“আলোকোজ্জ্বল পথ, বন্ধুরা। আলোকোজ্জ্বল পথ।”
২০১৫ সালে কানাডার সাধারণ নির্বাচনে লিবারেল পার্টি অপ্রত্যাশিতভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। ভোটের ফল ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা পরই জাস্টিন ট্রুডো সমর্থকদের উদ্দেশে হাসিমুখে হাত নেড়ে এভাবেই তার বিজয় বক্তৃতা শুরু করেছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী স্টিফেন হার্পারের এক দশকের রক্ষণশীল শাসনের পর দেশে ‘বাস্তব পরিবর্তন’ আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেদিন ট্রুডো বলেছিলেন, “ইতিবাচক রাজনীতি এমনটাই করতে পারে।”
আর এখন ট্রুডো কানাডার ক্ষমতায় এক দশক থাকার পর লিবারেল পার্টির প্রধানের পদ থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন। তাকে সরে দাঁড়াতে হচ্ছে। তিনি লিবারেল পার্টিকে যে তলানি থেকে শীর্ষে তুলেছিলেন, দলটির বর্তমান অবস্থা এখন আবার সেই তলানিতেই। অন্তত জনমত জরিপগুলো তাই বলছে।
কানাডার প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকেই পদত্যাগ করছেন জাস্টিন ট্রুডো। দলের অভ্যন্তরীণ মতবিরোধ, বিরোধী পক্ষের চাপ এবং আসন্ন নির্বাচনের আগে জনমত জরিপে দুর্বল অবস্থানের কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
অটোয়ায় সোমবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রুডো বলেন, “আপনারা সবাই জানেন, আমি একজন সংগ্রামী মানুষ। বিশেষ করে লড়াইটা যখন এতটাই গুরুত্বপূর্ণ, তখন আমি কখনও পিছিয়ে যাই না।
“কানাডীয়রা পরবর্তী নির্বাচনে একটি বাস্তব বিকল্পের অধিকারী। তবে দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে আমার কাছে স্পষ্ট হয়েছে যে, আমি পরবর্তী নির্বাচনে লিবারেল দলের নেতৃত্ব দেওয়ার উপযুক্ত ব্যক্তি নই।”
জাস্টিন ট্রুডোর জন্য এটি আসলে নাটকীয় পতন। ২০১৩ সাল থেকে তিনি লিবারেল পার্টির নেতৃত্বে রয়েছেন। তিনি দায়িত্ব নিয়েছিলেন জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা, সামাজিক কর্মসূচি শক্তিশালী করা এবং কানাডার মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে সহায়তার মতো উচ্চাভিলাষী প্রতিশ্রুতিগুলো দিয়ে।
তবে সোমবারের ঘোষণাটি অপ্রত্যাশিত ছিল না।
মাসের পর মাস ধরে নিজ দলের ভেতরে চাপের মুখে ছিলেন ট্রুডো। দলের অনেক এমপি তাকে পরবর্তী নির্বাচনের আগেই পদত্যাগের আহ্বান জানান। এছাড়া মুদ্রাস্ফীতি থেকে শুরু করে আবাসনের সমস্যাগুলো সামাল দেওয়ার ক্ষেত্রে তার ব্যর্থতা নিয়ে জনসাধারণের ব্যাপক অসন্তোষও তাকে মোকাবিলা করতে হয়েছে।
সম্প্রতি কানাডার বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার যুক্তরাষ্ট্রের ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপের হুমকি নতুন সমালোচনার জন্ম দেয়। ফলে ট্রুডোর প্রধান রাজনৈতিক মিত্র অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড পদত্যাগ করেন।
ব্রিটিশ কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অধ্যাপক স্টুয়ার্ট প্রেসট বলেন, “আমি মনে করি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাকে এখনকার চেয়ে একটু বেশিই স্নেহভরে স্মরণ করা হবে।
“তবে অদ্ভুত হলো, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ট্রুডো ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করতে গিয়ে এমন কিছু কাজ করেন, যেগুলোর জন্য তার সবচেয়ে ভালোভাবে স্মরণীয় হওয়ার কথা ছিল।”
লিবারেল পার্টি পুনর্গঠন
ট্রুডো নেতৃত্বাধীন লিবারেল পার্টি ২০১৫ সালের কানাডার নির্বাচনে ‘এখনই বাস্তব পরিবর্তন’ স্লোগানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
ট্রুডোর বাবা পিয়ের এলিয়ট ট্রুডোও ছিলেন লিবারেল পার্টির প্রধান ও কানাডার প্রধানমন্ত্রী। তারই বড় সন্তান জাস্টিন ট্রুডো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তিনি দেশকে একত্রিত করবেন এবং হার্পারের অধীনে থাকা বিভক্ত রাজনীতির অবসান ঘটাবেন।
বিজয় ভাষণে ট্রুডো বলেছিলেন, “আমরা আশার মাধ্যমে ভয়কে পরাজিত করি। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সন্দেহবাদী মনোভাবকে পরাজিত করি। আমরা নেতিবাচক ও বিভক্ত রাজনীতিকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে পরাজিত করি। আর এতে কানাডীয়রা একত্রিত হয়।”
মধ্যপন্থী লিবারেলরা ২০১৫ সালের নির্বাচনের আগে কনজারভেটিভ পার্টি ও বামপন্থী নিউ ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এনডিপি) পেছনে ছিল। ২০১১ সালের নির্বাচনেও দলটি ছিল তৃতীয় স্থানে।
ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত থাকা লেবার পার্টিকে ট্রুডো আবার চাঙ্গা করেছিলেন। এটি ছিল তার বিশাল সাফল্য, বলছিলেন প্রেসট।
তার মতে, সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা ও জনমনে বাড়তে থাকা হতাশার মধ্যে লিবারেলরা আবারও এনডিপির কাতারে চলে এসেছেন।
সাম্প্রতিক জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে, অক্টোবরের শেষে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের আগে দুটি পার্টি প্রায় ২০ শতাংশ সমর্থন পাচ্ছে। এই দুই পার্টিই সমর্থনের দিক দিয়ে কনজারভেটিভ পার্টি থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। জরিপে কনজারভেটিভরা প্রায় ৪০ শতাংশ জনসমর্থন পেয়েছে।
প্রেসটের বিশ্লেষণ বলছে, লিবারেলরা এখন কানাডার তরুণদের একটি বড় অংশের সমর্থন হারিয়েছে। অথচ এই তরুণরাই ছিল দলটির বড় ভোটব্যাংক। তারা দেশটির বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নিজেদের বিচ্ছিন্ন মনে করছেন। ফলে তারা আরও মৌলিক পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া বা আরও বিপ্লবী বিকল্প খুঁজতে ইচ্ছুক।
প্রতিশ্রুতি ও নীতিমালা
তবে প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর ট্রুডো অনেক জনপ্রিয় ছিলেন। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে। কারণ তিনি তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে শুরু করেছিলেন।
শুরুতে ট্রুডো কানাডার প্রথম লিঙ্গভিত্তিক ভারসাম্যপূর্ণ মন্ত্রিপরিষদ প্রতিষ্ঠা করে ব্যাপক প্রশংসা পান। ওই পরিষদে পুরুষ ও নারীদের মধ্যে সমানভাবে সদস্য ছিলেন। আর এটি ছিল তার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম কাজগুলোর একটি।
তার প্রথম বাজেটে পাবলিক ব্রডকাস্টার সিবিসি/রেডিও-কানাডাকে ফের তহবিল বরাদ্দ দিয়েছিল। চালু হয়েছিল শিশু কর সুবিধা। ট্রুডো কানাডার মধ্যবিত্তদের সহায়তা করার ও জলবায়ু সংকট মোকাবেলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সময় যত বাড়তে থাকে, ট্রুডোর জনপ্রিয়তাও কমতে থাকে। তার লিবারেল পার্টি ২০১৯ ও ২০২১ সালে ফের নির্বাচিত হয়। তবে উভয় সময়ই তারা ছিল সংখ্যালঘু সরকার।
ক্যালগারি ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্র বিজ্ঞানের অধ্যাপক লিসা ইয়ংয়ের মতে, ট্রুডোর সফলতা ও ব্যর্থতা উভয়ই আছে। তিনি উদাহরণ হিসেবে উত্তর আমেরিকা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এনএএফটিএ) ও ইউএস-মেক্সিকো-কানাডা চুক্তির (ইউএসএমসিএ) কথা উল্লেখ করেন।
লিসা আল জাজিরাকে বলেন, “কিছু দৃষ্টিকোণ থেকে ট্রুডো সরকারের সেরা সময় ছিল ট্রাম্পের প্রথম আমলে। তখন তারা কৌশলের মাধ্যমে এনএএফটিএ চুক্তি রক্ষা করতে পেরেছিলেন। তারা কানাডার অধিকাংশ বাজারে প্রবেশাধিকার বজায় রাখতে পেরেছিল। পাশাপাশি তারা কঠিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেও দেশকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পেরেছিলেন।”
সাম্প্রতিক সময়ে ট্রুডোর সরকার একটি সিরিজ প্রগতিশীল সামাজিক নীতি চালু করেছে। এর মধ্যে আরও সাশ্রয়ী শিশু যত্ন এবং একটি দন্তচিকিৎসা প্রোগ্রাম অন্তর্ভুক্ত ছিল। দ্বিতীয়টি ছিল এনডিপির প্রধান দাবি। তারা ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত লিবারেল সংখ্যালঘু সরকারকে সমর্থন করছিল।
লিসা ইয়ংয়ের মতে, তখন সাধারণ কানাডীয়রা নতুন সামাজিক প্রোগ্রামের সম্ভাবনা নিয়ে হতাশ ছিল। তারা এগিয়ে যাওয়ার একটি পথ খুঁজে পায়। তবে কানাডায় নতুন সরকার আসলে এসব প্রোগ্রাম বিপদে পড়তে পারে। কনজারভেটিভরা এগুলো রাখবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
সব প্রতিশ্রুতিই যে ট্রুডো রেখেছেন, এমন না। কিছু প্রতিশ্রুতি পূরণে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে, কানাডার ‘ফার্স্ট-পাস্ট-দ্য-পোস্ট’ ভোটিং ব্যবস্থা পরিবর্তন করে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থার প্রস্তাব।
বছরের পর বছর অধিকারকর্মীরা ট্রুডোর সরকারকে সমালোচনা করেছেন যে তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এক কিন্তু করেছে আরেক।
উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র অভিবাসীদের ওপর কঠোর হলে, ট্রুডো সোশাল মিডিয়ায় ঘোষণা দেন যে, কানাডা অভিবাসীদের স্বাগত জানাবে। ওই ঘোষণার পর কানাডায় অভিবাসীদের ঢল নামলে দেশটির ডানপন্থী আঞ্চলিক নেতারা ট্রুডোর উপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করেন। ফলে এক পর্যায়ে ট্রুডোকে অভিবাসী প্রশ্নে কঠোর হতে হয়।
ট্রুডো সরকার সম্প্রতি অভিবাসীদের কেন্দ্র করে বাড়তে থাকা আবাসন খরচ নিয়েও বেকায়দায় পড়েন।
ট্রুডো গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন মোকাবেলায় প্যারিস চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। তিনি কানাডার মধ্য দিয়ে যাওয়া বেশ কয়েকটি বড় তেল ও গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্পের সমর্থন করেছিলেন। এর মধ্যে ছিল বাতিল হওয়া কিইস্টোন এক্সএল পাইপলাইন, যা যুক্তরাষ্ট্রে যাবে।
এছাড়াও ২০১৮ সালে কানাডার সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিল, ফেডারেল সরকার কার্বন নির্গমনের ওপর মূল্য আরোপ করতে পারে। পূর্ব কানাডায় কিছু বিশেষ ধরনের জ্বালানির জন্য ছাড় দেওয়ায় কার্বন নির্গমন পরিকল্পনা দুর্বল হয়ে যায়।
আদিবাসী সম্পর্ক
আদিবাসীদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকা নিয়েও বিতর্কিত ছিলেন ট্রুডো। ২০১৫ সালে তিনি আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের আহ্বান জানান। আদিবাসীরাও শুরুর দিকে ট্রুডোর কথায় আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন।
কথা ছিল ট্রুডো ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ এর সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করবেন। এই কমিশন দীর্ঘদিন ধরেই কানাডার আদিবাসী শিশুদের ওপর নির্যাতনের তদন্ত করছে। কিন্তু ট্রুডো এখানেও তার প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেননি।
২০১৫ সালে ট্রুডো দেশের বিভিন্ন অংশে হারিয়ে যাওয়া এবং হত্যার শিকার আদিবাসী নারীদের নিয়ে একটি জাতীয় তদন্তের আদেশ দেন। পরে তিনি তদন্তের সিদ্ধান্তকে স্বীকার করেন যে, এই সংকটটি ‘জাতিগত নিধন’ ছিল।
নিজের জ্বালানি নীতি প্রশ্নেও ট্রুডো বিতর্কের জন্ম দেন। ২০১৮ সালে তার নেওয়া একটি তেল পাইপলাইন প্রকল্প নিয়ে বিতর্ক ওঠে। কারণ ওই লাইন আদিবাসী এলাকার উপর দিয়ে যায়। আদিবাসীরা ওই ঘটনার প্রতিক্রিয়াও জানায়। ২০২০ সালেও তিনি একই ঘটনার জন্ম দেন।
গভীর বিভক্তি
ট্রুডোর ক্ষমতায় থাকার সময়টা ছিল বৈশ্বিক রাজনৈতিক বিভাজনে পূর্ণ। কানাডা যখন করোনা মহামারি ও এ সম্পর্কিত অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করছিল, ট্রুডোর লকডাউন ব্যবস্থা, বাড়তি জীবনযাত্রার খরচ এবং অন্যান্য অসন্তোষের কারণে জনগণের অসন্তোষ বাড়ছিল।
২০২২ সালের শুরুতে পরিস্থিতি তীব্র হয়ে ওঠে। তখন ডানপন্থী দলগুলো একটি ট্রাক কনভয় তৈরি করে এবং কয়েক সপ্তাহ ধরে অটোয়ার পার্লামেন্টের বাইরে রাস্তাগুলো দখল করে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়।
কানাডার পশ্চিমাংশের মানুষ পূর্বাংশের তুলনায় নিজেদের বঞ্চিত মনে করেন বেশি। এনিয়েও ট্রুডোকে বিরোধীতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। আলবার্টা ও সাসকাচেওয়ানের মতো শীর্ষ তেল উৎপাদনকারী প্রদেশে এই বিরোধীতা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। লিসা ইয়ংয়ের মতে, কানাডার পশ্চিমাংশে এখনও ‘ট্রুডো’ একটি খারাপ শব্দ হিসেবে বিবেচিত হয়। হয়ত আগামী ২০ বছরেও এমনটা থাকবে।
তথ্যসূত্র : আল জাজিরা