যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দ্বিতীয়বার জয়ী হয়ে হোয়াইট হাউজে প্রত্যাবর্তন ঘটতে যাচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের।
তার এই ফেরাকে কীভাবে দেখছেন ইউরোপীয়রা? ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার ঘটনা কি ইউরোপ মহাদেশের রাজনীতি, বাণিজ্য ও নিরাপত্তায় কোনও প্রভাব ফেলবে?
যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম স্কাই নিউজের সাংবাদিক অ্যাডাম পারসনস মনে করছেন, ট্রাম্পের ক্ষমতাগ্রহণে ইউরোপ প্রভাবিত না হওয়ার কোনও কারণ নেই।
তার মতে, ট্রাম্পের কারণে ইউরোপের রাজনীতি, বাণিজ্য ও নিরাপত্তায় পরিবর্তন ঘটবে এবং এর ফলে এই তিন ক্ষেত্রে নীতি নতুন করে সাজাতে হবে ইউরোপীয় দেশগুলোকে।
নির্বাচনী প্রচারে কেবল নয়, নির্বাচিত হওয়ার পরও ট্রাম্প একাধিকবার বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মতো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ইউক্রেনকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে যাবেন না তিনি, সমর্থনের মাত্রা কমিয়ে ফেলবেন।
পাশাপাশি ইউরোপের দেশগুলোর পণ্যে নতুন করে শুল্ক আরোপ করবেন এবং ন্যাটোভুক্ত ইউরোপের দেশগুলোকে বাধ্য করবেন প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়াতে।
প্রশ্ন হচ্ছে, ট্রাম্প তার কথায় আর কাজে মিল-অমিল কোনটা রাখবেন?
২০১৬ সালে নির্বাচিত হয়ে চার বছর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ট্রাম্প। পরের বার হেরে হোয়াইট হাউজ থেকে বিদায় নিলেও গত বছর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আবার তিনি জেতেন। সোমবার শপথ নেওয়ার মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট হিসাবে নিজের দ্বিতীয় যাত্রার শুরু করবেন তিনি।
প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার পর ট্রাম্প যদি সত্যি সত্যিই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির দিকে বাড়ানো হাত কিছুটা গুটিয়ে আনেন, তাহলে ইউরোপের দেশগুলোকে উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হবে।
তারা হয়ত ইউক্রেনকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে আরও অর্থ সহায়তা দেবে, কিন্তু অস্ত্র? যুক্তরাষ্ট্রের মতো অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র তো তাদের ভাণ্ডারে নেই। সেক্ষেত্রে যুদ্ধে রাশিয়ার সামনে টিকতে পারবে না ইউক্রেন। কারণ এই যুদ্ধে ইউক্রেনের যা কিছু অর্জন, তা সম্ভব হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বানানো অস্ত্র দিয়েই।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়ার আগে-পরে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ দ্রুত বন্ধ করার কথা বলেছিলেন ট্রাম্প। কিন্তু সেটা কীভাবে করবেন, তা খোলাসা করেননি।
টানা তিন বছর যুদ্ধ করে এবং অনেক সেনা হারিয়ে রাশিয়া যদি হঠাৎ দেখে, দুর্বল হয়ে পড়া ইউক্রেনের ওপর আধিপত্য বিস্তার করার মতো জায়গায় সে চলে গেছে, তাহলে রুশরা যুদ্ধ বন্ধের চুক্তিতে এমন শর্ত দিয়ে বসবে, যা গোটা পূর্ব ইউরোপকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে।
এবার আসা যাক ন্যাটো প্রসঙ্গে। সামরিক এই জোটকে সমর্থন দেওয়ার বিষয়ে ট্রাম্পের মধ্যে আগে থেকেই অস্পষ্টতা ছিল। প্রেসিডেন্ট হিসাবে তার দায়িত্ব নেওয়ার পর এমন হতে পারে, ইউরোপ যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে এনে প্রতিরক্ষা খাতে বেশি খরচ করার নীতি গ্রহণ করেছে।
গত নভেম্বরের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর ট্রাম্প বলেছিলেন, ডেনমার্কের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল গ্রিনল্যান্ড কেনা বা দখলের ইচ্ছে তার আছে।
স্বাভাবিকভাবেই এর বিরোধিতা করেছে ডেনমার্ক। দেশটি জানে, ট্রাম্পের এই আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো উভয়কেই তারা পাশে পাবে।
প্রেসিডেন্টের পদে বসার পরপরই চীনসহ কয়েকটি দেশের ওপর আরও শুল্ক আরোপের চিন্তা করছেন ট্রাম্প। ইউরোপের ক্ষেত্রেও কি তিনি একই কাজ করবেন?
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার কমে যাওয়ায় ইউরোপ নিশ্চিতভাবেই চাইবে না, তাদের পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়াক যুক্তরাষ্ট্র।
চীনের সস্তা পণ্য কেনার কারণে ভবিষ্যতে বড় ধরনের সমস্যায় পড়বে ইউরোপীয় দেশগুলো। এসব পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রিও করা যাবে না। এবিষয়ে ট্রাম্পের সুরক্ষাবাদ বৈশ্বিক বাণিজ্যের চেহারাই পাল্টে ফেলবে বলে মনে করছেন স্কাই নিউজের সাংবাদিক অ্যাডাম পারসনস।
এছাড়া নির্বাচন ঘিরে ট্রাম্পের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠা বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ইলন মাস্কের বিভিন্ন প্রযুক্তি কোম্পানি ইউরোপের দেশগুলোর নিয়মকানুনের বিরুদ্ধে যেতে পারে, দেশগুলোকে গুনতে হতে পারে বিলিয়ন বিলিয়ন ইউরো জরিমানা। এই ঘটনাগুলো যে ট্রাম্পের মদদেই ঘটবে, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
তবে ইউরোপের সব দেশের শাসক যে ট্রাম্পের পুনরুত্থানে রাজনীতি, বাণিজ্য ও নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগে আছেন, তা নয়। কেউ কেউ খুশিও।
তাদের মধ্যে আছেন হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর ওরবান ও ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি। প্রথমজন ট্রাম্পের বন্ধু আর পরেরজন ট্রাম্পের তারিফ করেন রাখঢাক না করেই।
ট্রাম্পের কল্যাণে বৈশ্বিক রাজনীতিতে এই দুই সরকারপ্রধানের গুরুত্ব আগামী দিনে আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এদিকে, জার্মানির রক্ষণশীল দল ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন অব জার্মানির নেতা ফ্রেডরিক মের্জ সম্ভবত এ বছরের নির্বাচনে জয়ী হয়ে দেশটির চ্যান্সেলর হবেন।
নির্বাচনে ট্রাম্প জার্মানির কট্টর ডানপন্থি দল অল্টারনেটিভ ফর জার্মানিকে সমর্থন দেবেন। তবে মের্জকে পছন্দ করেন মাস্ক।
অন্যদিকে ইউরোপের রাজনীতিতে এখনও ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা হলেও ট্রাম্প মহাদেশটির সেই নেতাদেরই কাছে রাখবেন, যারা তার ‘মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ এজেন্ডার পক্ষে আছেন।