Beta
বুধবার, ৩ জুলাই, ২০২৪
Beta
বুধবার, ৩ জুলাই, ২০২৪

গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ কতটা বেড়েছে

গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে লোড শেডিংয়ের পরিমাণ অনেক বেশি।
গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে লোড শেডিংয়ের পরিমাণ অনেক বেশি।
Picture of আসিফ সিদ্দিকী

আসিফ সিদ্দিকী

দেশে গত মাসে যখন তাপপ্রবাহ চলে তখন সব এলাকায় লোড শেডিংয়ের সমবণ্টন হচ্ছে না বলে অভিযোগ তোলে বিভিন্ন এলাকার গরমে অতিষ্ঠ মানুষ। এ নিয়ে সংসদেও সমালোচনা হয়।

এরপর গত ৬ মে মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দেন, শহরে লোড শেডিং দিয়ে গ্রামে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে।

এ নির্দেশনার পর সেদিনই পল্লী বিদ্যুৎ আওতাধীন এলাকায় কোনও লোড শেডিং ছিল না বলে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) জানাচ্ছে। তারা বলছে, গ্রামাঞ্চলে ধারাবাহিকভাবে লোড শেডিং কমেছে। গ্রামে আগের চেয়ে বেশি মাত্রায় বিদ্যুৎ মিলছে।

দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৬ হাজার মেগাওয়াট। এ পর্যন্ত একদিনে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে গত ৩০ এপ্রিল, ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট। দেশে বিদ্যুতের মোট গ্রাহক ৪ কোটি ৭০ লাখ। দেশে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা সাড়ে ১৬ হাজার থেকে ১৭ হাজার মেগাওয়াট; আর এই চাহিদা হয় গ্রীষ্মকালে।

দেশে বর্তমানে বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে চাহিদার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। তবু তাপমাত্রা বাড়লে মানুষকে লোড শেডিংয়ে ভুগতে হয়, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে।

এর কারণ হিসেবে তেল ও অর্থের সংকটের কথা গত ৬ মে জানিয়েছিলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি বলেন, “উৎপাদনে সর্বোচ্চ রেকর্ড, আবার সর্বোচ্চ চাহিদাও আছে। গত ৫০ বছরের ইতিহাসে (এবার) সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল। সেই তাপমাত্রার জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না।

“প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে গ্রামাঞ্চলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ যত দ্রুত পারা যায় ব্যবস্থা করতে। আমরা সেটাই ব্যবস্থা করে এখন একটি ভালো অবস্থায় এসেছি।”

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহের ১৮ মে পর্যন্ত একটি হিসাব দিয়েছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)।

সেই হিসাবে, ১ মে সারাদেশে পল্লী বিদ্যুতের আওতাধীন এলাকায় লোড শেডিং ছিল ৮৩৩ মেগাওয়াট। ৬ মে ছিল শূন্য মেগাওয়াট, অর্থাৎ সেদিন কোনও লোড শিডং ছিল না।

আর ১১ মে লোড শেডিং ছিল ১৮ মেগাওয়াট। ১২ মে সেটি বেড়ে হয় ১১০ মেগাওয়াট, ১৪ মে ৪৭৪ মেগাওয়াট, ১৫ মে ৬৪৩ মেগাওয়াট।

১৬ মে হঠাৎ করে লোড শেডিং আগের অবস্থায় পৌঁছে। সেদিন লোড শেডিং ছিল ১ হাজার ৪৪৬ মেগাওয়াট, পরে ১৭ মে অবশ্য লোড শেডিং কমে ৩৯২ মেগাওয়াটে নেমে আসে।

আর ১৮ মে পর্যন্ত আরইবি যে হিসাব দিয়েছে, তাতে দেখা যায়, লোড শেডিং ১৮ মে ৫৯ মেগাওয়াটে নেমে এসেছে।

বাস্তবে লোড শেডিং পরিস্থিতির ভালো উন্নতি হয়েছে বলে জানাচ্ছে গ্রামাঞ্চলের মানুষ। বিশেষ করে ৬ মের পর থেকে গ্রামে বিদ্যুত সরবরাহ বেড়েছে বলে জানাচ্ছে তারা।

একইসঙ্গে দাবদাহ কমায় ও বৃষ্টি হওয়ায় চাহিদা কমেছে, ফলে গ্রামে স্বস্তি মিলেছে। কিন্তু এই স্বস্তি কতদিন থাকবে, সেটি নিয়ে সন্দিহান গ্রামবাসী।

চকরিয়া পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহক বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবুর রহমান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক নির্দেশনাতেই গ্রামে দুর্বিসহ লোড শেডিং অবস্থার রাতারাতি উন্নতি হয়েছে। ৬ মের পর থেকেই গ্রামে আমরা সহনীয় মাত্রায় লোড শেডিং পাচ্ছি।

“সারাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের চাহিদার সাথে সরবরাহ সামাল দিতে গিয়ে শুধু গ্রামে কেন লোডশেডিং হবে—এই বৈষম্য দূর করার তাগাদা প্রধানমন্ত্রীই অনুভব করেছেন। ফলে আমরা চাই এই সফলতা ধরে রাখুক পল্লী বিদ্যুৎ।”

পল্লী বিদ্যুতের আরেক গ্রাহক অধ্যাপক মোস্তফা জামান খারেচ বলেন, “গ্রামে এখন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচুর শিল্প গড়ে উঠেছে। ফিশিং প্রজেক্ট থেকে শুরু করে পোল্ট্রি খামার। রাইস মিল থেকে শুরু করে খাদ্য প্রক্রিয়াজাত কারখানা গড়ে উঠেছে। এখান থেকে উৎপাদিত পণ্য জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। আর কৃষিনির্ভর অর্থনীতির যে ঝোঁক তৈরি হয়েছে, সেটি অব্যাহত রাখার জন্য হলেও তো গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়ানো উচিত।

“আমরা বলছি না যে, লোড শেডিং হবে না, কিন্তু সেটা যেন যৌক্তিক এবং সহনীয় পর্যায়ে থাকে। শিল্পকে বাঁচানোর পাশাপাশি আবাসিক গ্রাহকদের বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা হোক।”

গ্রামে লোড শেডিং কমার পুরো সুফল মিলছে না

গ্রামে লোড শেডিং কমার তথ্য যাচাই করতে কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলাকে বেছে নেওয়া হয়েছে। সেই উপজেলায় পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহক আছে ৯০ হাজার। গত ৬ মে থেকে সেই উপজেলায় লোডশেডিং অনেকটাই কমেছে।

কিন্তু বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থায় ত্রুটির কারণে এর পুরোপুরি সুফল এলাকার মানুষ ভোগ করতে পারেননি। ফলে লোড শেডিং না থাকার পর নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত ছিল চকরিয়ার গ্রামের বাসিন্দারা।

চকরিয়া কাকারা ইউনিয়নের গ্রাহক মেরিন ইঞ্জিনিয়ার রাশেদুল ইসলাম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “গ্রামে লোড শেডিং পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে, এটা সত্যি। বলতে গেলে সহনীয় পর্যায়ে নেমেছে। এটা ধরে রাখতে হবে। আগে যেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোড শেডিং ছিল, এখন সেখানে ভালোই বিদ্যুৎ মিলছে। কিন্তু লাইন মেরামত, কারিগরি ত্রুটির কথা বলে আমরা সেই সুবিধার পুরোপুরি পাচ্ছি না।”

চকরিয়া উপজেলায় ৯০ গ্রাহকের জন্য পিক আওয়ারে (দিনের সর্বোচ্চ চাহিদার সময়) বিদ্যুৎ চাহিদা থাকে ১৮ মেগাওয়াট। আর অফ পিক আওয়ারে থাকে ১৫ মেগাওয়াট। আর তাপমাত্রা বাড়লে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে ২১ মেগাওয়াটে পৌঁছে।

চকরিয়া পল্লী বিদ্যুতের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার সাদিকুল ইসলাম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “গত ১০/১২ দিন ধরেই আমরা চাহিদার প্রায় সমান বিদ্যুৎ পাচ্ছি। রবিবার (১৯ মে) সরকারি কার্যদিবসে ১৮ মেগাওয়াটের বিপরীতে ১৮ মেগাওয়াট পেয়েছি।

“বুধ (১৫ মে) ও বৃহস্পতিবার (১৬ মে) অবশ্য তাপমাত্রা বাড়ার কারণে লোড শেডিং ছিল। এরপর থেকে এখন স্বাভাবিক হয়ে আসছে। ফলে এখন দেখবেন গ্রাহকরা স্বস্তি পাচ্ছেন।”

তিনি বলেন, “চাহিদার সমান বিদ্যুৎ পেলে অনেক সময় বিদ্যুৎ বন্ধ রাখতে হয়। সেটাকে আমরা লোড শেডিং বলি না। লাইনের সমস্যা, কারিগরি ত্রুটি, রক্ষণাবেক্ষণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মানবসৃষ্ট দুর্যোগের কারণে সেটি ঘটে থাকে। ফলে বিদ্যুৎ পেলেও অনেক সময় আমরা সরবরাহ দিতে পারি না। কাকারার (ইউনিয়ন) ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে।”

পল্লী বিদ্যুতের লোড শেডিং কমেছে

আরইবির হিসাব বলছে, ১ মে সারাদেশে পল্লী বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ৯ হাজার ৫৩৩ মেগাওয়াট। বিপরীতে সরবরাহ হয়েছে ৮ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। বাকি ৮৩৩ মেগাওয়াট লোড শেডিং করতে হয়েছে।

এরপর ২ মে ৭১৮ মেগাওয়াট, ৩ মে ৩৩৩ মেগাওয়াট, ৪ মে ৮৯২ মেগাওয়াট, ৫ মে ৩২ মেগাওয়াট লোড শেডিং করেছে পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ। ৬ মে পল্লী বিদ্যুতে কোনও লোড শেডিং ছিল না।

তবে ৭ মে ৪৪ মেগাওয়াট, ৮ মে ৯ মেগাওয়াট, ৯ মে ১৪ মেগাওয়াট, ১০ মে ৬ মেগাওয়াট ও ১১ মে ১৮ মেগাওয়াট লোড শেডিং হয়।

আর সর্বশেষ ১৮ মে পল্লী বিদ্যুৎ ৫৯ মেগাওয়াট লোড শেডিং দিয়েছে বলে আরইবি দাবি করেছে।

আরইবির হিসাবে, ১৮ মে চাহিদা ছিল ৮ হাজার ২৯৯ মেগাওয়াট, বিপরীতে সরবরাহ ছিল ৮ হাজার ৪০ মেগাওয়াট। তবে ১৫ ও ১৬ মে লোড শেডিং বেড়ে গিয়েছিল। ১৫ মে চাহিদা ছিল ৯ হাজার ৫০৩ মেগাওয়াট, আর সরবরাহ ছিল ৮ হাজার ৮৬০ মেগাওয়াট।

১৬ মে চাহিদা তুঙ্গে উঠে ৯ হাজার ৫৫৪ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়; বিপরীতে সরবরাহ কিন্তু সেভাবে হয়নি। সেদিন সরবরাহ দেওয়া হয়েছিল ৮ হাজার ১০৮ মেগাওয়াট। ফলে সেদিন ১ হাজার ৪৪৬ মেগাওয়াট লোড শেডিং দিতে হয়েছে।

আরইবির হিসাবে, ৭ মে থেকে ১১ মে পর্যন্ত চাহিদার বিপরীতে ৯৯ শতাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহ দেওয়া হয়। ১২ মে ৯৮ শতাংশ, ১৩ মে ৯৭ শতাংশ, ১৪ মে ৯৪ শতাংশ, ১৫ মে  ৯৩ শতাংশ, ১৬ মে ৮৫ শতাংশ, ১৭ মে ৯৫ শতাংশ ও ১৮ মে ৯৯ শতাংশ বিদ্যুৎ চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের সদস্য (বিতরণ ও পরিচালন) দেবাশীষ চক্রবর্তী সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “বিদ্যুতের মোট উৎপাদন বেড়েছে, পাশাপাশি তীব্র দাবদাহ কিছুটা কমায় চাহিদা কমেছে। এর পাশাপাশি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গ্রামে বিদ্যুৎ দেওয়ার নির্দেশনায় সুফল মিলেছে।

“কারণ, আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন করি না। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে, তাদের কাছ থেকে কিনেই আমরা গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ দিই। ফলে চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ কত পাবে, সেটি আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে না।”

১৫ ও ১৬ মে লোড শেডিং বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে দেবাশীষ চক্রবর্তী বলেন, “সেই দুদিন তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় চাহিদা বেড়ে গিয়েছিল; বিপরীতে সরবরাহ কম ছিল। এই কারণে বেশি লোড শেডিং ছিল।”

সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এখন ২০০ থেকে ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ শহর থেকে গ্রামে দেওয়া হচ্ছে; এই কারণে গ্রামের গ্রাহকরা স্বস্তিতে আছেন বলে জানান দেবাশীষ।

তিনি বলেন, “সারাদেশে পল্লী বিদ্যুতের সাড়ে তিন কোটি গ্রাহক বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে। মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৫৮ শতাংশ ব্যবহার করে পল্লী বিদ্যুৎ। আর ৮০ শতাংশ এলাকাজুড়েই পল্লী বিদ্যুৎ সুবিধা দিচ্ছে। আর যেভাবে উৎপাদন বাড়িয়ে সমন্বয় করা হচ্ছে, তাতে গ্রাহকদের এই স্বস্তি আশা করি অব্যাহত থাকবে।”

 

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত