Beta
শুক্রবার, ১০ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
শুক্রবার, ১০ জানুয়ারি, ২০২৫

বই ছাড়া কেমন চলছে শিক্ষা কার্যক্রম

তবে এবার সব শিক্ষার্থী পায়নি নতুন বই। যারা পেয়েছে তারাও সব বই পায়নি। কয়েকটি বই পেয়েছে শিক্ষার্থীরা। ছবি : হারুন-অর-রশীদ
এবার সব শিক্ষার্থী পায়নি নতুন বই। যারা পেয়েছে তারাও সব বই পায়নি। কয়েকটি বই পেয়েছে শিক্ষার্থীরা। ছবি : হারুন-অর-রশীদ
[publishpress_authors_box]

গত এক দশক শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিনে ‘বই উৎসব’ করে নতুন বই বিতরণ করা হলেও এ বছর হয়নি। এমনকি একজন শিক্ষার্থীও সব বই পায়নি; কেউ কেউ পেয়েছে সর্বোচ্চ তিনটি বই।

সরকারের বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপানো ও বিতরণের দায়িত্বে থাকা জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) বলছে, অর্থের অপচয় রোধে এবার বই উৎসব হয়নি।

তবে সব বই ঠিক কবে নাগাদ সব শিক্ষার্থীর হাতে পৌঁছাবে তা নিয়ে রয়েছে এক ধরনের অনিশ্চয়তা।

গতকাল ৯ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার এক প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, আগামী মাসের মধ্যে পাঠ্যপুস্তক সবাই হাতে পাবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এটি নিয়ে কাজ করছে।

এর দুদিন আগে গত মঙ্গলবার শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, “কবে নাগাদ সবাই সব বই পাবে, এটা আমি জানি না।”

বই ছাপানোর কার্যাদেশ পাওয়া একটি মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী জানিয়েছেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে ছাপার কাজ সম্পন্ন করতে রাত-দিন কাজ করলেও মার্চের আগে সব বইয়ের ছাপার কাজ শেষ হবে না। কারণ, ৪০ কোটির বেশি বই দরকার হলেও বুধবার ৮ জানুয়ারি দুপুর পর্যন্ত প্রস্তুত হয়েছে মাত্র সাড়ে ১১ কোটি বই। অনেক উপজেলায় এখনও একটিও বই পাঠানো হয়নি।

এমন অবস্থায় বই ছাড়া কেমন চলছে শিক্ষা কার্যক্রম– তা জানতে রাজধানী ঢাকার বেশ কয়েকটি স্কুল ঘুরে শিক্ষক-শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলেছে এই প্রতিবেদক।

শিক্ষকরা বলেছেন, কেবল তো শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হলো, মুখে মুখে প্রাথমিক বিষয়গুলো নিয়ে তারা তাদের পাঠদান চালিয়ে যাচ্ছেন।

শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেখা গেছে মিশ্র মনোভাব। কেউ কেউ খুশি- আপাতত পড়তে হচ্ছে না তাই। কেউ কেউ আবার নতুন বই না পাওয়ায় মন খারাপ করে স্কুলেই যাচ্ছে না।

তবে সরকার বছরের শুরুতে সব বই দিতে না পারায় ক্ষোভ জানিয়েছেন অভিভাবকরা।

বই পাওয়া শেষ। এবার ঘরে ফেরার পালা। নারায়ণগঞ্জের আলী আকবর স্কুল থেকে তোলা ছবি : হারুন-অর-রশীদ
বই পাওয়া শেষ। এবার ঘরে ফেরার পালা। নারায়ণগঞ্জের আলী আকবর স্কুল থেকে তোলা ছবি : হারুন-অর-রশীদ

মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে গিয়ে কথা হয় চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী ইয়ামিন মাহিনের সঙ্গে। সে জানায়, শুধু গণিত ও ইংরেজি বই পেয়েছে, বাকি বইগুলো ফটোকপি করে নেবে।

“আমাদের ক্লাস ক্যাপ্টেনের কাছে অন্য বইয়ের ফটোকপি আছে। আমরা ৫০ টাকা করে জমা দিয়েছি। অন্য বইয়ের ফটোকপি পাব”, বলছিল চতুর্থ শ্রেণির এই শিক্ষার্থী।

ইয়ামিন মাহিনের সঙ্গেই ছিল তার মামা ইশতিয়াক রেজা।

তিনি ভাগ্নের কথার সঙ্গে যোগ করেন, “বই দিতে না পারার ব্যর্থতা সরকারের। ফটোকপি সরকার দেবে, নয় স্কুল থেকে দেবে। আর সবচেয়ে বড় কথা– বই থেকে পড়ার একরকম আগ্রহ, ফটোকপি থেকে কি সেই আগ্রহ আসে?”

ক্যান্টনমেন্টে অবস্থিত শৈলপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে দেখা হয় দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী তামান্না সেতুর সঙ্গে। স্কুলে ক্লাস কেমন লাগছে জানতে চাইলে তামান্না বলে, “আমার বই নাই।”

পাশ থেকে তার বাবা সায়েদ হোসেন বলেন, “আর বইলেন না, প্রথমদিন ওর সাথের বন্ধুরা কেউ কেউ বই পেল, সে ক্লাসে যেতে একটু দেরি করছে। সে কোনও বই পায়নি। এই নিয়ে মন খারাপ। স্কুলেও আসতে চায় না। জোর করে নিয়ে আসি।”

এই স্কুলের সামনেই কথা হয় আরেক অভিভাবক নুরুন নাহার বেগমের সঙ্গে। তার ছেলে এই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী।

ক্ষোভ জানিয়ে নুরুন নাহার বেগম বলেন, “বাচ্চারা এমনিতেই পড়তে চায় না, একবার পড়ার ট্র্যাক থেকে বের হয়ে গেলে আবার তাদের ট্র্যাকে ফেরত আনা সহজ বিষয় না। আমার বাচ্চাকে ঘরে পড়তেই বসাতে পারি না, পড়ার কথা বললেই বলে, আমার বই নাই। বই ছাড়া কি পড়ব?”

রাজধানীর প্রায় ১২টি স্কুলে খোঁজ নিয়ে সবখানেই একই অবস্থা দেখা গেছে। কোনও শিক্ষার্থীই সব বই পায়নি। কোথাও অনলাইন থেকে সফট কপি ডাউনলোড করে, কোথাও আবার ফটোকপি দিয়ে চলছে পাঠদান।

তবে এসব স্কুলের শিক্ষকরা বলছেন, এতে করে পাঠদানে সমস্যা হচ্ছে না। বই না পাওয়ায় কিছু কিছু শিক্ষার্থীর মন খারাপ হওয়ার বিষয়টি নিয়েও তারা কাজ করছেন।

কয়েকজন শিক্ষক জানিয়েছেন, নাম প্রকাশ করে মিডিয়াতে বক্তব্য দেওয়ায় নিষেধ আছে তাদের।

তাদের একজন বলেন, “আমরা তো কেবল শুরু করেছি। আমাদের চর্চা আছে, সেইভাবেই আমরা ক্লাস নিচ্ছি। অসুবিধা হচ্ছে না।

“তবে এটাও সত্যি, স্টুডেন্টদের কাছে বইয়ের একটা আলাদা গুরুত্ব আছে। ক্লাসে কেউ বই পেল, কেউ পেল না– এতে তারা অসন্তুষ্ট। আমরা তাদেরকে সেভাবেই আলাদা গুরুত্ব দিয়ে ডিল করার চেষ্টা করছি।”

বছরের প্রথম দিন, শিক্ষাবর্ষেরও প্রথম দিন। এদিন নতুন বই হাতে পেয়ে উচ্ছ্বসিত ছোট ছোট শিক্ষার্থীরা। ছবি হারুন-অর-রশীদ
বছরের প্রথম দিন, শিক্ষাবর্ষেরও প্রথম দিন। এদিন নতুন বই হাতে পেয়ে উচ্ছ্বসিত ছোট ছোট শিক্ষার্থীরা। ছবি হারুন-অর-রশীদ

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “অর্থের অপচয় রোধেই এবার বই উৎসব না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আর এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ তিনটি করে বই তুলে দেওয়া হয়েছে। জুলাই বিপ্লবের একটি প্রভাব আছে এই পুরো বিষয়টিতে।

“তারপরও আমরা আশাবাদী, দ্রুত সময়ের মধ্যে সবার হাতে বই তুলে দেওয়া হবে। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে ইতোমধ্যে অনলাইনে সফট কপি আপলোড করা হয়েছে।”

২০১০ সাল থেকে সরকার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যের পাঠ্যবই দিচ্ছে। এক দশকের বেশি সময় ধরে ১ জানুয়ারি ‘বই উৎসব’ করে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া হয়েছে।

এ বছরের জন্য প্রাক-প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর মিলিয়ে মোট ৪০ কোটি ১৫ লাখ ৬৭ হাজার ২০২টি পাঠ্যবই ছাপানো হচ্ছে। এর মধ্যে মাধ্যমিক স্তরের জন্য ৩০ কোটি ৯৫ লাখ ৪১ হাজার ৪৮৬টি এবং প্রাথমিক স্তরের জন্য ৯ কোটি ১৯ লাখ ৫৪ হাজার ৩৫৫টি বই রয়েছে। এসব বই ছাপানো ও বিতরণে খরচ ধরা হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা।

এনসিটিবি সূত্র বলছে, প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বই ছাপানোর কাজ মোটামুটি হয়েছে। চতুর্থ-পঞ্চম ও মাধ্যমিকের বইগুলোর কাজ পিছিয়ে আছে। তবে দশম শ্রেণির এক কোটি বই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ছাপানো হয়েছে।

ওই সূত্র জানায়, বুধবার ৮ জানুয়ারি দুপুর পর্যন্ত ছাপানোর কাজ শেষ হয়েছে মাত্র সাড়ে ১১ কোটি পাঠ্যবই। এর মধ্যে সাড়ে ৫ কোটি বইয়ের পোস্ট ডেলিভারি ইন্সপেকশন (পিডিআই) শেষ হয়েছে। অর্থাৎ এসব বই উপজেলা পর্যায়ে বিতরণের জন্য ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে।

চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির সাড়ে ১৩ শতাংশ বই ছাপানোসহ সব কাজ শেষ হয়েছে। তবে পিডিআই বাকি।

মাধ্যমিক (মাদ্রাসার ইবতেদায়িসহ) স্তরের মাত্র ১ কোটি ৫০ লাখের মতো বইয়ের পিডিআই হয়েছে। বেশ কয়েকটি লটের দরপত্র প্রক্রিয়া এখনও চলছে।

জানতে চাইলে এনসিটিবির উৎপাদন নিয়ন্ত্রক (ভারপ্রাপ্ত) আবু নাসের টুকু সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আমাদের উপর থেকে নির্দেশনা আছে, প্রায়োরিটিভিত্তিতে বই ছাপানোর কাজ দ্রুত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করার। আমরা সে অনুযায়ী ২৪ ঘণ্টা কাজ করছি।”

এনসিটিবি সূত্র জানায়, আগের বছরগুলোতে বই ছাপানোর দরপত্রের সব প্রক্রিয়া জুনের মধ্যেই শেষ হয়েছে। জুলাই থেকে বই ছাপানোর কাজ শুরু হতো। কিন্তু এবার প্রথম দফায় জুনে বেশিরভাগ লটের দরপত্র সম্পন্ন হয়েছিল। কার্যাদেশ দেওয়া হয়নি। মধ্য জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হলে এ প্রক্রিয়া পিছিয়ে যায়।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিস্থিতি বদলে যায়। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আগের সব দরপত্র প্রক্রিয়া এবং নতুন শিক্ষাক্রম বাতিল করা হয়। পাঠ্যবইয়ে সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন হয়।

এসব কারণে পুনরায় দরপত্র আহ্বান প্রক্রিয়ায় দেরি হয়। সেপ্টেম্বরের শেষ দিক থেকে দরপত্র আহ্বান শুরু হয়। দরপত্র প্রক্রিয়া শেষে অক্টোবর থেকে বিভিন্ন লটের কার্যাদেশ নির্বাচিত মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে দেওয়া হয়।

বই হাতে পেয়েই চলছে তাতে কী আছে তা দেখে নেওয়া। ছবি : হারুন-অর-রশীদ
বই হাতে পেয়েই চলছে তাতে কী আছে তা দেখে নেওয়া। ছবি : হারুন-অর-রশীদবই হাতে পেয়েই চলছে তাতে কী আছে তা দেখে নেওয়া। ছবি : হারুন-অর-রশীদ

এনসিটিবির সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, এবার বছরের প্রথম দিন মাধ্যমিকের সব বই শিক্ষার্থীদের হাতে ‍তুলে দেওয়া সম্ভব হবে না– এমন চিন্তা থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাংলা, গণিত ও ইংরেজি বই ছাপানোসহ সব কাজ শেষ করার তাগিদ দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া মুদ্রণের কাজ পাওয়া কিছু প্রতিষ্ঠান বই ছাপানোর জন্য এনসিটিবির সঙ্গে এখনও চুক্তি করেনি। অনেক দরপত্রের বই সরবরাহের জন্য ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে। সবমিলে একটু সময় লাগবে সব বই পৌঁছে দিতে।

কার্যাদেশ পাওয়া একটি মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বই ছাপানোতে কাগজ ও কালির সংকট প্রতিবছরই থাকে। আমরা নানাভাবে অ্যাডজাস্ট করি।

“এরওপর এ বছর শিক্ষাক্রম পরিবর্তন করে বইগুলো পরিমার্জন, পুনরায় দরপত্র, কার্যাদেশ দেরিতে দেওয়াসহ আনুষঙ্গিক কাজে দেরি করেছে এনসিটিবি। সব মিলিয়ে আমরা পিছিয়ে আছি। রাত-দিন এক করে কাজ করছি। শেষ হতে মার্চ নাগাদ সময় লাগতে পারে।”

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত