ব্যাংকক থেকে দক্ষিণ কোরিয়ার মুয়ান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ১৮১ জন আরোহী নিয়ে রানওয়েতে নামার সময় পাখিদের বিষয়ে পাইলটদের সতর্ক করা হয়েছিল নিয়ন্ত্রণ টাওয়ার থেকে।
এর ঠিক এক মিনিট পর কন্ট্রোল টাওয়ারে মেডে কল (বিপদে পড়ার সঙ্কেত) পাঠান পাইলটরা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। দুজন ক্রু বাদে সব আরোহীই উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে প্রাণ হারান।
দুর্ঘটনাটি ঠিক কী কারণে হয়েছে, এনিয়ে নানা মুনির নানা মত। দুর্ঘটনার পর ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে অবতরণের সময় উড়োজাহাজটির ল্যান্ডিং গিয়ার যে দেখা যাচ্ছিল না, তাতে অনেকে মনে করছেন, পাখির আঘাতের ফলে ল্যান্ডিং গিয়ারে ত্রুটি হয়ে থাকতে পারে। উড়োজাহাজের বৈদ্যুতিক সংযোগে ব্যর্থতার দিকেও আঙ্গুল তোলা হচ্ছে।
অস্ট্রেলিয়ার উড়োজাহাজবিষয়ক সংবাদ সংস্থা এয়ারলাইন রেটিংসের প্রধান সম্পাদক জেফ্রি টমাস মনে করছেন, দক্ষিণ কোরিয়ায় ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনায় পাখির আঘাতের পাশাপাশি অন্যান্য বাস্তবতাও দেখা দরকার।
যেমন, আলামত বলছে, উড়োজাহাজটি বৈদ্যুতিক ব্যর্থতার সম্মুখীন হয়েছিল। কারণ মেডে কল পাঠানোর পর ‘এডিএস-বি ডেটা’ নামে পরিচিত লোকেশন ডেটা নিয়ন্ত্রণ টাওয়ারে পাঠাতে পারেননি পাইলটরা।
টমাস আল জাজিরাকে বলেন, “অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, পাইলটরা একের পর এক ব্যর্থতার সম্মুখীন হচ্ছিলেন। ব্যর্থতাগুলোর ধরন সম্পর্কে আমরা এখনও কিছু জানি না।
“আমরা শুধু জানি, এডিএস-বি ডেটা কাজ করা বন্ধ করেছিল। আর রানওয়েতে নামার সময় পাইলটরা উড়োজাহাজের ডানার ফ্ল্যাপ খুলতে পারেননি। এসব কেন ঘটেছে, আমরা তা জানি না। তবে নিয়ন্ত্রণ টাওয়ার পাখিদের বিষয়ে পাইলটদের সতর্ক করার পরই এসব ঘটে।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, মুয়ান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়েতে নামার সময় উড়োজাহাজটি কেন দুর্ঘটনার শিকার হলো, তা তদন্ত করে বের করতে কয়েক মাস লেগে যাবে।
তদন্তে দক্ষিণ কোরিয়ার কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা করছে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পরিবহন নিরাপত্তা বোর্ড। কারণ দুর্ঘটনার শিকার উড়োজাহাজটি বানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রেরই কোম্পানি বোয়িং।
পাখির আঘাত কতটা মারাত্মক
এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই উড়োজাহাজ চলার সময় পাখিদের উপস্থিতি পাইলটদের নানা বিপত্তিতে ফেলে। তবে এই প্রাণির কারণে গুরুতর দুর্ঘটনার নজির খুব বেশি নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের তথ্য বলছে, কেবল ২০২৩ সালেই দেশটিতে উড়োজাহাজের সঙ্গে পাখিসহ ১৯ হাজার ৪০০টি বন্যপ্রাণির আঘাত লাগে।
এয়ারলাইন রেটিংসের প্রধান সম্পাদক জেফ্রি টমাস জানান, অধিকাংশ আঘাতের ক্ষেত্রে বিমানে বড়জোর ছোটখাটো ক্ষতি হয়। এর বেশি কিছু নয়। এজন্য বছরে দেড় বিলিয়ন ডলারের মতো খরচ হয় বিমান শিল্পের।
তার মতে, বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন ১ লাখ ২০ হাজারের বেশি বিমান চলাচল করে। আকাশে বিমান ওড়াওড়ির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সেগুলোতে পাখির আঘাত লাগা সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার ওপর বিমান যাতে শব্দ কম করে, সেই প্রযুক্তিরও অনেক অগ্রগতি হয়েছে।
বিভিন্ন তথ্য বলছে, পাখির আঘাতে সাধারণত বিমানের তেমন কোনও ক্ষতি হয় না। যেমন ২০২২ সালে যুক্তরাজ্যে প্রায় ১ হাজার ৪০০টি পাখি বিমানে আঘাত করে। তাদের মধ্যে একশটিরও কম পাখি বিমানে কোনও ক্ষতি বা বিমান চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। এই তথ্য দেশটির বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের।
বিমান চলাচলের সময় পাখির আঘাত থেকে সৃষ্ট সমস্যা বিরল হলেও তাদের কারণে যে কয়েকটি গুরুতর দুর্ঘটনা ঘটেছে, তা উড়িয়ে দেওয়ার জো নেই।
উদাহরণ হিসেবে ১৯৯৫ সালের একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়। সে বছর যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় কয়েকটি রাজহাঁসের সঙ্গে ধাক্কা লেগে বিমানবাহিনীর এক ঘাঁটিতে বিধ্বস্ত হয় একটি উড়োজাহাজ। এতে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার ২৪ জন সেনা নিহত হয়।
দুর্ঘটনার জন্য কেবল পাখিই কি দায়ী
দক্ষিণ কোরিয়ায় রবিবার যে দুর্ঘটনা ঘটেছে, তা নিয়ে অস্ট্রেলিয়ার সিকিউ ইউনিভার্সিটির বিমান বিশেষজ্ঞ ডগ ড্রুরির সঙ্গে কথা বলেছে আল জাজিরা।
তিনি বলেন, “কেবল পাখির আঘাতে এমন মারাত্মক দুর্ঘটনা হওয়ার কথা নয়। রানওয়েতে যে পাখি ছিল, তা আগেই পাইলটদের সতর্ক করেছিল নিয়ন্ত্রণ টাওয়ার। উড়োজাহাজটি ছিল বোয়িং ৭৩৭ মডেলের। এই বিমান এতটাই আধুনিক যে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেলেও এটি জরুরি অবতরণ করার ক্ষমতা রাখে।
“দুর্ভাগ্যবশত, রবিবারের ঘটনায় উত্তরের চেয়ে প্রশ্ন বেশি।”
ড্রুরির জিজ্ঞাসা, রানওয়েতে অবতরণের সময় পাইলটরা কেন বিমানের গতি কমাতে পারলেন না; কেন তারা রানওয়ের বিপরীত দিকে বিমানটি নামালেন; কেন তারা নির্ধারিত ‘অবতরণ এলাকা’ পেরিয়ে অবতরণের চেষ্টা করেছিলেন?
তিনি বলেন, “পাইলটদের বিমানের গতি কমানোর যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তার প্রতিফলন দেখা যায়নি। রানওয়েতে কেন আগুন প্রতিরোধী পদার্থ ছড়ানো হয়নি, সেই প্রশ্নও বাদ দেওয়া যাচ্ছে না।
“এছাড়া শটগানের শব্দ নকল করতে পারে এমন লাউডস্পিকার বাজানো উচিত ছিল। সেটা হলে পাখিরা ভয়ে রানওয়ের আশপাশেই ঘেঁষত না। বিশ্বের অন্যান্য বিমানবন্দরের মতো মুয়ান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেও এই ব্যবস্থা থাকা উচিত ছিল।”