Beta
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪

গরমে কেন জনপ্রিয় হচ্ছে তাজমহলের জালি

তাজমহল।
তাজমহল।
[publishpress_authors_box]

বছর বছর তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। একই সঙ্গে চলছে গরম থেকে বাঁচার বিভিন্ন উপায়ের সন্ধান। দাবদাহে ভবন শীতল রাখাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ নিয়ে পরিবেশবিদ থেকে শুরু করে অনেকেই কাজ করছেন।

কিছু স্থপতি এক্ষেত্রে প্রাচীন ইন্দো-ইসলামিক নকশা ‘জালি’ ব্যবস্থার কথা বলছেন। তাদের মতে, ভবনে জালির ব্যবহার তাপমাত্রা কমাতে সাহায্য করে।

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ভারতের স্থাপত্যে জালি কাঠামোর ব্যবহার হচ্ছে। আধুনিক স্থপতিরাও এখন ভবন শীতল রাখতে পরিবেশবান্ধব ও টেকসই উপায় খুঁজছেন। তাই ছয়-সাতশ’ বছর পুরনো সেই ঐতিহ্যবাহী জালি নকশা আবার জনপ্রিয়তা পাচ্ছে।

উত্তর ভারতের নয়ডার মাইক্রোসফট অফিসে ঢুকলেই জালি নকশার প্রভাব টের পাওয়া যায়। তাজমহলের স্থাপত্যের আদলে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে হাতির দাঁতের সাদা রংয়ের জালি কাঠামোও ব্যবহার করা হয়েছে, যা আছে তাজমহলে। সব মিলে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মিশেলে হয়েছে ভবনটি।

এই জালির ভেতর দিয়ে আসা আলো দৃষ্টিনন্দন আবহ তৈরি করে। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী বাতির পাশাপাশি এই স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য ভাবনের কার্বন নির্গমন কমাতে সাহায্য করে। এ কারণেই ভবনটি যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের সর্বোচ্চ টেকসই সনদ ‘লিড প্ল্যাটিনাম’ পেয়েছে।

‘জালি’ শব্দটির অর্থ জাল। মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় এই শব্দ। ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যে জালি ভারতীয় স্থাপত্যের এক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল। সে সময় মার্বেল বা লাল বেলেপাথরের তৈরি জটিল নকশায় কাটা জালি স্থাপত্যশৈলীর সৌন্দর্য ও কারুশিল্পের এক অপূর্ব নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হতো।

সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে ভারতের আগ্রা শহরে নির্মিত তাজমহলে খোদাই করা জালিগুলো স্থাপত্য কারুশিল্পের এক অনন্য নিদর্শন। জালিগুলো বেশি ও কম ঘন, অবতল ও উত্তল, সরলরেখা ও বক্ররেখা, আলো ও ছায়ার একটি ছন্দোবদ্ধ ধাঁচে তৈরি।

ভারতের রাজপুত শাসকদের হাতে ১৭৯৯ সালে তৈরি হয় ‘হাওয়া মহল’। প্রাসাদটির ৯৫৩টি জানালা ছিল, যেগুলোয় বাতাস প্রবেশের জন্য লাগানো হয় জালি।

ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য সংরক্ষণ ও টেকসই নকশায় বিশেষজ্ঞ যতীন পাণ্ডিয়া। এবিষয়ে তার একাধিক বই রয়েছে। ভারতের ঐতিহাসিক ভবন ও স্থাপত্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তার অবদান অনেক।

বিশ্বখ্যাত এই স্থপতির মতে, জালিগুলো শুধু বায়ু চলাচলের জন্য নয়। বরং সৌন্দর্য, সূর্যালোক থেকে রক্ষা ও গোপনীয়তার জন্যও ব্যবহার করা হয়েছিল।

টেকসই শীতলীকরণ পদ্ধতির খোঁজে স্থপতিরা আরামদায়ক ও কম কার্বন নির্গমন করে- এমন ভবন নির্মাণে এই প্রাচীন নকশাকে ফিরিয়ে আনছেন।

আজকের বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন একটি জরুরি সমস্যা। জলবায়ুর উপর নির্মাণ শিল্পের প্রভাব রয়েছে। ২০১৯ সালে ভবন থেকে নির্গত কার্বন সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছায়, যা বৈশ্বিক কার্বন নির্গমনের প্রায় ৩৮ শতাংশ।

ভবন শীতল রাখতে শীতাতপ ব্যবস্থা, বিশেষ করে এয়ার কন্ডিশনার (এসি) বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ করে। আন্তর্জাতিক আনবিক শক্তি সংস্থার (আইইএ) পরিসংখ্যান বলছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী এসির সংখ্যা বর্তমানের তিন গুণেরও বেশি বাড়বে। এতে অনেক বেশি বিদ্যুৎ লাগবে, যা বর্তমানে ভারত ও চীন মিলে যে বিদ্যুৎ খরচ করে তার সমান হবে।

তীব্র দাবদাহ বিশ্বজুড়েই দীর্ঘায়িত ও প্রবল হচ্ছে। এ বছর তীব্র দাবদাহের কবলে দক্ষিণ এশিয়া ও পশ্চিম আফ্রিকা। এর মধ্যে ভারত আছে, আছে বাংলাদেশও।

দ্রুত নগরায়ন ও ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার মুখোমুখি ভারত এখন টেকসই, পরিচ্ছন্ন ও সাশ্রয়ী শীতলীকরণের উপায় খুঁজছে। দেশটির সরকার ২০১৯ সালে ইন্ডিয়া কুলিং অ্যাকশন প্ল্যান চালু করে। এর লক্ষ্য সব নাগরিকের জন্য টেকসই ও সাশ্রয়ী শীতাতপ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।

এই পরিকল্পনা সাশ্রয়ী শীতলীকরণ ব্যবস্থা গ্রহণের উপর জোর দেওয়ার পাশাপাশি ‘প্যাসিভ কুলিং’ পদ্ধতির উপরও জোর দেয়।

এই পদ্ধতি ভবনের নকশা ও নির্মাণে পরিবর্তন আনার মাধ্যমে স্বাভাবিকভাবে পরিবেশকে শীতল রাখতে সাহায্য করে। একই সঙ্গে জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষায় ও শহরের তাপ কমাতে সাহায্য করে।

ভারতের ব্যাঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী জে. শ্রীনিবাসন বলেন, “দাবদাহ এরই মধ্যে ভারতের জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। আগামী বছরগুলোতে অবস্থা আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে এসির চাহিদা বাড়বে। ফলে প্রচুর তাপও উৎপন্ন হবে।”

দাবদাহের ঝুঁকি মোকাবিলায় ও টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিতে ভবন শীতলীকরণের বিকল্প পদ্ধতি গ্রহণ করা জরুরি। এসির ব্যবহারের বদলে এমন পদ্ধতি বের করতে হবে, যা বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী ও পরিবেশের উপর কম প্রভাব ফেলে।

নতুন দিল্লির জেডইডি ল্যাবের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক সচিন রস্তোগী। নেট জিরো কার্বন নকশার বিশেষজ্ঞ বলা হয় তাকে।

বিখ্যাত এই স্থপতি মনে করেন, টেকসই শীতলীকরণ ও বায়ু চলাচলের জন্য পরিবেশবান্ধব সমাধান হতে পারে জালি।

প্যাসিভ কুলিং ব্যবস্থা ও ভবনকে পরিবেশবান্ধব উপকরণ দিয়ে আচ্ছাদিত করলে ভবনের ভেতরের তাপমাত্রা কম থাকে। এর ফলে এসির প্রয়োজন কমে। প্রায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত জ্বালানি সাশ্রয় করাও সম্ভব এভাবে।

জালি সূর্যরশ্মিকে সরাসরি ভবনে প্রবেশ করতে বাধা দেয়। জালির ছোট ছোট ছিদ্র দিয়ে সূর্যরশ্মি ভবনে প্রবেশের ফলে তাপের মাত্রা কমে। ছিদ্রগুলো মার্বেল বা বেলেপাথরের পুরুত্বের প্রায় সমান আকারে তৈরি করা হয়। এই পুরুত্ব সূর্যের সরাসরি আলোর তীব্রতা কমিয়ে আলোকে বিচ্ছুরিত করে প্রবেশ করায়।

এই শীতলীকরণ বৈশিষ্ট্য ‘ভেনচুরি ইফেক্ট’ নীতির উপর নির্ভর করে, যা এয়ার কন্ডিশনিং ইউনিটের মতো কাজ করে।

ভেনচুরি ইফেক্ট হলো একটি প্রাকৃতিক ঘটনা, যেখানে বাতাস একটি সংকীর্ণ পথের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হলে তার গতি বাড়ে এবং তাপ কমে।

পাণ্ডিয়ার মতে, বাতাস জালির ছিদ্রের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় গতি পায় ও দূরে যেতে পারে। ছোট ছিদ্রের কারণে বাতাস সংকুচিত হয় এবং বের হওয়ার সময় ঠান্ডা হয়ে যায়। আধুনিক শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির উত্থান জালির ব্যবহার কমিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু বৈশ্বিক উষ্ণায়নের উদ্বেগ জালিকে নতুন করে সামনে এনেছে। কারণ ঐতিহ্যবাহী এই স্থাপত্যরীতি শতাব্দীর পর শতব্দী ধরে বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশ মানিয়ে নিয়েছে।

চীনের ফোশানে অবস্থিত টাইমস আই-সিটি কমপ্লেক্স থেকে শুরু করে ফ্রান্সের ক্যাপ দা’আগদের নাকারা হোটেল ও স্পেনের কর্দোভা হাসপাতালের মতো আধুনিক ভবনগুলোতে জালির ব্যবহার হচ্ছে। আর এটি করা হচ্ছে প্রাকৃতিক আলো নিয়ন্ত্রণ, জ্বালানির ব্যবহার কমাতে ও আরামের জন্য।

যুক্তরাজ্যের নটিংহাম ইউনিভার্সিটির টেকসই ভবন নকশা বিভাগের গবেষক আয়েশা বাতুল মনে করেন, বিশ্বব্যাপী টেকসই ভবন নকশায় আগ্রহ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছিদ্রযুক্ত জালির প্রতি আগ্রহ বাড়ছে স্থপতিদের।

আয়েশা বাতুল ২০১৮ সালে তিনটি ভিন্ন ছায়া ব্যবস্থার তুলনামূলক মূল্যায়ন করেছিলেন। এর মধ্যে ছিল জালি, সম্পূর্ণ কাচের ফাসাদ ও ব্রিস-সোলিয়েল ফাসাদ। তিনি দেখতে পান, কাচের ও ব্রিস-সোলিয়েল ফাসাদের চেয়েও বেশি কার্যকর জালি।

কাচের ফাসাদে ভবনের বাইরের দেওয়াল কাচ দিয়ে তৈরি। এতে ভবনের ভেতর গরম হয় বেশি। আর ব্রিস-সোলিয়েলে ব্যবস্থায় ভবনের বাইরের দেওয়ালের উপরে সূর্যরশ্মি প্রতিফলিত করার জন্য ছাতার মতো দেখতে এক প্রকার উপাদান ব্যবহার করা হয়।

বাতুল বলেন, “জালির কারণে ভবনের ভেতরের তাপমাত্রা কম থাকে। এছাড়া ভেতর থেকে বাহির দেখতে চোখের আরামও হয়। ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য পদ্ধতিগুলো থেকে শেখার আছে। তবে এটা যেন অতি সরলীকরণ ও রোমান্টিকভাবে দেখা না হয়।”

আবুধাবির আল-বাহর টাওয়ার।

নতুন দিল্লির পাঞ্জাব কেসরী পত্রিকার সদরদপ্তর ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় জালি স্থাপত্য ও আধুনিক নকশার বৈশিষ্ট্যগুলোর এক অনন্য সংমিশ্রণ। স্টুডিও সিম্বায়োসিসের নকশায় ছিদ্রযুক্ত ফাসাদ ঐতিহ্যবাহী জালির সুবিধা দিয়েছে।

স্টুডিও সিম্বায়োসিসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ব্রিটা নোবেল গুপ্তা বলেন, “নকশার এই ধারণার লক্ষ্য হলো প্রাকৃতিক আলোকে বাড়ানো, তাপ কমানো ও ভবনের ভেতরে বায়ু চলাচল বাড়ানো।”

স্টুডিও সিম্বায়োসিস তাদের এই নকশার জন্য বেশ কয়েকটি পুরস্কার জিতেছে।

নোবেল গুপ্তা বলেন, “জালি পর্দা দুইবার ব্যবহারের ফলে কাচের সামনের বাইরের বাতাসের তাপমাত্রা কমে যায়। ফলে ঠান্ডা বাতাস ভেতরে টেনে নেওয়া হয়, যা চিমনির মতো কাজ করে। এই পদ্ধতি এসির উপর চাপ কমায়।”

পাঞ্জাব কেসরী পত্রিকার সদরদপ্তরের প্রকল্পে ডিজিটাল সিমুলেশন ব্যবহার করে প্রতিটি দেওয়ালের জন্য আলাদা আলাদা ছিদ্রযুক্ত নকশা তৈরি করা হয়েছে, যা দেওয়ালটি কতটা সূর্যের আলো পায় তার উপর নির্ভর করে। এই ভবনে উত্তরমুখী দেওয়ালের অস্বচ্ছতা ৮১ শতাংশ। আর দক্ষিণমুখী দেওয়ালের অস্বচ্ছতা মাত্র ২৭ শতাংশ।

নোবেল গুপ্তা বলেন, “জালি ভবনটিকে স্বাভাবিকভাবে প্রয়োজনীয় আলো সরবরাহ করতে সাহায্য করে। ফলে দিনের বেলায় কোনও কৃত্রিম আলোর প্রয়োজন হয় না।”

ভারতের গুরুগ্রামে অবস্থিত সেন্ট অ্যান্ড্রুজ ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টের শিক্ষার্থীদের আবাসন ব্লক ভবনটি জালি ব্যবহারের আরেকটি উদাহরণ।

ভবনটির একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো ‘স্ট্যাক ইফেক্ট’ নামক একটি পদার্থবিদ্যার নীতির প্রয়োগ। সেখানে জালির প্রতিটি ইটের ঘূর্ণন কোণ সৌর বিকিরণকে কমাতে ডিজাইন করা হয়েছে।

স্ট্যাক ইফেক্ট হলো- একটি প্রাকৃতিক ঘটনা, যা উষ্ণ বাতাস ঠান্ডা বাতাসের তুলনায় হালকা হওয়ার কারণে ঘটে। যখন উষ্ণ বাতাস উঠে যায়, তখন এটি ঠান্ডা বাতাসকে তার স্থান নিতে টেনে নিয়ে যায়। ফলে একটি চিমনির মতো প্রভাব তৈরি হয়।

ভবনটির ডিজাইনার রাস্তোগি বলেন, “জালি তাপ থেকে সুরক্ষা দেয়। সরাসরি সূর্যের আলোর তীব্রতা ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে তাপ বৃদ্ধি কমায়। জালি ব্যবহারের ফলে বিদ্যুৎ বিল উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে এবং এসির প্রয়োজন ৩৫ শতাংশ কমেছে।”

বিশ্বের অন্যান্য দেশও জালি ব্যবস্থার সুবিধা নিচ্ছে। স্পেনের মাদ্রিদে অবস্থিত হিসপাস্যাট স্যাটেলাইট কন্ট্রোল সেন্টার একইভাবে সৌর বিকিরণ নিয়ন্ত্রণ ও ভবনের ভেতরে আরাম বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে নকশা করা হয়েছে। জালির বিভিন্ন ঘনত্ব আলো ফিল্টার করতে ও সূর্যের আলোর তীব্রতা কমাতে সাহায্য করে।

ভবনটির ডিজাইনার ইস্টুডিও হেরেরোসের স্থপতি ও প্রতিষ্ঠাতা অংশীদার জুয়ান হেরেরোস বলেন, “ভবনের বাইরের অংশে ৫ মিলিমিটার পুরু ধাতুর শিট দিয়ে তৈরি একটি দ্বিতীয় স্তর রয়েছে। ছিদ্রের পরিমাণ আলো ও সূর্যের বিকিরণকে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রয়োজন অনুসারে পরিবর্তিত হয়।

“ভবন ও জালির মধ্যে এক মিটার ফাঁকা জায়গা শীতল ও বাতাস চলাচলকারী চেম্বার তৈরি করে। দুটি স্তরের মধ্যে ফাঁকা জায়গাটি বায়ু চলাচলের পথ হিসেবে কাজ করে।”

প্রযুক্তির উন্নতি জালি তৈরির প্রক্রিয়া সহজ করেছে। প্রকৃতি থেকে অনুপ্রাণিত অ-জৈবিক ব্যবস্থা তৈরির বিজ্ঞান বায়োমিমিক্রি থেকে ধারণা নিয়ে জালি ফাসাদ প্রকৃতিতে পাওয়া তাপীয় অভিযোজনের পদ্ধতিগুলি অনুকরণ করে। মানব ত্বকের জালের মতো এই ফাসাদগুলো হাজার হাজার ছিদ্রের মাধ্যমে ভবনগুলোকে শ্বাস নিতে সাহায্য করছে।

আবুধাবির মরুভূমির তীব্র রোদের মধ্যে অবস্থিত আল-বাহর টাওয়ারে জালি ব্যবহার করা হয়েছে। যুক্তরাজ্যের কোম্পানি আইডাস আর্কিটেক্টসের নকশায় তৈরি টাওয়ারে বসানো জালি তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে খোলে ও বন্ধ হয়। আরব বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য নকশা ‘মাশরাবিয়া’ থেকে অণুপ্রাণিত হয়ে আল-বাহর টাওয়ারের নকশায় জালি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

প্রকৌশল পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আরুপের পরিচালক জন লাইল বলেন, “মাশরাবিয়া ব্যবস্থায় ভবনের উপর সরাসরি সূর্যের আলোর মাত্রা ২০ শতাংশ কমিয়ে দেয়। আল-বাহর টাওয়ারের মোটরচালিত জালিগুলো সূর্যের গতি অনুসারে খোলে ও বন্ধ হয়। এতে ভবনের ভেতরে পরোক্ষ প্রাকৃতিক আলো প্রবেশ করতে পারে।

আল-বাহর টাওয়ারের মোটরচালিত জালি ভবন থেকে দুই মিটার দূরত্বে স্থাপন করা হয়েছে। সূর্যের গতির সঙ্গে মিল রেখে এই জালির প্রোগ্রাম করা, যাতে আলোর প্রতিফলন কমানো ও দিনের আলো প্রবেশ করানো যায়। এই নকশার ফলে কার্বন নির্গমন ৪০ শতাংশ কমেছে, এমন দাবি করছে প্রকৌশল পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আরুপ।

আধুনিক স্থাপত্যে জালি নিজের জায়গা করে নিলেও এ ব্যবস্থাকে কিছু চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে। জালির গর্তগুলোর কারণে কীটপতঙ্গ ভবনে প্রবেশ করতে পারে। এই সমস্যা রোধে জালির সামনে কাচ বা কীটপতঙ্গ ধ্বংস হয়- এমন সূক্ষ্ণ জাল ব্যবহার করা যেতে পারে।

জালি নির্মাণের ক্ষেত্রে মার্বেলের মতো ঐতিহ্যবাহী উপকরণের ব্যবহার একদিকে যেমন সময় উপযোগী নয়, তেমনি ব্যয়বহুলও। আর সব জলবায়ুতে একই উপকরণ কার্যকরী নাও হতে পারে। এখন যেসব জালি হচ্ছে তার প্রায় সবই মাঝারি ঘণত্বের ফাইবার বোর্ড, কংক্রিট, ইট, কাঠ, পাথর, পিভিসি বা প্লাস্টার দিয়ে তৈরি।

শুষ্ক অঞ্চলে জালির অধিক কার্যকারিতা ও আর্দ্রতা বাড়াতে উপাদান হিসেবে কাঠ ব্যবহার করা হয়। রাতে বাতাস জালির ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হলে জলীয় বাষ্প ছেড়ে দেয়, যা কাঠের জালি শোষণ করে। আর দিনের বেলা অধিক তাপমাত্রার সময়ে ওই জালিতে শোষিত জলীয় বাষ্প ফের বাতাসে নির্গত হয়। ফলে পরিবেশে আর্দ্রতা বাড়ে।

জলবায়ু অনুসারে জালি তৈরি করতে হয়। এই কারণে জালির নকশা, জ্যামিতি, গর্ত, আকার ও উপাদানগুলো জলবায়ুর উপর ভিত্তি করে নির্বাচন করা উচিত। সব পরিবেশের জন্য এর একক কোনও সমাধান নেই। শুষ্ক জলবায়ুতে জালির ৩০ শতাংশ গর্তের আকার হয় ১০ সেন্টিমিটারের। ফলে গর্তগুলো দিয়ে অনায়াসে বাতাস চলাচল করতে পারে।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত