মাদ্রিদ ছাড়বো শুনে ফেদেরিকোর চোখ কপালে উঠে গেল। ২৭ বছর বয়সী তরুণ স্প্যানিশের গায়ে জুড বেলিংহামের জার্সি। রিয়াল মাদ্রিদ নিয়ে আত্মবিশ্বাসে টইটুম্বুর। কোনও হিসাবেই তিনি বায়ার্ন মিউনিখের আপসেট ঘটানোর সুযোগ দেখেন না। বরং দুদিন আগে আমার মাদ্রিদ ছেড়ে যাওয়াটা যেন তার জন্য বড় ধাক্কা হয়ে গেল, “দুদিন পরেই বার্নাব্যুতে ফুটবল আনন্দের রাতটা উপভোগ না করে চলে যাবে! মাদ্রিদ সমর্থক হিসেবে এই ম্যাচটা তোমার দেখে যাওয়া কর্তব্য।”
“কর্তব্য” শব্দটা যুগপৎ হাসি ও উৎসুক করে তুলল। আমার কীসের কর্তব্য!
ফেদেরিকো: তুমি কি জানো না, আধুনিক ফুটবল শুধু দুই দলের মাঠের লড়াই নয়। দলের সাফল্যের পেছনে সমর্থকদেরও বড় ভূমিকা থাকে। খালি মাঠে খেলা হলে রিয়াল-বায়ার্ন ম্যাচের সম্ভাবনা ফিফটি-ফিফটি। ৮০ হাজার লস ব্লাঙ্কোস সমর্থকের শোরগোলেই চাপে পড়ে যাবে বায়ার্ন। তাদের চিৎকারে বার্নাব্যুতে একটা ম্যাজিকাল পরিবেশ তৈরি হবে। সমর্থক হিসেবে প্রত্যেকেই এটা অনুভব করে।
কিন্তু জার্মানি থেকেও তো অনেক সমর্থক আসছে। নিজেদের দলকে সমর্থন করতেই তারা আসছে দল বেঁধে। একটু দূরে বায়ার্নের জার্সি পরা এক জোড়া তরুণ-তরুণীকে দেখিয়ে ফেদেরিকো বলে ওঠেন, “তুমি নিশ্চত থাকো, তাদের কান্নাভেজা বিদায় হবে। ভাঙা মন নিয়ে তাদের মিউনিখ ফিরতে হবে।”
ম্যাকডোনাল্ডসের ভেতর থেকে ডাক পড়তেই আলাপে ইতি টানতে হয়েছে। ধন্যবাদ দেওয়ার পর তিনি আবার অনুরোধ করেন, “বন্ধু, জীবনে এমন ম্যাচ পাবে না। ম্যাচটা দেখে যাও।”
নানা বাস্তবতায় ফেদেরিকোর ওই অনুরোধ রাখা গেল না। ম্যাচটা আজ টেলিভিশনেই উপভোগ করতে হবে। তবে এই ম্যাচ নিয়ে পুরো মাদ্রিদে কী হচ্ছে, সেটা আঁচ করতে পারি।
শহরের সোলে (মাদ্রিদের প্রাণকেন্দ্র) নতুন মুখের ভীড় বেড়েছে। মাদ্রিদগামী ট্রেন-প্লেনের ভাড়া বেড়েছে। ওই সোল হলো আগন্তুকদের মিলনমেলার জায়গা যেখানে এবং তার আশপাশটা দেখেই পুরো মাদ্রিদের রং ধরা যায়।
মানে শহরে কী হতে যাচ্ছে বা হবে, সেটা স্পষ্ট হয়ে যায়। আজ চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনাল ঘিরে সেখানে গত দুদিনে বায়ার্ন মিউনিখের জার্সি পরা তরুণ-তরুণীদের সংখ্যা আরও বেড়েছে নিশ্চিতভাবে। আর অলি-গলি ছেয়ে গেছে রিয়ালের শ্বেত-শুভ্র জার্সিতে। বাংলাদেশি দোকানি জয়নাল হোসেনও বলেছিলেন, “এই দুই দিনে রিয়ালের জার্সির চাহিদা হয়ে যাবে দ্বিগুণ। দামও বেড়ে যাবে।”
সেটা ক্লাবের অফিসিয়াল স্টোরে গিয়ে দেখা গেছে, দেদারচে বিক্রি হচ্ছে ভিনি-বেলিংহামের জার্সি আর স্কার্ফ। একটা ম্যাচ ঘিরে এ কেমন উন্মাদনা!
স্প্যানিশরা আসলে ফুটবলে এমনই আসক্ত যে এর সঙ্গে অন্য কিছুর তুলনা হয় না। মাদ্রিদে আরেকটি ক্লাব আতলেতিকো মাদ্রিদ থাকলেও সান্তিয়াগো বার্নাব্যু ঘিরে আছে এক মায়াবী আকর্ষণ ও মিথ। রিয়ালের সমর্থকরা বিশ্বাস করেন, “এখানে লস ব্লাঙ্কোস হারতে পারে না। দলের ওপর এই স্টেডিয়ামের অবিশ্বাস্য প্রভাব আছে।” বার্নাব্যুর সেই ম্যাজিকেই তারা সর্বশেষ চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছে ২০২২ সালে। নকআউটে হোম ম্যাচে একের পর এক অবিশ্বাস্য কীর্তি গড়ে ফাইনালে উঠেছিল।
বিশেষ করে সেমিফাইনালে পেপ গার্দিওলার ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে শেষ ৬ মিনিটে ৩ গোল করে রিয়াল মাদ্রিদ ফাইনালে ওঠার দুর্দান্ত কীর্তিগাঁথা রচনা করেছিল এই বার্নাব্যুতে।
এই স্টেডিয়াম একদম শহরের ভেতরে আর ফুটবল নিয়ে স্প্যানিশদের আগ্রহের অন্ত নেই। খেলার দিন হয়ে ওঠে জটের শহর, এরপরও লোকজনের কোনও আপত্তি নেই। আশেপাশের দোকানিদেরও কোনও বিরক্তি নেই, বরং টিকিটহীন সমর্থকরা স্টেডিয়ামের পাশে পাবে-রেস্তোরাঁয় বসে চুটিয়ে খেলা উপভোগ করে। আজও নিশ্চয় সেই পাবগুলোতে সমর্থকরা হুল্লোড় তুলবে, ‘ওলা মাদ্রিদ’ বলে বিয়ারে চুমুক দেবে।
বায়ার্ন মিউনিখও যে বার্নাব্যুর ম্যাজিক থামাতে চায়। মিউনিখে সেমিফাইনালের প্রথম লেগ ২-২ গোলে ড্র হওয়ার পর ফিরতি ম্যাচে চমকে দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই বার্নাব্যুতে এসেছে বাভারিয়ানরা। হ্যারি কেইন নিশ্চয় চাইবেন চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালের মঞ্চে আরোহণ করতে। উল্টোদিকে একই স্বপ্ন তার স্বদেশি জুড বেলিংহাম আর ভিনি-রোদ্রিগোর ম্যাজিক্যাল ব্রাজিলিয়ান জুটির।
এদের চেয়েও বেশি ম্যাজিক যেন লুকিয়ে আছে বার্নাব্যুতে। এ যে আজ কী উপহার দেবে, কেউ বলতে পারে না।