উঠানামা বেশি হয়েছে। ২০২৫ সালে দেখবেন আরও কম জাহাজ আসবে, কিন্তু কন্টেইনার উঠানামা আরও বাড়বে।”