যুক্তরাষ্ট্রের আগের প্রশাসন তালেবানের ক্ষমতা দখলের প্রেক্ষাপটে আফগান শরণার্থী পুনর্বাসনে যে কর্মসূচি নিয়েছিল তা প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিনই তিন মাসের জন্য স্থগিত করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
তার এই পদক্ষেপে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে পাকিস্তানে অবস্থান করা সাংবাদিক, দোভাষী, মানবাধিকার কর্মী, শিক্ষার্থীসহ প্রায় ১৫ হাজার আফগান। তাদের ভাষ্য, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র মিশন ও ন্যাটোর সেনাদের সহযোগিতা করেছিল তারা।
যুক্তরাষ্ট্রে পুনর্বাসনের অনুমতি পাওয়ার জন্য পাকিস্তানে দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষায় থাকা এসব আফগান শরণার্থী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে বুধবার একটি চিঠি লিখেছে। চিঠিতে তারা তাকে আদেশটি বাতিলের আহ্বান জানিয়েছে।
এক প্রতিবেদনে বার্তাসংস্থা এপি জানিয়েছে, ২০২১ সালের আগস্টে তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলের পর আফগান শরণার্থী পুনর্বাসন কর্মসূচি হাতে নেয় যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন।
এই কর্মসূচিতে সেসব আফগানদের সহযোগিতা দেওয়ার কথা বলা হয়, যারা যুক্তরাষ্ট্রের সরকার, সংবাদমাধ্যম, সহায়তা সংস্থা ও মানবাধিকার সংস্থার সঙ্গে কাজ করার জন্য তালেবানের তোপের মুখে পড়ে।
কিন্তু সোমবার হোয়াইট হাউসে বসেই ট্রাম্প ঘোষণা দেন, আগামী ২৭ জানুয়ারি থেকে পরবর্তী অন্তত তিন মাস ওই পুনর্বাসন কর্মসূচি স্থগিত থাকবে।
হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে বলা হয়, পররাষ্ট্র দপ্তরের সঙ্গে পরামর্শ করে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি দপ্তর এই তিন মাসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে একটি প্রতিবেদন জমা দেবে। প্রতিবেদনে আফগান শরণার্থী পুনর্বাসন কর্মসূচি পুনরায় শুরু করলে তা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করবে কি না, তা উল্লেখ থাকবে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই পদক্ষেপের বিষয়ে পাকিস্তান সরকারের প্রতিক্রিয়া এখনও পাওয়া যায়নি।
পাকিস্তানে এখন সাড়ে ১৪ লাখ আফগান শরণার্থী রয়েছে। তারা সেখানে অনির্দিষ্টকাল থাকতে পারবে না, এই বার্তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অনেকবার দিয়েছে পাকিস্তান সরকার।
দেশটিতে আগে থেকেই নানা ধরনের সমস্যার মধ্যে আছে আফগান শরণার্থীরা। তার ওপর ট্রাম্পের আফগান শরণার্থী পুনর্বাসন কর্মসূচি স্থগিতের সিদ্ধান্ত তাদের আরও দুশ্চিন্তার মধ্যে ফেলেছে।
বুধবার তাদের পক্ষে ট্রাম্প, যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের সদস্য ও মানবাধিকার কর্মীদের কাছে খোলা চিঠি লেখে অ্যাডভোকেসি গ্রুপ আফগান ইউএসআরএপি রিফিউজিস।
চিঠিতে বলা হয়, “দোভাষী, ঠিকাদার, মানবাধিকার কর্মী হিসেবে আমাদের অনেকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র মিশনকে সহযোগিতা করেছিল।
“তালেবান আমাদের বিশ্বাসঘাতক হিসেবে দেখে। আফগানিস্তানে ফিরলে তারা আমাদের গ্রেপ্তার করবে। নির্যাতন করবে। মৃত্যুও হতে পারে আমাদের।
“এদিকে পাকিস্তানে আমাদের অবস্থা দিনকে দিন অসহনীয় হয়ে পড়ছে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি আমরা। এখানে আমাদের ইচ্ছেমতো গ্রেপ্তার করা হয়, দেশে জোর করে ফেরত পাঠানো হয়। এসব ঘটনা আমাদের দুঃখ-কষ্ট আরও বাড়িয়ে তুলেছে।”
পাকিস্তানে আতঙ্কে আফগানরা
গত মাসে কাবুল থেকে পাকিস্তানে পালিয়ে যান হাদিসা বিবি। সাবেক এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারেন, যুক্তরাষ্ট্রে আফগান শরণার্থী কর্মসূচি স্থগিত করেছেন ট্রাম্প।
তিনি এপিকে বলেন, “আফগানিস্তানে তালেবান নারী শিক্ষার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার আগে কাবুলে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম। ঝুঁকি নিয়ে নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করেছি।
“আশা ছিল, যুক্তরাষ্ট্রে দ্রুত পুনবার্সন করা হবে আমাকে। তেমনটা হলে আমি আরও পড়াশোনা করতে পারতাম। আমার ভবিষ্যৎ নিরাপদ ও উজ্জ্বল হতো।”
পাকিস্তানে তার চোখের সামনে বেশ কয়েকজন আফগান শরণার্থীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে বলে জানান হাদিসা। ভয়ে তিনি ঘরের ভেতর নিজেকে বন্দি করে রেখেছেন, এ কথাও বলেন।
হাদিসার মতোই আরেক আফগান শরণার্থী মাহনুশ মনির। আফগানিস্তানে একটি মেডিকেল কলেজে পড়তেন তিনি। ক্ষমতা দখলের পর সেই কলেজ বন্ধ করে দেয় তালেবান সরকার। এরপর তিনি একটি ভাষাশিক্ষা কেন্দ্রে পড়াতেন। সেটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়।
ট্রাম্পের সোমবারের আদেশ শুনে হতাশ হয়ে পড়েন মাহনুশ। তিনি বলেন, “আফগানিস্তানে কোনও মেয়ে বা নারীর পক্ষে নিরাপদে বেঁচে থাকার উপায় নেই।
“আমি ভাবিনি, যুক্তরাষ্ট্রে আফগান শরণার্থী পুনর্বাসন কর্মসূচি কোনোদিন স্থগিত হতে পারে। দেশটিতে পুনর্বাসনের জন্য দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানে অপেক্ষা করছি।
“এখানে আমার মতো আরও অনেকে হতাশ হয়ে পড়েছে। মনে হচ্ছে, হয় আমাদের একপর্যায়ে দেশে ফেরত পাঠানো হবে, নয় তো পাকিস্তানেই ঝুঁকি নিয়ে শরণার্থী হয়ে আরও অনেকদিন থাকতে হবে। এ দুটোই আমাদের জন্য দুঃস্বপ্নের।”
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, আফগানিস্তানের ১৪ লাখ মেয়ে তালেবানের নিষেধের কারণে স্কুলে যেতে পারছে না।
ট্রমায় শরণার্থীরা
যুক্তরাষ্ট্রে আফগান শরণার্থী পুনর্বাসন কর্মসূচি স্থগিতে ট্রাম্পের আদেশ শুনেছেন ফারজানা উমিদ।
ইসলামাবাদের উপকণ্ঠে বসবাসরত এই আফগান নারী বলেন, “খবরটি পেয়ে সারারাত কেঁদেছি। পাকিস্তানে থাকা আমার জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছে।”
ট্রাম্পকে সিদ্ধান্ত বদলের আহ্বান জানিয়ে ফারজানা বলেন, “আফগানিস্তানে ফেরার অর্থ নিজের জীবনকে অনেক ঝুঁকির মধ্যে ফেলা। আমি এখন কী করব?”
পাকিস্তানে বাস করা এই আফগান শরণার্থীদের নিয়ে বুধবার একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে ফ্রান্সভিত্তিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ)।
বিবৃতিতে বলা হয়, তালেবানের হাত থেকে বাঁচতে সাংবাদিকসহ যেসব আফগান পাকিস্তানে নির্বাসনে আছে, তারা সেখানে পুলিশি হয়রানি, মর্জিমাফিক গ্রেপ্তার ও দেশে ফেরত পাঠানোর আতঙ্কে আছে।
আফগান শরণার্থীরা শুধু পাকিস্তানে নয়, আলবেনিয়াতেও আছে। দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের এই দেশটিতে তাদের সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন হাজার।
২০২১ সালে তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর যুক্তরাষ্ট্রে পুনর্বাসনের আগে এক বছরের জন্য আফগান শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে রাজি হয়েছিল ন্যাটোর সদস্যরাষ্ট্র আলবেনিয়া। পরে অবশ্য তাদের আশ্রয় দেওয়ার সময় বাড়ায় সরকার।