অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে নাম ঘোষণা হতেই ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলা বিপুল আলোচনা আর ট্রলের মধ্যেই রবিবার বঙ্গভবনে অন্য দুই উপদেষ্টার সঙ্গে শপথ নেন তিনি। তবে এতে থামেনি তার নিয়োগ নিয়ে সমালোচনা।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের সুবিধাভোগী, কয়েকজন মন্ত্রীর সঙ্গে প্রকাশ্যে সুসম্পর্ক রাখা, স্ত্রী অভিনেতা নুসরাত ইমরোজ তিশার ‘মুজিব’ চলচ্চিত্রে অভিনয়সহ অর্থপাচারে অভিযুক্ত জাজ মাল্টিমিডিয়ার অর্থায়নে সিনেমা তৈরিসহ বেশ কিছু অভিযোগ ঘুরে-ফিরে আসছে ফারুকীর বিরুদ্ধে।
উপদেষ্টা ফারুকীর বিরোধিতাকারীদের তালিকায় যেমন রয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমর্থকরা, তেমনি আছেন সাধারণ মানুষও।
এমন বাস্তবতায় অনেকটা আত্মপক্ষ সমর্থন করেই ফেইসবুকে নিজের ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্টে একটি পোস্ট দিয়েছেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়া মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।
দুদিনের কাজের অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, “আমি মাত্রই দুই দিন হলো কাজ করছি। এর মধ্যে আমার ধারণা আমার মন্ত্রণালয়ের সহকর্মীদের মাঝে এই ধারণা দিতে পেরেছি যে আমরা কিছু দৃশ্যমান পরিবর্তন ঘটাতে চাই যেটা স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদে আমাদের সংস্কৃতিকর্মীদের কাজে আসবে।”
কোনও পদ চাননি উল্লেখ করে ফারুকী লিখেছেন, এরপরেও যখন দায়িত্ব পেয়েছেন তখন নিজের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে তা পালনের চেষ্টা করছেন।
তাকে ফ্যাসিবাদের দোসর আখ্যা দেওয়ায় বিস্ময়ও প্রকাশ করেন ফারুকী।
পোস্টে তিনি এ অভিযোগকে অবিশ্বাস্য উল্লেখ করে লিখেছেন, “যেই ফ্যাসিস্টকে তাড়ানোর জন্য জীবনের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পাশে দাঁড়ালাম ১৬ জুলাই থেকে, অল আউট অ্যাটাকে গেলাম এটা জেনে যে ফ্যাসিস্ট হাসিনা টিকে গেলে আমার জন্য অপেক্ষা করছে মৃত্যু অথবা জেল, আমি তারই সহযোগী?”
উপদেষ্টা পদের জন্য সাফাই দেওয়ার প্রয়োজন মনে করছেন না জানিয়ে তিনি লিখেছেন, “কিন্তু শিল্পী হিসাবে অপমানিত বোধ করেছি বলেই কয়টা কথা বলছি।
“শাহবাগ আন্দোলন যখন শুরু হয় আর সবার মত আমিও ভেবেছিলাম এটা নির্দলীয়। যে কারণে আমার সব পোস্টে এটাকে ঠেলে ‘রাষ্ট্র মেরামতে’ এজেন্ডার দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু কিছুদিন পরেই যখন বুঝে যাই, তখনই লিখি ‘কিন্তু এবং যদির খোঁজে’। যে কিন্তু এবং যদি শাহবাগ নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল। বাঙালী জাতীয়তাবাদ আর ইসলামকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়ে আজকের যে ফ্যাসিবাদের সূচনা করা হয়েছিল তার প্রতিবাদে লিখি, ‘এই চেতনা লইয়া আমরা কি করিব’, ২০১৪ সালে।”
এ দুটি লেখার কোনও একটির জন্য বিএনপি নেতা শিমুল বিশ্বাস কৃতজ্ঞতা জানাতে টেলিফোন করেছিলেন বলে জানান ফারুকী। তিনি বলেন, “আমি কোনও দল করি না। কিন্তু আমি আওয়ামী লীগ হলে বিএনপির একজন সিনিয়র নেতা আমার লেখায় কী খুঁজে পেলেন যে আমার সঙ্গে পরিচয় না থাকা স্বত্বেও নম্বর জোগাড় করে ফোন দিলেন?
“আমি ঘটনাচক্রে একজন পরিচিত মুখ, ভাই ও বোনেরা। একজন লেখক যতটা স্বাধীনভাবে লিখতে পারেন, ফ্যাসিবাদের কালে আমার সেই স্বাধীনতা পাওয়ার সুযোগ ছিল না। তার মধ্যেও যতোটুকু করেছি তার ফলও আমাকে ভোগ করতে হয়েছে। ২০১৫ সালে সেন্ট্রাল ইনভেস্টিগেশন সেলের হেনস্তার শিকার হওয়ার মধ্যে যে দীর্ঘ অত্যাচারের শুরু। সেই বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে আমার সিমপ্যাথি পাওয়ার ইচ্ছা এবং প্রয়োজন নেই।”
সমালোচনার অংশ হিসেবে ফারুকীকে ভারতীয় হেজেমনির অংশ বলে অভিযুক্ত করা হচ্ছে জানিয়ে তার জবাবও দিয়েছেন ফারুকী।
তিনি বলেন, “যে লোককে বাংলাদেশের কালচারাল এস্টাবলিশমেন্ট ঘৃণা করে আমি কলকাতাকেন্দ্রিক ভাষার হেজেমনি ভেঙ্গে দিয়েছি বলে, সে-ই কিনা এই হেজেমনির অংশ!!! আমি পৃথিবীর কোনও দেশেরই ঢালাও নিন্দা করি না। কারন দেশে নানা চিন্তার মানুষ থাকে। আমি সবার সাথেই কথা বলতে চাই, কাজ করতে চাই। কিন্তু আমার দেশের ক্ষতি হলে, আমি তার বিরুদ্ধে বলতে কুণ্ঠা করি না।
“ফেলানীর মৃত্যুর পর কী পোস্ট দিয়েছিলাম ২০১৩ সালে সেটা দেখতে পারেন নীচে।”
এই পোস্টের সঙ্গে পুরোনো সেই পোস্টের একটি ছবিও জুড়ে দিয়েছেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।
এই ছবির কারণে ভারতীয় হাই কমিশনে একসময় কর্মরত রঞ্জন মন্ডল নামের এক কর্মকর্তা নিজের ফেইসবুকে তাকে অকথ্য ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন বলেও জানান তিনি।
ফারুকী বলেন, “আর সেই আমি পার্ট অব হেজেমনি? আমরা এক অনন্ত ভয়ের ঘরে বাস করে এসেছি। আমরা কথা বলতে ভয় পেতাম। এমন কি কথা বলার সময় ঘরে ফোন থাকলে সরিয়ে ফেলতাম। পাছে আড়ি পাতে। আমার মনে আছে ২০১২ সালে শুধুমাত্র কথা বলার জন্য আমি এবং আরিফ আর হোসাইন লুকিয়ে আমেরিকান ক্লাবে গিয়ে বসে আলাপ করতাম কীভাবে এই জালিম সরকারকে হটানো যায়। বিএনপি এবং জামাত কিছু করতে পারবে? আর্মির মনোভাব কী? জোনায়েদ সাকির সাথে বাটন ফোনে কথা বলে গোপনে দেখা করতাম আর পরামর্শ করতাম কী করা যায়। সেই আমি আওয়ামী ফ্যাসিজমের পার্ট?”
কোনোদিন বিপ্লবী ছিলেন না জানিয়ে ফারুকী বলেন, “আমি ফিল্মমেকার। ঘটনাচক্রে এবং আল্লাহর রহমতে মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। আমি আমার সেই পরিচয়েই গর্বিত। আমি মারা গেলে আমাকে ফিল্মমেকার হিসাবেই মনে রাখা হবে, মন্ত্রী হিসাবে না। ফলে মন্ত্রিত্ব আমার কাছে কোনও অর্জন না, পাবলিক সারভেন্টের দায়িত্ব মাত্র।
“আমি এটা ফাইনালি অ্যাকসেপ্ট করেছি নিজের ফিল্মের বাইরেও আমার দেশকে কিছু দেওয়ার ক্ষমতা আল্লাহ দিয়েছে-এটা বিশ্বাস করেছি বলে। আমার মনে হয়েছে, জীবনের এই পর্যায়ে এসে নিজের লাভ-ক্ষতি না ভেবে এই ক্ষমতা দেশের কাজে লাগাই।”
সবশেষে ফারুকী জানিয়েছেন, নিজের কাজকে ভালোবাসছেন তিনি। তবে আত্মপক্ষ সমর্থন করে এত কিছু লিখতে হলো বলে, দুঃখও প্রকাশ করেছেন।