জাপানি প্রবাদ, ‘দ্য নেইল দ্যাট স্টিক্স আউট গেটস হ্যামার্ড ডাউন’ কথাটি সম্পর্কের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার প্রক্রিয়া হিসেবে বলা হয়ে থাকে। প্রবাদটি দিয়ে বোঝানো হয়, সম্পর্কের অঙ্গীকার বজায় রাখতে কিছু বিষয় চাপা দিয়ে দিতে হয়। এই চাপা দেওয়ার অস্ত্র হিসেবেই মানুষ ‘হোয়াইট লাই’ বা সাদা মিথ্যা ব্যবহার করে। মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগের এক জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ দিক এটি।
ছোটবেলায় মা বলতেন, শাক-সবজি খেলে সুপারম্যান, স্পাইডারম্যানের মতো হওয়া যায়। কিংবা ফল খেলে উজবেকিস্তানের পরি এসে নতুন খেলনা দিয়ে যায়। মা নিরেট মিথ্যা বলতেন, কিন্তু যদি না বলতেন, তাহলে হয়তো জোর করে সবজি এবং ফল খাওয়াতে হতো, যা সন্তানকে সুস্থ রাখতে চাওয়ার উদ্দেশ্যের একদম বিপরীতে যেত। এই ধরনের মিথ্যাই ‘হোয়াইট লাইজ’ নামে পরিচিত
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ‘সাদা মিথ্যা’ প্রায়ই শোনা যায় যেটি সম্পর্কের ক্ষেত্রে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। এই ধরনের মিথ্যা কিছুটা গ্রহণযোগ্য মনে করা হয়, তবে এর নৈতিকতা বিচার এবং সামাজিক পরিণতি নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন আছে।
‘সাদা মিথ্যা’ মূলত এমন একটি মিথ্যা যা অন্যের অনুভূতি রক্ষার জন্য বা সম্পর্কের উন্নতির জন্য বলা হয়।
মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, ৯৫ শতাংশ মানুষ জীবনে কখনো না কখনো সাদা মিথ্যা বলেছে, এবং অধিকাংশ মানুষের মনে হয় এটি ব্যবহার করা নৈতিক, বিশেষ করে যদি অন্যের অনুভূতিকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে এটি হয়। যেমন প্রেমের সম্পর্কে শান্তি বজায় রাখতে প্রিয়জনের কাছে কোনো কিছু গোপন করা কিংবা নিজের ভুল অস্বীকার করে এড়িয়ে যাওয়া।
যদিও এটি সম্পর্কের ওপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে, তবুও মানুষ এটিকে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে। ২০১৯ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণা অনুযায়ী, সাদা মিথ্যা বলার ফলে সম্পর্কের মানসিকতা এবং বিশ্বাসকে বিভ্রান্ত করে। বিশেষত, সম্পর্কের ভিত্তি যদি সাদা মিথ্যার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, তবে তা ভবিষ্যতে বিশ্বাসের সংকট সৃষ্টি করতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, সম্পর্কের মধ্যে যত বেশি সাদা মিথ্যা বলা হবে, তত বেশি সেটি মূল সমস্যাগুলোর ওপর পর্দা দেবে এবং সম্পর্কের মাঝখানে ক্ষতিকর আড়াল তৈরি করবে। শিশুদের মানসিক বিকাশেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ‘হোয়াইট লাইজ’ তখন বিপরীতমুখী হয়ে ওঠে, যখন শিশুদের মধ্যে আত্মসচেতনতা জন্ম নেয় এবং তারা মিথ্যা শনাক্ত করতে শেখে। তারা তখন বুঝতে পারে যে, পরিস্থিতিকে ভিত্তি করে মিথ্যা বলা যায়, কারণ তারা দেখে যে বড়রা তাদের নিত্যদিনই মিথ্যা বলছে।
প্যাথলজিক্যাল মিথ্যাবাদী এবং সাদা মিথ্যাবাদী
যারা সহসাই মিথ্যা বলে এবং নিজেদের মিথ্যা এক পর্যায়ে সত্য ভেবে বিশ্বাস করতে থাকে তাদেরকে মনস্তাত্ত্বিক ভাষায় প্যাথলজিক্যাল মিথ্যেবাদী বলা হয়। তাদের ক্ষেত্রে সাদা মিথ্যা অনেকটাই আলাদা। প্যাথলজিক্যাল মিথ্যেবাদীরা প্রায়ই নিজেদেরকে এবং অন্যদেরকে ঠকানোর উদ্দেশ্যে মিথ্যা বলে। তাদের এই আচরণটি সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে গুরুতর সমস্যা তৈরি করতে পারে, কারণ তারা পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্যতা হারায় এবং কর্মস্থলে কিংবা ব্যক্তিগত সম্পর্কের মধ্যে তাদের ওপর আস্থা ক্ষীণ হয়ে পড়ে। এর বিপরীতে, সাদা মিথ্যাবাদীরা শুধু অন্যের অনুভূতি রক্ষার উদ্দেশ্যে মিথ্যা বলে, যদিও কখনো কখনো এতে সমস্যার সৃষ্টি হয়, কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য সাধারণত ইতিবাচক থাকে।
যেমন, কেউ যদি বলে ‘তুমি অনেক প্রতিভাবান’, এ কথা সত্যি নাও হতে পারে, তবে সেটি কম আত্মবিশ্বাসী মানুষের জন্য ইতিবাচক সান্ত্বনা হতে পারে। কিন্তু একজন প্যাথলজিক্যাল মিথ্যেবাদী যদি বলেন ‘আমি তোমার প্রতিভায় মুগ্ধ’, তখন এটি সম্পর্কের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ সে কোনো উদ্দেশ্য প্রতিষ্ঠার জন্য মিথ্যা বলছে।
বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাবে সাদা মিথ্যার ব্যবহার আরও বেড়ে গেছে। কারণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষ নিজেদের সুন্দর মুহূর্তগুলোই তুলে ধরে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ে এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৭০ শতাংশ ব্যবহারকারী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের জীবনকে আদর্শ যাপন হিসেবে উপস্থাপন করে, যা অনেক সময় সাদা মিথ্যার মতোই হয়ে দাঁড়ায়। এতে করে একজন ব্যক্তি অপরের কাছে যে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে চান, সেটি সাদা মিথ্যার মাধ্যমেই সম্ভব হয়।
নৈতিকতা এবং পরিণতি
সাদা মিথ্যা ক্রমাগত সম্পর্কের মধ্যে আস্থা এবং বিশ্বাসের অবক্ষয় ঘটায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, সাদা মিথ্যা বৈবাহিক সম্পর্ক কিংবা সহকর্মীদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদে বিপদজনক হতে পারে। মিথ্যা বলার পরিবর্তে খোলামেলা ও সততার মাধ্যমে সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করা সম্ভব। সামাজিক পরিবর্তন এবং আচরণের ওপর জোর দিয়ে, সত্য এবং সুস্থ সম্পর্কের ভিত্তি নির্মাণ করা প্রয়োজন।
যেকোনো মিথ্যা একটি সাময়িক সমাধান হতে পারে, কিন্তু “স্বচ্ছতা” দীর্ঘ মেয়াদি সম্পর্কের একমাত্র হাতিয়ার।
সামাজিক জীবনের এই জটিল দিকগুলোর আলোকে, আমরা প্রত্যেকেই আমাদের আচরণে পরিবর্তন আনতে পারি এবং সত্যিকারের সম্পর্ক তৈরি করতে পারি। একটা ছোট মিথ্যা কখন ধ্বংসাত্মক পর্যায়ে পৌঁছায় তা অনুমান করা কঠিন। আবার যাকে মিথ্যা বলা হয় সে যখন বিষয়টা বুঝতে শুরু করে তখন তার মনের উপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলে এবং তার মানসিক স্বাস্থ্য অনেকাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। মিথ্যা বুঝতে পারার পর সেই ব্যক্তির মধ্যে বিশ্বাসের সংকট, উদ্বেগ এবং ক্ষোভ দেখা দেয়। মানুষ বিশ্বাস করে যে তারা যা বিশ্বাস করে তা সত্যি।] উদাহরণস্বরূপ, যদি একজন ব্যক্তি তার সঙ্গীকে বলে, ‘তুমি আমার কাছে থেরাপির মতো’, কিন্তু পরবর্তীতে যদি প্রকাশ পায়, সে অন্য এক বা একাধিক মানুষকেও একই কথা বলছে তখন মনে বিশ্বাসহীনতার অনুভূতি সৃষ্টি হতে পারে। মিথ্যাকে সরলীকরণ করলে সেটা সম্পর্কের মধ্যে আস্থা ও নিরাপত্তার অভাব তৈরি করে। সুতরাং, যেকোনও সম্পর্ক সততার ভিত্তিতে নির্মিত হওয়া জরুরি, কারণ মিথ্যা বলার ফলে সৃষ্ট উদ্বেগ মানব সম্পর্কের গভীরতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।