Beta
সোমবার, ১০ মার্চ, ২০২৫
Beta
সোমবার, ১০ মার্চ, ২০২৫

ট্রাম্পের হুমকি যেভাবে ট্রুডোর দলের জন্য শাপে বর হলো

mashup-leaders-trump
[publishpress_authors_box]

পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে কে জয়ী হবে, এই প্রশ্ন কয়েক মাস আগেও কানাডীয়দের করলে নিশ্চিতভাবেই কনজারভেটিভ পার্টির নামই সামনে আসত। কিন্তু এখন আর সেই বাস্তবতা নেই।

উল্টো প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর লিবারেল পার্টির পাল্লা ভারী হচ্ছে ক্রমশ। কানাডার মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতা বলছে, ট্রুডোর জনপ্রিয়তা গত কয়েক মাস আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি।

ফলে ২০২৩ সালের মাঝামাঝি থেকে কনজারভেটিভ পার্টি যে বড় ব্যবধানে এগিয়ে থাকার অবস্থানে ছিল, তা কমে গেছে।

আর এই পুরো ঘটনার কৃতিত্ব যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের। তার এক হুমকিতে পাল্টে গেছে কানাডার রাজনীতির দৃশ্যপট।

কানাডার রাজনীতিতে এই বড় পরিবর্তন বলে দিচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান শুল্কনীতি ও কানাডাকে ‘৫১তম রাজ্য’ বানানোর ট্রাম্পের আহ্বান দেশটির ভোটারদের অগ্রাধিকার বদলে দিয়েছে।

অটোয়া ইউনিভার্সিটির রাজনৈতিক বিজ্ঞানের অধ্যাপক লুস টারজিয়নের মতে, ট্রাম্পের বক্তব্য কানাডীয়দের আগের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে পেছনে ঠেলে দিয়েছে। ২০ জানুয়ারি তার শপথ গ্রহণের আগে যেসব বিষয় ছিল গুরুত্বপূর্ণ, এখন সেগুলো গুরুত্ব হারিয়েছে।

এক সময় জনপ্রিয়তা হারানো ট্রুডোও এই পরিবর্তনের ফলে নতুনভাবে উঠে এসেছেন। ডিসেম্বরের পর থেকে তার গ্রহণযোগ্যতা ১২ পয়েন্ট বেড়েছে। তবে তিনি আর বেশি দিন ক্ষমতায় থাকবেন না। কারণ বছরের শুরুতেই তিনি পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন।

ট্রুডোর লিবারেল পার্টি রবিবার তাদের নতুন নেতা নির্বাচনের ফল ঘোষণা করবে। এই নেতা একটি দুর্বল সংখ্যালঘু সরকার পরিচালনা করবেন। এসময় তাকে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে—ট্রাম্পের হুমকির জবাব কীভাবে দেওয়া হবে এবং কবে সাধারণ নির্বাচন ডাকা হবে। প্রথম সিদ্ধান্তের প্রভাব দ্বিতীয় সিদ্ধান্তেও পড়বে।

কানাডার ফেডারেল নির্বাচন ২০ অক্টোবরের মধ্যে হতে হবে। তবে এর তারিখ এই সপ্তাহেই ঘোষিত হতে পারে।

জনমত জরিপ বলছে, অনেক কানাডীয় শীর্ষ নেতৃত্বে পরিবর্তন চান। তবে এই পরিবর্তন কীভাবে হবে—নতুন নেতৃত্বে লিবারেল সরকার থাকবে না কি কনজারভেটিভদের হাতে ক্ষমতা যাবে— তা এখনও অনিশ্চিত।

টরন্টোভিত্তিক ইনোভেটিভ রিসার্চ গ্রুপের প্রেসিডেন্ট গ্রেগ লাইল বলেন, কনজারভেটিভরা নির্বাচনে সহজ জয় পাবে, এখন পর্যন্ত এমনটাই মনে হচ্ছিল।

এমনটা ভাবার কারণ হলো, পিয়ের পয়লিয়েভরের নেতৃত্বাধীন মধ্য-ডানপন্থী দল কানাডার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে শক্তিশালী বার্তা দিয়েছে। গত কয়েক বছরে কানাডীয়দের মনোযোগ ছিল যেসব সমস্যায়—জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, বাসস্থানের উচ্চ মূল্য, অপরাধ বৃদ্ধি ও দুর্বল স্বাস্থ্যসেবা—সেসব নিয়েই তারা কথা বলেছে।

পয়লিয়েভের এসব সামাজিক সমস্যার জন্য ট্রুডোর ‘ব্যর্থ’ নীতিগুলোকে দায়ী করেছেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, দেশকে ‘কমন সেন্সভিত্তিক রাজনীতিতে’ ফিরিয়ে আনবেন।

কিন্তু ট্রুডোর পদত্যাগ এবং কানাডার অর্থনীতি ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে ট্রাম্পের হুমকির কারণে কনজারভেটিভদের বার্তা গুরুত্ব হারিয়েছে বলে মনে করেন গ্রেগ লাইল। তার জরিপ অনুযায়ী, এখন অধিকাংশ কানাডীয় ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সি ও কানাডার ওপর তার প্রভাব নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন।

ট্রাম্প কানাডার সব রপ্তানির ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। যদিও এর কিছু অংশ ২ এপ্রিল পর্যন্ত স্থগিত রাখা হয়েছে। কানাডার অর্থনীতির জন্য এটি বিপর্যয়কর হতে পারে। কারণ দেশটির রপ্তানির তিন-চতুর্থাংশই যুক্তরাষ্ট্রে যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর ফলে প্রায় ১০ লাখ মানুষ চাকরি হারাতে পারে। এই শুল্ক বহাল থাকলে কানাডা অর্থনৈতিক মন্দায় পড়তে পারে।

লিবারেল প্রার্থী মার্ক কার্নি।

ট্রুডো অর্থনৈতিক মন্দা ও ট্রাম্পের হুমকিকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। গত সপ্তাহেই সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ট্রাম্প যে কারণ দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ করেছেন—সীমান্ত দিয়ে ফেন্টানিল প্রবাহ—তা ভিত্তিহীন ও অযৌক্তিক।

তিনি সতর্ক করে বলেন, “ট্রাম্প চান কানাডার অর্থনীতি পুরোপুরি ভেঙে পড়ুক, যাতে আমাদের সংযুক্ত করা সহজ হয়।”

অটোয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক টারজিয়ন বিবিসিকে বলেন, “এটি আসলে কানাডার টিকে থাকার মৌলিক ও সর্বব্যাপী একটি সমস্যা।”

তাই আসন্ন নির্বাচনে মূল প্রশ্ন হলো—কে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কানাডাকে রক্ষা করতে পারবে?

তবে এখনও কনজারভেটিভ পার্টি জনমত জরিপে এগিয়ে আছে। সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, ৪০ শতাংশ ভোটার তাদের সমর্থন করছেন। অন্যদিকে লিবারেল পার্টির জনপ্রিয়তাও বেড়েছে। জানুয়ারির তুলনায় তাদের সমর্থন ১০ পয়েন্ট বেড়ে ৩০ শতাংশ ছাড়িয়েছে।

লিবারেলরা তাদের দেশের কনজারভেটিভ নেতা ও যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টের মধ্যে মিল তুলে ধরার চেষ্টা করছে। গত সপ্তাহের নেতৃত্ব বিতর্কে প্রার্থীরা পয়লিয়েভেরকে “আমাদের দেশের ছোট ট্রাম্প” বলে উল্লেখ করেন এবং বলেন, “তিনি ট্রাম্পকে ‘অনুকরণ’ করতে চান।” লিবারেল পার্টির এক নির্বাচনী প্রচার ভিডিওতে দুজনের মিল দেখানো হয়, যেখানে তারা ‘ভুয়া খবর’ ও ‘চরমপন্থী বামপন্থার’ মতো একই ধরনের শব্দ ব্যবহার করেছেন।

তবে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে দুজনের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য আছে। এমনকি ট্রাম্প নিজেও এই তুলনাকে গুরুত্ব দেননি। ব্রিটিশ ম্যাগাজিন দ্য স্পেকটেটরে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, পয়লিয়েভরে “যথেষ্ট ম্যাগা নন”। এখানে ম্যাগা মানে ‘মেইন আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’।

সাম্প্রতিক জনমত জরিপে কানাডার কনজারভেটিভদের সমর্থন কিছুটা কমতে দেখা যাচ্ছে। গবেষণা সংস্থা অ্যাঙ্গাস রেইডের জরিপ বলছে, ভোটারদের মতে, লিবারেল পার্টির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মার্ক কার্নি বাণিজ্য ও শুল্ক বিষয়ে ট্রাম্পের সঙ্গে মোকাবেলা করতে পয়লিয়েভের চেয়ে বেশি সক্ষম।

কানাডা ও যুক্তরাজ্যের সাবেক কেন্দ্রীয় ব্যাংকার মার্ক কার্নি তার অভিজ্ঞতাকে মূল শক্তি হিসেবে তুলে ধরছেন। তিনি ২০০৮ সালের আর্থিক সংকট ও ব্রেক্সিট মোকাবেলার অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে নেতৃত্ব দিতে চান।

এদিকে রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন কনজারভেটিভদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে। 

শিগগিরই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে প্রচার চলবে এমন এক সময়ে, যখন ট্রাম্পের হুমকি কানাডীয়দের মধ্যে প্রবল দেশপ্রেম উসকে দিয়েছে। অনেকেই এখন স্থানীয় বাজারে আমেরিকান পণ্য বর্জন করছেন বা যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ বাতিল করছেন।

অধ্যাপক টারজিয়নের মতে, “জাতীয় পতাকার পেছনে একত্রিত হওয়া” এখন কানাডার রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে।

কনজারভেটিভ নেতা পিয়ের পয়লিয়েভ।

এই পরিবর্তনের কারণে কনজারভেটিভরা তাদের আগের ‘কানাডা ভেঙে পড়েছে’ স্লোগান বাদ দিয়েছে। তাদের নতুন স্লোগান এখন ‘কানাডা সবার আগে’।

কনজারভেটিভরা এখন কার্নির ওপর নতুন করে আক্রমণ করছে। ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের আগে তারা প্রচার করেছিল, ‘তিনি ট্রুডোর মতো’। এটা ছিল কার্নিকে ট্রুডোর সঙ্গে সম্পর্কিত করার চেষ্টা। তবে এখন কনজারভেটিভরা কার্নির কানাডার প্রতি বিশ্বস্ততা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে।

তারা জানতে চাচ্ছে, কানাডিয়ান কোম্পানি ব্রুকফিল্ড অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট যখন তাদের প্রধান কার্যালয় টরন্টো থেকে নিউইয়র্কে নিয়ে যায়, তখন কার্নি এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন কি না। কারণ তিনি তখন ওই কোম্পানির প্রধান ছিলেন।

কার্নি বলেছেন, যখন এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, তখন তিনি কোম্পানি ছেড়ে দিয়েছিলেন। তবে সিবিসি জানিয়েছে, কোম্পানির নথি অনুসারে ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে যখন কার্নি কোম্পানিতে ছিলেন, তখন এই স্থানান্তর অনুমোদন করা হয়।

এই বিষয়টি ও কার্নির ভূমিকা নিয়ে কানাডার বড় সংবাদপত্র দ্য গ্লোব অ্যান্ড মেইল সমালোচনা করেছে। তারা বলেছে, কার্নিকে কানাডার সামনে সঠিক তথ্য দিতে হবে।

পত্রিকাটি আরও লিখেছে, “প্রতিটি দলের নেতাকে বুঝতে হবে, কানাডা এক দীর্ঘ অস্থিতিশীল সময়ের মধ্যে প্রবেশ করছে। পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীকে কানাডীয়দের আস্থা নিয়ে দেশকে সঠিক দিশায় পরিচালনা করতে হবে, যদিও সেই পথ তারা হয়তো চায় না।”

কানাডীয়দের মধ্যে যে উদ্বেগ রয়েছে, সেবিষয়ে লাইল বলেন, কার্নির দেশের প্রতি বিশ্বস্ততা নিয়ে যে কোনো অস্পষ্টতা তার ও লিবারেলদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

নির্বাচনে যেই জয়ী হোক, একটি বিষয় নিশ্চিত: ট্রাম্প কানাডার রাজনীতিতে তার প্রভাব অব্যাহত রাখবেন এবং যেমনটি যুক্তরাষ্ট্রে করেছেন, তেমনই কানাডার রাজনীতি পুনর্গঠন করবেন।

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত