লস অ্যাঞ্জেলেসের বিধ্বংসী দাবানলে এরই মধ্যে ধ্বংস হয়েছে হাজার হাজার ঘর-বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। আগুনের প্রকোপ এখনও বেড়েই চলেছে।
স্থানীয় মিডিয়া আকু ওয়েদার জানিয়েছে, দাবানলে ১৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি আর্থিক ক্ষতি হতে পারে। আর দাবানলের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকি ও সংশ্লিষ্ট ব্যয় ক্যালিফোর্নিয়ার বিমা বাজারের সঙ্কট আরও বাড়িয়ে তুলছে।
আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি মুডির হিসাব অনুযায়ী, দাবানল থেকে বিমা ক্ষতি বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে, যেহেতু ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর বাড়ি ও ব্যবসার মূল্য অনেক বেশি। জেপি মরগান ক্ষতির পরিমাণ ১০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি হতে পারে বলে অনুমান করছে।
ক্যালিফোর্নিয়ার প্রাকৃতিক দুর্যোগের উচ্চঝুঁকির কারণে হেরিটেজের মতো প্রধান বিমা প্রতিষ্ঠানগুলো এরই মধ্যে রাজ্য থেকে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। ফলে অনেক বাড়ির মালিক বিমাহীন অবস্থায় পড়েছেন। তাদের নির্ভর করতে হচ্ছে ক্যালিফোর্নিয়ার রাজ্য নির্ধারিত ‘ফেয়ার প্ল্যান’ এর ওপর। পরিকল্পনাটি মূলত আগুন বিমার শেষ অবলম্বন হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল। গভর্নর গ্যাভিন নিউজমের নেতৃত্বে পরিকল্পনাটি সংস্কার ও সম্প্রসারিত হয়েছে।
ফেয়ার (ফেয়ার অ্যাকসেস টু ইনস্যুরেন্স রিকোয়্যারমেন্টস) প্ল্যান হলো ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত রাজ্য নির্ধারিত আগুন বিমা সংস্থা। বিমা প্রতিষ্ঠানগুলো বিমা পলিসি দিতে অস্বীকার করায় পরিকল্পনাটি করা হয়েছিল। ক্যালিফোর্নিয়ায় প্রতিটি কোম্পানিকে তাদের বাজার শেয়ার অনুযায়ী ফেয়ার প্ল্যান বাজেটে অবদান রাখতে হয়।
ফেয়ার প্ল্যানের প্রিমিয়াম সাধারণত বেসরকারি বিমা প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ে বেশি হলেও গত চার বছরে এতে অংশগ্রহণ দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। প্যাসিফিক প্যালিসেডসে ২০২৩ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে এই পরিকল্পনায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ৮৫ শতাংশ বেড়েছে।
গভর্নর গ্যাভিন নিউজম এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, “রাজ্যের ফেয়ার প্ল্যানকে শক্তিশালী করা একটি প্রধান অগ্রাধিকার। এটি জনগণকে নির্ভরযোগ্য ও সাশ্রয়ী বিমা দিতে সহায়তা করবে। এই উন্নয়ন পুরো বাজারকে স্থিতিশীল করতে এবং যারা এরই মধ্যে এর উপর নির্ভরশীল তাদের জন্য আরও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে।”
তবে কিছু বিমা প্রতিষ্ঠান ক্যালিফোর্নিয়া থেকে সরে যাচ্ছে।
রাজ্যটিতে সক্রিয় থাকা একটি বড় বিমা কোম্পানি তাদের প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিনহুয়াকে জানিয়েছে, “ক্যালিফোর্নিয়ায় দাবানল, ভূমিকম্প এবং ভূমিধসসহ নানা দুর্যোগের কারণে প্রচুর বিমা দাবি জমা পড়ছে। এসব মোকাবেলা করে সেখানে পলিসি চালু রাখা আমাদের কোম্পানিকে দেউলিয়া করে দিত।”
বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়ার সাড়ে চার লাখের বেশি বাসিন্দাকে রাজ্যের ফেয়ার প্ল্যানের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এই পরিকল্পনার বিমা কভারেজ বেড়ে ৪৫৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা ২০২০ সালের প্রায় তিনগুণ।
বিমা প্রতিষ্ঠানগুলো সরে যাওয়ায় প্যাসিফিক প্যালিসেডসের মতো এলাকাগুলো চরম সঙ্কটে পড়েছে। মিলিয়ন ডলার মূল্যের হাজার হাজার বাড়ি সমৃদ্ধ এলাকাটি পলিসি নবায়ন বন্ধের মুখোমুখি হয়েছে। সেখানকার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সম্পত্তি ফেয়ার প্ল্যানের ওপর নির্ভরশীল। আর এটি রাজ্যের চাপে থাকা ব্যবস্থাকে সম্ভাব্য বিপর্যয়কর আর্থিক ঝুঁকির মুখে ফেলেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দাবানলগুলো আরও তীব্র হচ্ছে। এতে অর্থনৈতিক বন্দোবস্ত, বাড়ির বিমার মতো বিষয়গুলো ক্রমবর্ধমান ঝুঁকির মুখে অকার্যকর হয়ে পড়ছে।
ক্যালিফোর্নিয়ায় দাবানল নতুন কিছু নয়। প্রতি বছরই রাজ্যের কোনও না কোনও প্রান্তে দাবানল হয়। তবে ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা ও উন্নয়নের কারণে দাবানলের বিধ্বংসী ক্ষমতা বেড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন সেখানে বসন্তে ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয়। তখন বনাঞ্চলে নতুন নতুন গাছের জন্ম হয়। শুষ্ক মৌসুমে ওই গাছই জ্বালানির উৎস হয়ে ওঠে। বাড়ে দাবানলের ঝুঁকি।
আর এর সঙ্গে যুক্ত হয় শক্তিশালী ‘সান্তা আনা’ বাতাস। এতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। এমনকি একটি ছোট আগুনও বিশাল দাবানল সৃষ্টি করতে পারে। দাবানল দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বনাঞ্চল ও নগরাঞ্চলের সংযোগস্থলে গড়ে ওঠা বাড়ি ও প্রকৃতির ওপর বিধ্বংসী প্রভাব ফেলে।
এই সঙ্কট মোকাবেলায় ক্যালিফোর্নিয়ার বিমা কমিশনার রিকার্ডো লারা সম্প্রতি বাজারকে স্থিতিশীল করতে সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন। বিমা প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্যোগ মডেল ব্যবহার করে রেট নির্ধারণ, বাড়ির মালিকদের অগ্নি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাপনায় যুক্ত করা এবং পুনর্বিমা ব্যয় মেটাতে প্রিমিয়াম সমন্বয়ের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
সংস্কারের বিনিময়ে বিমা প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজ্যজুড়ে বাজার অনুসারে উচ্চঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বিমা কভারেজ বজায় রাখতে হবে।
দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলোতে বিমা পলিসি বাতিল থেকে বিরত থাকতে এক বছরের নিষেধাজ্ঞাও জারি করেন কমিশনার। এতে বাড়ির মালিকরা সাময়িক সময়ের জন্য স্বস্তি পেয়েছিল। কিন্তু মূল সমস্যা থেকেই যায়। নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর বিমা প্রতিষ্ঠানগুলো পলিসি নবায়ন প্রত্যাখ্যানের অধিকার ফিরে পায়। ফলে আবার ঝুঁকিতে পড়ে বাড়ি ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মালিকরা।
বাড়তি চাহিদার কারণে ফেয়ার প্ল্যান এমনিতেই চাপের মধ্যে আছে। চলমান দাবানল এই পরিকল্পনাকে আরও বড় আর্থিক চাপে ফেলবে। এই পরিকল্পনার অধীনে রিজার্ভ অর্থ আছে ১০ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু চাহিদার তুলনায় এই রিজার্ভ অপ্রতুল।
তাই বেসরকারি বিমা প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিস্থিতি সামাল দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। ক্যালিফোর্নিয়ার বাজারে তাদের অংশগ্রহণ পুনর্বিবেচনা করতে উৎসাহিতও করা হতে পারে।
এই অনিশ্চিত পরিস্থিতি জলবায়ু ঝুঁকির বাড়তি চাপের কারণে বিমা ব্যবস্থার ভঙ্গুরতা স্পষ্ট করে তুলছে।
প্রিমিয়াম বাড়ানোর সম্ভাবনা থাকলেও অনেক বাড়ির মালিক হয়তো পুনঃনির্মাণ খরচ বৃদ্ধি ও ব্যাপক দুর্যোগের কারণে পর্যাপ্ত বিমা না পেয়ে বিপদে পড়বেন।
যুক্তরাষ্ট্রে কম বিমা করা সম্পত্তির অদেখা ক্ষতি ১ ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি হতে পারে। বিষয়টি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলছে। কম নিয়ন্ত্রিত বীমা প্রতিষ্ঠানগুলো ও রাজ্য পরিচালিত প্রোগ্রামগুলো প্রায়ই এই ঘাটতি পূরণ করতে আসে। তবে তারা ঝুঁকি করদাতাদের ওপর চাপিয়ে দেয়, যা আর্থিক দুর্বলতা বাড়িয়ে তোলে।
নীতিনির্ধারক ও বাড়ির মালিকদের সামনে এখন অনেক প্রশ্ন। আগুনের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় তারা বাড়ি পুনঃনির্মাণ করবে কি না, নাকি উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ছেড়ে নিরাপদ স্থানে সাশ্রয়ী আবাসন নির্মাণে মনোযোগ দেবে।
একই সময়ে বাড়ির মালিকদের তাদের বিমা কভারেজ পুনঃমূল্যায়ন করতে হবে এবং আগুন প্রতিরোধক কাঠামোতে বিনিয়োগের কথা ভাবতে হবে।
সাম্প্রতিক সংস্কারের পরও দাবানলের আর্থিক ক্ষতি ক্যালিফোর্নিয়ার বিমা কৌশল আসলে কতটা টেকসই সে প্রশ্ন সামনে এনেছে।
বিমা নীতিমালা সংস্কারগুলো এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এসব সংস্কার বাজারকে স্থিতিশীল করতে পারবে কিনা তা এখনও অনিশ্চিত। বিশেষজ্ঞরা আরও প্রিমিয়াম বৃদ্ধির পূর্বাভাস দিচ্ছেন। আর এতে রাজ্যের বিমা কাঠামোর পদ্ধতিগত দুর্বলতা সমাধানে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে।
তথ্যসূত্র : ওয়াশিংটন পোস্ট।