কোভিড মহামারির কয়েক বছরের মধ্যে এবার নতুন উদ্বেগ হয়ে দেখা দিয়েছে হিউম্যান মেটানিউমোভাইরাস বা এইচএমপিভি। করোনাভাইরাসের মতোই এই ফ্লু ভাইরাস চীন থেকে শুরু করে হংকং, মালয়েশিয়ায় ছড়িয়েছে। পাশের দেশ ভারতেও চারজন রোগী শনাক্ত হওয়ায় বাংলাদেশেও আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।
অনেকেই এর সঙ্গে যোগসূত্র খুঁজছেন করোনাভাইরাসের, যা মহামারি বাঁধিয়ে গোটা বিশ্বের মানুষকে করেছিল ঘরবন্দি। প্রায় কোটি মানুষকে ঠেলে দিয়েছে মৃত্যুর পথে।
এখন এইচএমপিভির সংক্রমণে অনেকের মনে শঙ্কা জাগছে, আবারও কি আসছে আরেকটি মহামারি? আবারও কি দেখতে হবে মৃত্যুর মিছিল?
চিকিৎসকরা বলছেন, এইচএমপিভি করোনাভাইরাসের মতোই শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণ ঘটায়। এই ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির ঠাণ্ডা, সর্দিকাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট, র্যাশ ওঠার মতো লক্ষণ দেখা যায়।
মানবদেহে এইচএমপিভি সংক্রমণ প্রথম শনাক্ত হয় ২০০১ সালে। তবে এর অস্তিত্ব বিশ্বে আগেও ছিল। এর সংক্রমণ মৃদু, প্রাণঘাতী নয়। তবে বৃদ্ধ, যাদের কোমরবিডিটি রয়েছে, যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এবং শিশুদের জন্য এটা জটিল হতে পারে।
ভারতে রোগী পাওয়া গেলেও বাংলাদেশে এ ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং বর্তমান উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “আতঙ্কিত হলে চলবে না; বরং এ নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
“আগেও এই ভাইরাস ছিল, এটা নতুন না, সব দেশেই আছে, বাংলাদেশেও রয়েছে। তাই উদ্বেগের কিছু নেই। অহেতুক আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।”
ভারতে যে চারজন এইচএমপিভি আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছে, তার একজন কলকাতার। এছাড়া কর্ণাটকের বেঙ্গালুরুতে তিন মাস বয়সী এক শিশু চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছে, আট মাস বয়সী অন্য শিশুটিও সেরে ওঠার পথে।
ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, কর্ণাটকের দুই রোগীর কারও বিদেশ ভ্রমণের ইতিহাস নেই এবং সেদেশে ইনফ্লুয়েঞ্জা জাতীয় অসুস্থতা বা মারাত্মক তীব্র শ্বাসযন্ত্রের অসুস্থতার কোনও অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ঘটনাও দেখা যায়নি।
তবে চীনে এইচএমপিভির সংক্রমণ বাড়ছে, বিশেষ করে ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে। যার কারণে চীনের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে জরুরি পদক্ষেপ নিয়েছে; যদিও বেইজিং সরকার এই সংক্রমণকে কোভিড-১৯ এর মতো আরেকটি মহামারির মতো বলে আশঙ্কা করছে না।
এশিয়ার অন্য দেশ মালয়েশিয়ায় ২০২৩ সালে ২২৫টি সংক্রমণের তুলনায় ২০২৪ সালে ৪৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৩২৭টি সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। হংকং, তাইওয়ান এবং কম্বোডিয়াও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।
কোভিড মহামারি চীন থেকে ছড়িয়েছিল বলে এইচএমপিভি নিয়ে বেশি উদ্বেগ তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন ডা. মুশতাক।
এইচএমপিভিকে সাধারণত প্রাণঘাতী বলা হয় না জানিয়ে তিনি বলেন, “তবে যারা বৃদ্ধ, যারা অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদী জটিল রোগে আক্রান্ত, তাদের ক্ষেত্রে বিষয়টি অন্যরকম। যেহেতু তাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের জন্য আরও বেশি সাবধানতা জরুরি। সঙ্গে সাবধান হতে হবে শিশুর বেলাতে।”
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান সহকারী অধ্যাপক ডা. আরিফা আকরাম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “অনেক আগেই এইচএমপিভি শনাক্ত হয় বাংলাদেশে এবং প্রতি বছরই এক কিংবা একাধিক কেইস পাওয়া যায়, তবে সেটি খুব বেশি নয়। সিভিয়ার কেইস এখনও পাওয়া যায়নি।”
লক্ষণ কী
ডা. আরিফা আকরাম সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, হিউম্যান মেটাপনিউমোভাইরাস (এইচএমপিভি) একটি শ্বাসযন্ত্রের ভাইরাস, যা প্যারামিক্সোভিরিডি পরিবারের অর্ন্তগত।
কোভিডের সঙ্গে এইচএমপিভির অনেক ক্ষেত্রেই মিল রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এর লক্ষণ হচ্ছে জ্বর, সর্দি, কাশি, গলা ব্যথা, শ্বাস প্রশ্বাসে সমস্যা ইত্যাদি।
করোনাভাইরাসের মতো এইচএমপিভিও হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়াতে পারে।
ডা. আরিফা বলেন, “এইচএমপিভিতে সংক্রমিত ব্যক্তির থেকে অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, যেটা করোনার সময়ে আমরা দেখেছিলাম।”
আক্রান্ত রোগীর ব্যবহৃত জিনিসের সংস্পর্শে এলেও এর সংক্রমণ ঘটতে পারে।
এটি মূলত শ্বাসতন্ত্রের ওপরের অংশে আক্রমণ করে। এটি কখনও কখনও নিউমোনিয়া, হাঁপানির মতো শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের আকার ধারণ করতে পারে। এই ভাইরাসের সুপ্তিকাল তিন থেকে ছয় দিন।
ডা. আরিফা আকরাম বলেন, “এইচএমপিভিতে আক্রান্তদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অসুস্থতার তীব্রতা কম থাকে। তবে অসুস্থতার তীব্রতা রোগীর উপর নির্ভর করে।”
ল্যানসেট গ্লোবাল হেলথের ২০২১ সালের একটি নিবন্ধের তথ্য অনুযায়ী, তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণে মারা যাওয়া ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের এক শতাংশের মৃত্যুর জন্য এইচএমপিভি দায়ী।
পরীক্ষা পদ্ধতি ও সতর্কতা
ডা. আরিফা আকরাম জানালেন, সাধারণত পিসিআর পরীক্ষায় এই ভাইরাস শনাক্ত করা যায়। নাক বা মুখ থেকে শ্লেষ্মা নিয়ে করা হয় এই পরীক্ষা।
এইচএমপিভি থেকে দূরে থাকতে কোভিড প্রতিরোধের মতোই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দেন ডা. মুশতাক।
“সেই আগের নিয়মেই ফিরে যেতে হবে আমাদের। সবই জানা আছে, কেবল এর থেকে সরে এসেছিলাম। কিন্তু আবার তা শুরু করতে হবে।”
তিনি বলেন, হাত ধোয়া, মাস্ক পরা, জ্বর ও সর্দিকাশি আছে এমন ব্যক্তি থেকে দূরে থাকা, জটিল রোগী হলে সরাসরি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
এইচএমপিভির সংক্রমণে কাশি, জ্বর, নাক বন্ধ হওয়ার মতো ঠান্ডাজনিত যেসব লক্ষণ দেখা যায়, তা সাধারণত দুই থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে নিজে থেকেই সেরে যায়।
গুরুতর ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা সাধারণত লক্ষণ বুঝে তা উপশমের চেষ্টা করে থাকেন। কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা অ্যাসিটামিনোফেন বা আইবুপ্রোফেনের মতো ওভার-দ্য-কাউন্টার ওষুধ ব্যবহার করে লক্ষণ উপশমের চেষ্টা করেন। নাক বন্ধ হওয়ার সমস্যা কমাতে ডিকনজেস্ট্যান্টও ব্যবহার করা হয় অনেক ক্ষেত্রে।
সিওপিডি, অ্যাজমা ও পালমোনারি ফাইব্রোসিস রোগীদের মাঝে সংক্রমণের লক্ষণগুলো গুরুতর আকারে দেখা দিতে পারে এবং শ্বাসকষ্ট ও কাশি নিয়ন্ত্রণের জন্য তাদের ওষুধের প্রয়োজন হতে পারে।
তবে সম্প্রতি দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সাংহাইয়ের একটি হাসপাতালের এক শ্বাসযন্ত্র বিশেষজ্ঞ এইচএমপিভির সংক্রমণের বিরুদ্ধে অ্যান্টিভাইরাল ওষুধের অযথা ব্যবহার সম্পর্কে সতর্ক করেছেন।
সরকারের কী করণীয়
ভারতে সংক্রমিতদের বিদেশ ভ্রমণের ইতিহাস না থাকায় এটি চীন কিংবা মালয়েশিয়ার এইচএমপিভি ধরনই কি না তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে তা নিয়ে গবেষণা চলছে।
ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, “ইনফ্লুয়েঞ্জা সার্ভিলেন্সের সঙ্গে এইচএমপিভিকেও এর আওতায় আনতে পারে সরকার। তখন আসলে এর জিনোম সিকোয়েন্স করা যাবে, এর কোনও পরিবর্তন হচ্ছে কি না এবং তাতে সাধারণ এই ভাইরাসটি মারাত্মক হচ্ছে কি না, সেটাও বোঝা যাবে।”
ডা. আরিফা আকরামও বলেন, “আমাদেরকে যেটা করতে হবে সেটা হলো যে জিনোম সার্ভিসের দিকে খেয়াল রাখতে হবে। করোনাভাইরাস যেমন বারবার চেহারা চেঞ্জ করে এর তীব্রতা বাড়িয়ে দিয়েছিল, আমাদেরকে এটার দিকেই লক্ষ্য রাখতে হবে যে এই ভাইরাসটা তার চেহারা চেঞ্জ করছে কি না।
“আপাতত বাইরে যেই জায়গায় শনাক্ত হয়েছে, সেই দিকে খেয়াল রাখতে হবে, আর আমাদের দেশে যদি আসে, তাহলে আমাদের দেশে জিনোম সিকুয়েন্স করে দেখতে হবে।”
ভাইরোলজিস্টরা বলছেন, এই ভাইরাসের মিউটেশন বা রূপ বদলের হচ্ছে কি না., সেদিকেত খেয়াল রাখতে হবে। দেশের বাইরে থেকে আসা কেউ যদি এর কোনও ‘স্ট্রেইন’ দিয়ে আক্রান্ত হয়ে আসে, তখন সেটা অবশ্যই নজরদারিতে রাখতে হবে।