Beta
বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪
Beta
বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪

ফক্স স্টুডিওর ভাগ্য বদলে দেওয়া ৫ বছরের শিশু অথবা হলিউড তারকা থেকে কূটনীতিক হয়ে ওঠার গল্প

Shirly temple 01
[publishpress_authors_box]

গল্পটা হয়তো অনেকেই জানে। পাঁচ বছর বয়সী এক কন্যা শিশু প্রায় দেউলিয়া হতে থাকা ফক্স স্টুডিওর ভাগ্য বদলে দেয়। সেই কন্যা শিশুর নাম শার্লি টেম্পল। ঘটনাটি ১৯৩৩ সালের।

এক সাক্ষাৎকারে সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শার্লি বলেছিলেন, “আমাকে শেখানো হয়েছিল, ‘টাইম ইজ মানি’ আর ‘এটা কিন্তু খেলা নয়, কাজ’। তারকা হবার আগেই এসব পাঠ আমার নেওয়া হয়ে গিয়েছিল।”

১৯৮৯ সালে বিবিসি একবার শার্লি টেম্পল-এর সাক্ষাৎকার নেয়। সেই সাক্ষাৎকারে শার্লি তার সেই তারকা খ্যাতি পাওয়া শৈশবের দিনগুলো নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন। সে সময় শার্লি অবশ্য আমেরিকার পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তা। তার সেই সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, হলিউডের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত তারকা হয়েও, তার আয় ক্রা কোটি টাকার দেখাও তিনি পেতেন না!

তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল “টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরি ফক্সকেও তো আপনি দেউলিয়া হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন তাই না?”

বৈবাহিক সূত্রে শার্লি টেম্পল থেকে শার্লি টেম্পল-ব্ল্যাক বনে যাওয়া এই কূটনীতিক ছোট্ট করে জবাব দিয়েছিলেন, “তাই তো মনে হয়।”

১৯৩৩ সালে ফক্স স্টুডিও প্রায় দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল। নির্বাক চলচ্চিত্রের যুগে উইলিয়াম ফক্স প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটি বেশ ভালো ব্যবসা করে। কিন্তু ১৯৩৩ সালে স্টুডিওটি প্রায় দেউলিয়া হয়ে যায়। এর কারণ ছিল ৩০ এর দশকের এক মহা অর্থনৈতিক মন্দা। যাকে ইতিহাসে ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’ বলা হয়। এ সময় কোটি কোটি ডলার ঋনে জর্জরিত হয় ফক্স স্টুডিও। তাদের শেয়ারের দামও যায় পড়ে। আর ঠিক সেই সময়, প্রতিষ্ঠানটিকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে সোনালী চুলের এক ছোট্ট মেয়ে।

ফক্স স্টুডিওর সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের মাত্র দুই সপ্তাহ আগে, শার্লি স্ট্যান্ড আপ অ্যান্ড চিয়ার! সিনেমায় অভিনয়ের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই সিনেমায় তার বাবার চরিত্রে অভিনয় করছিলেন জেমস ডান। সিনেমায় তাদের অভিনীত চরিত্রের ভূমিকা ছিল খুবই কম। কিন্তু তাদের অভিনয় দর্শক মনে এতোটাই দাগ কেটে যায় যে, আরও বেশ কিছু সিনেমায় তাদের অভিনয় করা নিশ্চিত হয়ে যায়। এভাবে শার্লি টেম্পল হয়ে ওঠেন একটি পরিচিত নাম।

মায়ের হাত ধরে নাচের ক্লাস করতে গিয়ে শোবিজে অভিষেক ঘটে শার্লি টেম্পলের। তখন তার মাত্র আড়াই বছর বয়স। এ প্রসঙ্গে বিবিসিকে শার্লি বলেছিলেন, “আমি একেবারেই ক্লান্ত হতাম না, আর ঘুমাতামও না। মা আমাকে বাড়ির কাছেই একটি নাচের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। আমি সেখানে রুম্বা আর ট্যাঙ্গো প্র্যাকটিস করতাম।”

সাক্ষাৎকারে শার্লি জানান, সেই নাচের স্কুলেই চলচ্চিত্র পরিচালক চার্লস ল্যামন্ট-এর সঙ্গে তার দেখা। এরপর বেবি বারলেস্কস  নামের একটি শর্ট ফিল্ম সিরিজে অভিনয়ের জন্য শার্লিকে বেছে নেন চার্লস ল্যামন্ট। প্রতিদিন শুটিংয়ের জন্য তাকে দেওয়া হতো মোট ১০ ডলার। কিন্তু মহড়ার জন্য কোনো টাকা পেতেন না শার্লি।

ল্যামন্ট আর তার প্রযোজক জ্যাক হেইস দুজনে মিলে এডুকেশনাল ফিল্মস কর্পোরেশনে কাজ করতেন। তখন তিন বছর বয়সী শার্লি টেম্পলকে দিয়ে আটটি ছবিতে অভিনয় করানো হয়। শার্লির বক্তব্যে জানা যায়, শুটিংয়ের পরিবেশ শিশুদের জন্য একেবারেই উপযুক্ত ছিল না।

শুটিংয়ের সময় ‘খারাপ আচরণের’ জন্য শার্লিদের দেওয়া হতো শাস্তি। একটি শাস্তির কথা বর্ণনা করে শার্লি বলেন, “আমাদের সেটে দুটি সাউন্ড বক্স (ছোট সাউন্ডপ্রুফ কক্ষ) ছিল। তার একটিতে থাকতো বিশাল বড় এক বরফ খন্ড। যখন আমাদের মধ্যে কেউ খারাপ আচরণ করতো, তখন একে একে আমাদের সেই বরফ দেওয়া বক্সে পাঠানো হতো।”

শাস্তির বর্ণনা দিয়ে শার্লি বলেন, “আমার কানে ভীষণ ব্যথা করতো, খুব কষ্ট হতো সেখানে। আমি বেশ কয়েকবার বক্সে ছিলাম।”

শুটিং স্পটের অভিজ্ঞতার কথা বলতে হয়ে শার্লি আরও জানান, শিশুদের বাবা-মায়েদের শুটিংয়ে আসার অনুমতি দেওয়া হতো না। শার্লির মা তার শুটিংয়ের পোশাক বানিয়ে দিতেন। মায়ের কাছ থেকে শার্লি অভিনয়ের পাঠও নিতেন।

সাক্ষাৎকারে শার্লি জানান, সিনেমার বিষয়বস্তু আজকাল খুবই অপ্রাসঙ্গিক।

প্রথম যে চরিত্রে শার্লি অভিনয় করেছিলেন তার নাম ছিল মোরলেগস সুইট ট্রিক। ওয়ার বেবিস সিনেমায়  তিন বছর বয়সী শার্লিকে অভিনয় করতে দেখা যায়। পলি টিক্স ইন ওয়াশিংটন সিনেমায় শার্লি অভিনয় করেন একজন প্ররোচনাকারী চরিত্রে। সিনেমার গল্পে তার চরিত্রটিকে একজন সিনেটরকে প্রলুব্ধ করতে দেখা যায়।

ওই সিনেমার প্রথম দৃশ্যে তিনি একটি ব্রা পরে নখ কাটছিলেন। পরের দৃশ্যে তিনি সিনেটরের অফিসে পার্লের মালা পরে আসেন। সিনেটরের চরিত্রে অভিনয় করছিল আরেকজন শিশু। দৃশ্যে দেখা যায় ওই শিশুটিকে শার্লি বলছেন, তার সঙ্গে “আমোদ-প্রমোদ” করতেই শার্লিকে পাঠানো হয়েছে। শার্লি তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ চাইল্ড স্টার- এ লিখেছিলেন, এই সিনেমাগুলো ছিল “আমাদের শিশুতোষ সরলতাকে নিষ্ঠুরভাবে ব্যবহার করা।” সিনেমাগুলোকে তিনি ‘বর্ণবাদী এবং নারীবিদ্বেষী’ বলেও উল্লেখ করেন।

এরপর শার্লি টেম্পল প্রযোজক, লেখক এবং পরিচালক জ্যাক হেইসের সঙ্গে চুক্তির অধীনে আরও কিছু ছোট চরিত্রে অভিনয় করেন। কিন্তু যখন হেইস দেউলিয়া হয়ে গেলেন, তখন শার্লির বাবা তার চুক্তিগুলো ফিরিয়ে দেন। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন চুক্তিগুলো কতটা বাজে ছিল। তার কিছুদিন পরই শার্লিকে নাচতে দেখে এক গীতিকার পছন্দ করে ফেলেন। যিনি ফক্স স্টুডিওর সঙ্গে কাজ করছিলেন। ওই গীতিকার শার্লিকে স্ট্যান্ড আপ অ্যান্ড চিয়ার! নামের একটি সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। ছোট্ট একটা চরিত্রে শার্লিকে নেওয়া হয়।

সিনেমাটির সার কথা হল, গ্রেট ডিপ্রেশন আসলে ‘আশাবাদী মনোভাবের অভাব’ এর ফল। তাই গল্পে দেখা যায় মানুষের মনোবল বাড়ানোর জন্য চিয়ার লিডারদের খোঁজে অডিশন নেওয়া হচ্ছে। এই সিনেমার শুটিং শেষ হলে তার সঙ্গে আবারও এক বছরের চুক্তি করা হয়। চুক্তিতে আরও সাত বছর পর্যন্ত কাজের সুযোগ রাখা হয় আর সাপ্তাহিক পারিশ্রমিক ১৫০ ডলার ঠিক করা হয়। শার্লির মাও সেটে যাওয়া এবং তাকে শুটিংয়ে সহায়তা করা বাবদ পারিশ্রমিক পেতেন।

আত্মজীবনীতে শার্লি টেম্পল, সাত বছরের অভিজ্ঞতাকে ‘সাত বছর ধরে তাড়া করে ফেরা কালো ছায়ার মতো মেঘ’ বলে উল্লেখ করেন।

শার্লির পরের সিনেমার নাম ছিল বেবি, টেক আ বাউ । ১৯৩৪ সালের এপ্রিল মাসে এই সিনেমার প্রিমিয়ার হয়েছিল। এ সময় অন্য অনেক স্টুডিও তাকে দিয়ে কাজ করাতে ফক্স থেকে ধার নেয় হাজার হাজার ডলারে । যা কিনা তার পারিশ্রমিকের চাইতে অনেক গুণ বেশি ছিল। সেই বছরের শেষ দিকে, ব্রাইট আইস  মুক্তি পায়। এই সিনেমার অন দ্য গুড শিপ ললিপপ গানটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

ফক্স স্টুডিও ১৯২৯ সালে ঘটে যাওয়া স্টক মার্কেটের পতনের কারণে সে সময় খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলছিল। আর তাই ১৯৩৪ সালে তারা টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরি পিকচারের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। এ বিষয়ে ভ্যানিটি ফেয়ার লিখেছিল, “তারা আসলে ফক্স স্টুডিও কিনে নেয়নি, তারা কিনেছিল শার্লি টেম্পলকে।”

নতুন প্রতিষ্ঠানের অধীনে প্রথম বছরেই শার্লি ১০টি সিনেমায় অভিনয় করেন। আর ওই বছর অস্কারে তাকে প্রথম একাডেমি জুভেনাইল অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। এখন পর্যন্ত এই পুরস্কার পাওয়া সবচেয়ে কম বয়সী অভিনেতা শার্লি।

শার্লি সেই গ্রেট ডিপ্রেশন যুগে, যে দর্শকরা আশাবাদ দেখতে চাইতো, তাদের খোরাক হয়ে ওঠে। বক্স অফিস নিয়মিত জমিয়ে রাখতেন শার্লি। প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট তাকে নিয়ে বলেছিলেন, “এই ডিপ্রেশনের সময় যখন মানুষের মনোবল তলানিতে, তখন এটা খুবই চমৎকার বিষয় যে মাত্র ১৫ সেন্টে একজন আমেরিকান একটি শিশুর হাসিমুখ দেখে সব সমস্যাকে ভুলে যেতে পারে।”

শার্লির সিনেমাগুলি লাভজনক হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে, তার পারিশ্রমিকও বাড়তে থাকে, এবং ১০ বছর বয়সেই তিনি হলিউডের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিকপ্রাপ্ত তারকা হয়ে যান।

মাত্র ২২ বছর বয়সেই শার্লি সিনেমা থেকে অবসর নেন। তার শেষ সিনেমার ছিল ১৯৪৯ সালের আ কিস ফর কর্লিস

তবে এখানেই শেষ নয়। চলচ্চিত্রে ক্যারিয়ার শেষ করে, তিনি মার্কিন সরকারের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কাজে যোগ দেন। ঘানা এবং চেকোস্লোভাকিয়ায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন।

বিবিসির ওই সাক্ষাৎকারে, শার্লিকে বলেন, “ঘানার রাষ্ট্রদূতের পদটি ছিল আমার পুরো জীবনের সেরা কাজ।”

তাকে আরও জিজ্ঞাসা করা হয়, “আপনি কি সেই অন দ্য গুড শিপ ললিপপ গানটি নিয়ে বিরক্ত?”

জবাবে শার্লি বলেন, “না। এই গানটি আমাকে অনেক দূর নিয়ে গেছে।”

[বিবিসি’র প্রতিবেদন অবলম্বনে]

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত