২০২৪ সালকে বলা হচ্ছিল ভোটের বছর। বিশ্বের অন্তত ৮০টি গণতান্ত্রিক দেশে এবার বছরজুড়ে নির্বাচন হয়েছে। এতে অনেক দেশেই ক্ষমতাসীনদের বিদায় নিতে হয়েছে। কয়েকটি দেশে নির্বাচন হলেও তা ছিল নামকেওয়াস্তে।
নির্বাচনের বছর শেষে তাই বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গণতন্ত্র কতটা সুসংহত বা দুর্বল হলো, এমন প্রশ্ন উঠেছে নানা ফোরামে। এনিয়ে সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে গণতন্ত্রের বর্তমান অবস্থার সুলুক সন্ধান করা হয়েছে।
ভারত থেকে ভেনেজুয়েলা, সেনেগাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত এ বছর হলো গণতন্ত্রের পরীক্ষা। কারণ অতীতের যেকোনো বছরের চেয়ে এবার সবচেয়ে বেশি সংখ্যক দেশে নির্বাচন হয়েছে।
নির্বাচনী বছর শুরু হয় জানুয়ারিতে। তখনকার সম্পাদকীয় ও বিশ্লেষণগুলো বৈশ্বিক গুরুতর পরিস্থিতির কথাই স্পষ্ট করে বলছিল। টাইম ম্যাগাজিন একে ‘গণতন্ত্রের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর’ হিসেবে উল্লেখ করে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। আর অন্যরা এটিকে ‘গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা’ বলে ঘোষণা করে। পাশাপাশি প্রশ্নও তোলে যে, এই পরীক্ষা ডিসেম্বর পর্যন্ত অটুট থাকবে তো?
২০২৪ সালে ৮০টির বেশি দেশে বিলিয়ন বিলিয়ন মানুষ ভোট দিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে জনবহুল, কর্তৃত্ববাদী ও দুর্বল কিছু দেশও ছিল। রাশিয়ায় নির্বাচনে মানুষ ভোট দিলেও তা দমন-পীড়নে পূর্ণ ছিল। সেনেগালে নির্বাচন বিলম্বিতের চেষ্টা করায় সরকারের পতন হয়। এল সালভাদরের গ্যাংগুলোর ওপর কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে নির্বাচনে জয় পান দেশটির প্রেসিডেন্ট। আর আরব বসন্তের জন্মস্থান তিউনিসিয়ায় গণতন্ত্রের সংক্ষিপ্ত পরীক্ষা হারিয়ে যায়।
পুরো সময়ে বৈশ্বিক গণতন্ত্রের শক্তি বা দুর্বলতা নিয়ে অনিশ্চয়তা ছিল। বছরের শেষে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন যেন একটি বিশাল প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দাঁড়ায়।
কেমন ছিল গণতন্ত্রের অবস্থা
বছর শুরুর আগেই বিশ্বজুড়ে সতর্ক সংকেত দেখা যাচ্ছিল। আন্তর্জাতিক সংস্থা আইডিয়ার গবেষণা অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে প্রতি পাঁচটি নির্বাচনের একটির ফল কোনো না কোনোভাবে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। একই সময়ে, প্রতি পাঁচটি নির্বাচনের একটিতে পরাজিত প্রার্থীরা প্রকাশ্যে ফলাফল মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। আর প্রতি দশটি নির্বাচনের একটিতে বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করেছে।
এসব বিষয় একসঙ্গে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছিল। ভোটাররা নির্বাচনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং ভোটে অংশগ্রহণের হার কমেছে।
যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে লেবার পার্টি ঐতিহাসিক জয় পায়। বহু বছরের কেলেঙ্কারি ও অকার্যকারিতার ফলে কনজারভেটিভ পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠতা কমে। তবে ভোটারদের উদাসীনতার হার ছিল রেকর্ড পরিমাণে বেশি। ব্রিটিশ প্রাপ্তবয়স্কদের অর্ধেকের কিছু বেশি ভোট দিয়েছেন। এটি সর্বজনীন ভোটাধিকারের যুগে অংশগ্রহণের হিসাবে সবচেয়ে কম বলে বিবেচিত হচ্ছে।
তবে বিশ্বজুড়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ করলে যুক্তরাজ্য একটি ব্যতিক্রম হতে পারে। আইডিয়ার বিশ্লেষণ বলছে, প্রায় ২০ বছর পর প্রথমবারের মতো বিশ্বে গড় ভোটার উপস্থিতি বেড়েছে।
বছরজুড়ে বিশেষজ্ঞরা লক্ষ্য করেন, সফল গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিগুলো—মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সমান অংশগ্রহণের সুযোগ এবং গণমাধ্যম ও কর্পোরেট মালিকানার বৈচিত্র্য—অভূতপূর্ব হুমকির মুখে পড়েছে। গণতন্ত্র হয়তো পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও, তা স্পষ্টতই আক্রমণের শিকার হয়েছে।
অনেকেই গণতন্ত্র আরও দুর্বল হওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছেন। অবশ্য সুসংগঠিত নাগরিক ও বিরোধী দল দেখিয়েছে কীভাবে স্বৈরাচারের পতন ঘটানো সম্ভব।
কর্নেল ইউনিভার্সিটির গ্লোবাল ডেমোক্র্যাসি সেন্টারের পরিচালক র্যাচেল বিটি রিডল বলেন, “আমরা আশার কিছু বাস্তব সম্ভাবনা দেখেছি।” তিনি পশ্চিম আফ্রিকার ‘ক্যু বেল্ট’ এলাকার পাশে থাকা দেশ সেনেগালকে অনুপ্রেরণার উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
মার্চে সেনেগালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় পেছাতে চান। কিন্তু ফল হয় উল্টো। এতে দেশের তরুণ জনগোষ্ঠী উজ্জীবিত হয়ে বিরোধী প্রার্থী বাসিরু দিয়োমায়ে ফায়েকে সমর্থন করে। তিনি অভূতপূর্ব জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসেন।
রিডলের মতে, “নাগরিকরা এবং প্রতিষ্ঠানগুলো বর্তমান সরকারকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছে। কারণ সরকার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে তুলেছিল। সেনেগালে গণতন্ত্র জীবিত আছে নাগরিকদের নির্বাচন সম্পর্কিত নিয়ম মেনে চলার দাবির কারণে।”
কিছু ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা ভোটের বাক্সে নয়, রাস্তায় দেখা গেছে। জানুয়ারিতে বাংলাদেশে পঞ্চমবারের মতো নির্বাচিত হয়েছিলেন শেখ হাসিনা। নির্বাচনে হাজার হাজার বিরোধী নেতা গ্রেপ্তার হন এবং প্রতিবাদকারীদের ওপর পুলিশি সহিংসতা ঘটে।
কিন্তু কয়েক মাস পরে ছাত্রদের আন্দোলনের কারণে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা ছেড়ে দেশত্যাগ করতে হয়। এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল সরকারি চাকরির জন্য কোটা ব্যবস্থার বিরোধিতা থেকে। তবে এটি দ্রুত বিস্তৃত হয়ে গণতন্ত্রের ক্ষয় নিয়ে আন্দোলনে পরিণত হয়।
এখন বাংলাদেশে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো নতুন করে নির্মাণের জন্য দুর্বল গণতান্ত্রিক সংস্কারের কাজ করছে। বিশ্লেষকদের মতে, এই প্রচেষ্টা সফল হতে কয়েক বছর লাগতে পারে।
কর্নেল ইউনিভার্সিটির ২০২৪ সালের বৈশ্বিক গণতন্ত্র রিপোর্টে বলা হয়েছে, “গণতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করা মানুষের বিরুদ্ধে সাধারণত সবচেয়ে ভালো প্রতিক্রিয়া হলো আরও গণতন্ত্র।” বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানিক চ্যানেলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক নাগরিকদের অংশগ্রহণ ও প্রতিনিধিত্ব বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে রিপোর্টে।
ভেনেজুয়েলায় প্রতিবাদ সফল হয়নি। সেখানে আগস্টের নির্বাচনে নিকোলাস মাদুরো জয়ী হলেও, তিনি ভোটের ফল প্রকাশ করেননি। উল্টো বিরোধী নেতাদের ওপর হামলা চালিয়েছেন। ফলে তার ক্ষমতা অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে।
মাদুরোর রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে দীর্ঘদিন সম্পর্ক থাকা দেশগুলো, যেমন ব্রাজিল এবং কলম্বিয়াও নির্বাচনের ফল মেনে নিতে অস্বীকার করেছে। গত মাসে ব্রাজিল ভেনেজুয়েলাকে ব্রিকস জোটে অন্তর্ভুক্ত করার বিরোধিতা করেছে।
গণতন্ত্রের ত্রুটির ‘চিকিৎসা’
২০২৪ সালের একটি বড় বৈশিষ্ট্য ছিল জনগণের প্রতিবাদ। তেমনি ছিল গণতন্ত্রের প্রতি আগ্রহের অভাবও। যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় অর্ধেক ভোটার বলেছেন, গণতন্ত্র সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছে না। আর ৩০টির বেশি আফ্রিকার দেশের একটি জরিপে দেখা গেছে, সেখানে গণতন্ত্রের প্রতি সমর্থন কমেছে।
ইউনিভার্সিটি অব মেলবোর্নের এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক ভেদি হাদিজ বলেন, “মানুষ গণতন্ত্রকে ত্যাগ করেছে বলা উচিত নয়। তবে আমি মনে করি, তারা এখন গণতন্ত্র থেকে কম প্রত্যাশা করে।”
ফেব্রুয়ারিতে ইন্দোনেশিয়ায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন প্রভাবো সুবিয়ান্তো। তিনি একজন সাবেক জেনারেল এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে জড়িত। তার বিরোধীরা দাবি করেন, ভোটের ফল পরিবর্তন করা হয়েছিল অযথা নিয়ম পরিবর্তনের মাধ্যমে। আর বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছিলেন তার উত্তরাধিকার রক্ষায়।
দেশের সাংবিধানিক আদালত এই দাবিগুলো অস্বীকার করেছে। তবে নির্বাচনী প্রক্রিয়া অনেক ভোটারের মনে তিক্ততা তৈরি করতে পারে।
হাদিজের মতে, “ইন্দোনেশিয়ায় অধিকাংশ মানুষ বলবেন যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অন্তত ঠিক আছে। কিন্তু গভীরভাবে প্রশ্ন করা হলে তারা বলবেন, এটি দারিদ্র্য ও সুযোগের বৈষম্য ঠিক করেনি। সাধারণ মানুষের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষার জন্য কিছুই করেনি।”
সফল মডেলগুলো ক্রমশ কমে যাওয়ায় এশিয়ায় এখন গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনকারী হওয়া আরও কঠিন বলেও মনে করেন হাদিজ।
অধিকাংশ প্রধান পশ্চিমা গণতন্ত্রে গণতান্ত্রিক অবস্থার অবক্ষয় হয়েছে। সেখানে ডানপন্থী পপুলিজম, অভিবাসনবিরোধী মনোভাব ও কল্যাণ রাষ্ট্রের পতন বেড়েছে।
এক্ষেত্রে হাদিজের মত, “স্বৈরাচারী শক্তিগুলি গণতন্ত্রের ত্রুটির ‘প্রতিকার’ হিসেবে ‘শক্তিশালী নেতাদের’ দিকে ইঙ্গিত করতে পারে।”
বিলিয়নিয়ারদের বাড়তি প্রভাব
রিডলের মতে, ধনী দেশগুলো একসময় এ ধরনের (ডানপন্থী পপুলিজম, অভিবাসনবিরোধী মনোভাব) প্রভাব মুক্ত ছিল। কিন্তু এখন গণতান্ত্রিক অবক্ষয় ঘটছে।
আর এমনটা হয় ধীরে ধীরে। চলতি প্রেক্ষাপটে সেগুলো চিহ্নিত করা কঠিন। তবে রিডল তার গবেষণায় বলেছেন, এগুলো গণতন্ত্রে মানুষের আস্থা আরও দুর্বল করে দেয়।
এই ‘অবক্ষয়ের’ প্রবণতাগুলো গণতন্ত্রপন্থী প্রার্থীদের একত্রিত হতে উৎসাহিত করেছে। এতে তারা স্বৈরাচারী নেতাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে। এমন ঘটনার উদাহরণ পোল্যান্ড। সেখানে ২০২৩ সালের নির্বাচনে সাবেক ইউরোপীয় কাউন্সিলের সভাপতি ডোনাল্ড টাস্কের নেতৃত্বে একটি বড় জোট জয় পায়। একইভাবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি বিরক্ত রিপাবলিকান ভোটারদের কাছে টানতে চেয়েছিলেন কমলা হ্যারিস।
৫ নভেম্বরের বুথফেরত জরিপ থেকে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাররা ‘গণতন্ত্র’কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে মনে করেছিলেন। কিন্তু এমন একজন প্রার্থীকে নির্বাচিত করা হয়ছে, যাকে এর আগে নির্বাচন প্রভাবিত করার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে এমন কিছু সমস্যা দেখা যাচ্ছে, যা গণতন্ত্রের জন্য বড় বিপদ হতে পারে। বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ, ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়া এবং ধনী ব্যক্তিরা অর্থ দিয়ে ক্ষমতায় পৌঁছাচ্ছে।
২০২৪ সালে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ইলন মাস্ক দেখালেন, কিভাবে বিলিয়নিয়াররা দেশের গণতন্ত্রকে প্রভাবিত করতে পারে। তিনি শুধু ২০০ মিলিয়ন ডলার ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারে ব্যয় করেননি, তিনি প্রচারেও অংশ নিয়েছিলেন। র্যালিতে ছিলেন এবং নিজের সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্সকে এমন একটি জায়গায় পরিণত করেছিলেন, যেখানে ডানপন্থী মতামত বেশি প্রচার পেত।
ইলন মাস্ক যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করে লাভ করেছে। ট্রাম্পের জয়ের পর মাস্কের সম্পদ ৭০ বিলিয়ন ডলার বেড়ে যায়। নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাকে ‘সরকারি কার্যকারিতা বিভাগের’ প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেন। সেখানে মাস্ক নীতিমালা কমানো এবং ফেডারেল এজেন্সিগুলোর পুনর্গঠন নিয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন। আর এগুলো তার নিজ কোম্পানিগুলোর ওপর প্রভাব ফেলে।
অনেক দেশেই এখন এমনটা হচ্ছে। ভারত, থাইল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রে সরকার এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় ধনীদের প্রভাব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। হাদিদের মতে, এই ধনী ব্যক্তিরা ভোটারদের মধ্যে উদাসীনতা সৃষ্টি করতে পারে।
তিনি বলেন, “যখন আপনি ইলন মাস্ককে হাজার হাজার মানুষের সামনে স্টেজে উঠে এমনভাবে দুলতে দেখেন, যেন তিনি কোনো বিশেষ আনন্দ পাচ্ছেন, তখন সাধারণ মানুষ আর কিছুতে আগ্রহ পায় না।”
লিঙ্গ বৈষম্য
২০২৪ সালে ইতিহাসের সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ ভোট দিলেও, রাজনৈতিক দলগুলো নেতৃত্বের ক্ষেত্রে নারী প্রার্থীদের মনোনয়ন কম দিয়েছে। ইন্দোনেশিয়া, ভারত, যুক্তরাজ্য, পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকার শীর্ষ পদগুলোর নির্বাচনে কোনো নারী প্রার্থী ছিল না।
নভেম্বর পর্যন্ত জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মাত্র ১৭টি রাষ্ট্রে নারী সরকার প্রধান ছিলেন। ২০২৩ সালেও এই সংখ্যা ছিল ১৯।
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকদের মতে, নারী রাজনীতিবিদদের পিছিয়ে দেয় লিঙ্গভিত্তিক ধারণা। অনেক ভোটার মনে করেন, তাদের পছন্দের নারী প্রার্থী জয়ী হতে পারবেন না। ২০২০ সালের যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে নারীরা কমলা হ্যারিসকে সমর্থন করেছিলেন। তবে তার চেয়েও বেশি পেয়েছিলেন জো বাইডেন।
মেক্সিকোতে ক্লডিয়া শেইনবাম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। দেশটির সংসদে নারীদের অংশগ্রহণ এখন বিশ্বে শীর্ষস্থানে। এটি লিঙ্গসমতা আইনের ফলে সম্ভব হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক। ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবর পর্যন্ত বিশ্বে আইনসভায় নারীদের গড় অংশগ্রহণ মাত্র ২৭ শতাংশ। এটি গত বছরের তুলনায় মাত্র শূন্য দশমিক ২ শতাংশ বেড়েছে।
জাতিসংঘের মতে, বর্তমান গতিতে শীর্ষ পদে লিঙ্গসমতা অর্জনে আরও ১৩০ বছর সময় লাগবে।
ক্ষমতায় থাকার অভিশাপ
২০২৪ সালকে এমন একটি বছর হিসেবে মনে করা যেতে পারে, যখন ভোটাররা অর্থনৈতিক সমস্যার জন্য ক্ষমতাসীনদের দায়ী করেছেন। এসব সমস্যা অনেক সময় তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল।
নির্বাচনের ফলাফল দেখায়, রাজনীতিতে বাম বা ডান দিকে ঝোঁকার প্রবণতা অতটা ছিল না। বরং যারা ক্ষমতায় ছিলেন, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
ফাইনান্সিয়াল টাইমস জানিয়েছে, ২০২৪ সালে উন্নত বিশ্বের প্রতিটি ক্ষমতাসীন দল তাদের ভোটের অংশ হারিয়েছে। এটি ইতিহাসে প্রথমবার ঘটল।
যুক্তরাজ্য, জাপান, অস্ট্রিয়া ও পর্তুগালের মতো দেশে ভোটাররা জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি ও তা সামলানোর ব্যর্থতায় ক্ষমতাসীনদের শাস্তি দিয়েছেন।
২০২৪ সালের শিক্ষা পাওয়া যাবে সেই পরাজিতদের কাছ থেকে, যারা সম্মানের সঙ্গে নিজেদের পরাজয় মেনে নিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রে উত্তেজনাপূর্ণ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে বোমা হামলার হুমকি, ট্রাম্পকে হত্যাচেষ্টা ও ব্যালট গণনায় পুলিশের স্নাইপারদের পাহারা দিতে দেখা গেছে। এসবের পরও হ্যারিস মঞ্চে উঠে পরাজয় স্বীকার করেন। তিনি বলেন, “ভোটকেন্দ্রে, আদালতে ও জনসমক্ষে লড়াই চলবে।”
তিনি আরও বলেন, “আমেরিকান গণতন্ত্রের মূলনীতি হলো পরাজয়ের ফলাফল মেনে নেওয়া। কয়েক বছর আগে এটি সাধারণ কথা মনে হতো। তবে এখন, দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর অভূতপূর্ব হুমকির কারণে এটি গভীরভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।”
২০২৪ সালের সহিংসতা ও প্রতিশোধ সত্ত্বেও, এমন ঘটনা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে দেখা গেছে। এর উদাহরণ হিসেবে লিথুয়ানিয়া, তাইওয়ান ও ইংল্যান্ডের কথা বলা যেতেই পারে। গত ৫ জুলাই সাবেক ব্রিটিশ চ্যান্সেলর জেরেমি হান্ট জানতেন তার কনজারভেটিভ পার্টি বড় পরাজয়ের মুখে, তবুও তিনি তার আসন ধরে রেখে একটি সমাবেশে বক্তৃতা দেন।
সেখানে তাকে বলতে শোনা যায়, “আমরা খুবই ভাগ্যবান যে এমন দেশে থাকি, যেখানে এই সিদ্ধান্তগুলো বোমা বা গুলি দিয়ে নেওয়া হয় না। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।”