ফিলিস্তিনের গাজা ভূখণ্ডে ইসরায়েলি আগ্রাসন দ্বিতীয় বছরে প্রবেশ করেছে। অন্যদিকে অধিকৃত পশ্চিম তীরেও দখলদারিত্ব বাড়াচ্ছে ইসরায়েল।
এমন পরিস্থিতিতে গাজাসহ ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের দায়ে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্তের বিরুদ্ধে বুধবার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি)।
তুরস্কের সংবাদমাধ্যম আনাদোলুর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজায় গণহত্যার জন্য ইসরায়েলকে দায়বদ্ধ করার চলমান প্রচেষ্টায় এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি।
আইসিসির প্রি-ট্রায়াল চেম্বার বলেছে, “২০২৩ সালের ৮ অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ২০ মে পর্যন্ত সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের ভিত্তিতে এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। আইসিসির প্রসিকিউশন ২০ মে এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির জন্য আবেদন করেছিল।”
আইসিসি রোম স্ট্যাটিউটের ধারা ১৮ ও ১৯ অনুযায়ী ইসরায়েলের অধিকার নিয়ে যে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছিল তাও এককভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। রোম স্ট্যাটিউট হল আইসিসি প্রতিষ্ঠাকালীন সনদ।
নেতানিয়াহু ও গ্যালান্তের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে আইসিসি বলেছে, তাদের বিরুদ্ধে ‘গ্রহণযোগ্য প্রমাণ মিলেছে’ যে তারা যৌথভাবে একাধিক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের জন্য দায়ী, যার মধ্যে রয়েছে যুদ্ধের অস্ত্র হিসাবে অনাহারে রাখার কৌশল ব্যবহারের মতো যুদ্ধাপরাধ এবং হত্যা, নিপীড়ন এবং অন্যান্য অমানবিক কাজের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ।
আইসিসি হামাসের শীর্ষ নেতা মোহাম্মদ দিয়াব ইব্রাহিম আল-মাসরি, যিনি মোহাম্মদ দেইফ নামে পরিচিত, তার বিরুদ্ধেও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। ইসরায়েল দাবি করেছে, গত জুলাইয়ে দক্ষিণ গাজায় বিমান হামলায় দেইফ নিহত হয়েছে। তবে হামাস এখনও তার মৃত্যু নিশ্চিত করেনি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তাদের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত করেছে। আর এটি পশ্চিমাদের কোনও মিত্রদেশের নেতাদের বিরুদ্ধে আইসিসির প্রথম গ্রেপ্তারি পরোয়ানা।
আইসিসির এই ঘোষণার ফলে নেতানিয়াহু ও গ্যালান্ত বেশ বিপাকেই পড়েছেন। এখন আইসিসি সনদে স্বাক্ষরকারী ১২৪টি দেশের কোনোটিতে তারা পা রাখলে ওই দেশ তাদের গ্রেপ্তার করে আইনি প্রক্রিয়ার জন্য হস্তান্তর করতে বাধ্য হবে।
এই ১২৪টি দেশের মধ্যে ইসরায়েলের শক্তিশালী পশ্চিমা মিত্র রাষ্ট্রগুলোও রয়েছে, যারা ইসরায়েলকে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে তার অপরাধগুলো চালাতে অস্ত্র এবং কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে আসছে। যেমন- যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ইতালি, নেদারল্যান্ডস ও নরওয়ে।
ইসরায়েলি নেতাদের জন্য আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইউরোপীয় দেশও নিষিদ্ধ হবে। যেমন- স্পেন, সুইজারল্যান্ড, ডেনমার্ক, ক্রোয়েশিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, ফিনল্যান্ড, হাঙ্গেরি, পর্তুগাল ও পোল্যান্ড।
এ ছাড়াও আইসিসিতে স্বাক্ষরকারী আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ দেশ হল- গ্রিস, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, দক্ষিণ আফ্রিকা, নাইজেরিয়া, মেক্সিকো, কেনিয়া, কলম্বিয়া ও ব্রাজিল।
এখানে একটি বড় ব্যতিক্রম হলো যুক্তরাষ্ট্র, যা ২০০২ সালে রোম স্ট্যাটিউট থেকে বের হয়ে গেছে। এর মানে, যুক্তরাষ্ট্র আইনগতভাবে নেতানিয়াহু ও গ্যালান্তের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নিতে বাধ্য নয়।
তবে আইসিসি আইন অনুযায়ী, যেহেতু অ-রাষ্ট্রীয় পক্ষগুলোকে বাধ্যতামূলক দায়িত্ব দেওয়া হয়নি, তবুও তাদের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বাস্তবায়ন করতে “উৎসাহিত” করা হচ্ছে, কারণ এই আদেশ বাস্তবায়নে আইসিসির নিজস্ব কোনও প্রক্রিয়া নেই।
আইসিসির একটি ম্যানুয়ালে বলা হয়েছে, সনদে স্বাক্ষর করেনি এমন কিছু দেশ অতীতে অপরাধীদের হস্তান্তরের ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে।
ডকুমেন্টে আরও বলা হয়েছে, “তবে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ যখন কোনও পরিস্থিতিতে আদালতের বিচারিক ক্ষমতা সক্রিয় করে, তখন সহযোগিতা করার দায়িত্ব জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ওপরও বর্তায়। তারা রোম স্ট্যাটিউটের সদস্য রাষ্ট্র হোক বা না হোক।”
‘পশ্চিমে ইসরায়েলের মিত্ররা চাপের মুখে পড়বে’
আইসিসির গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির সিদ্ধান্তটি ‘একাধিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ’ বলে মন্তব্য করেছেন আইন বিশেষজ্ঞ গেরহার্ড কেম্প। তিনি আনাদোলু নিউজ এজেন্সিকে জানিয়েছেন, এই সিদ্ধান্ত পশ্চিমা দেশের ইসরায়েলের মিত্রদের ওপর চাপ তৈরি করবে, যারা গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার পরেও ইসরায়েলকে সমর্থন দিয়ে আসছে।
তিনি বলেন, ”এটি পুনঃপ্রমাণিত করেছে যে, আইসিসি ফিলিস্তিন পরিস্থিতি নিয়ে বিচারিক ক্ষমতা রাখে। তারা ইসরায়েলের ভূখণ্ডগত অধিকার নিয়ে চ্যালেঞ্জগুলো প্রত্যাখ্যান করেছে। সংঘাতের প্রকৃতি— আন্তর্জাতিক সশস্ত্র সংঘাত এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের প্রযোজ্যতা ইত্যাদি— নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ করেছে। প্রাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের শক্তি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছে।”
তিনি আরও বলেন, “সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এটি আইসিসির একটি নীতি নিশ্চিত করেছে যে, সরকারি পদমর্যাদা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বাস্তবায়ন এবং উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের আইসিসিতে বিচারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। এক্ষেত্রে যার মধ্যে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীও অন্তর্ভুক্ত।”
গেরহার্ড কেম্প বলেন, “সুদানের ওমর আল-বশির এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মতো নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও আইসিসির সদস্য দেশগুলো, বিশেষ করে পশ্চিমা সদস্য রাষ্ট্রগুলো, যেমন জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের জন্য বড় কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।”
কেম্প বলেন, “আইসিসি সনদে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর আইনি দায়িত্ব রয়েছে ঠিক। কিন্তু সদস্য রাষ্ট্রগুলো তাদের দায়িত্ব পালনে রাজনৈতিক বাধা অনুভব করে। অতীতে আমরা বশিরের ক্ষেত্রে যেমনটা দেখেছি— দক্ষিণ আফ্রিকা, জর্ডান এবং অন্যান্য দেশ তার গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছিল। আর সাম্প্রতিক সময়ে মঙ্গোলিয়া পুতিনকে গ্রেপ্তারে ব্যর্থ হয়।”
তিনি বলেন, “আমার ধারণা, ইউরোপীয় দেশগুলো এবং পশ্চিমের অন্যান্য ঐতিহ্যগত ইসরায়েলি মিত্ররা এ বিষয়ে দ্রুত অবস্থান গ্রহণে চাপের মুখে পড়বে যে, প্রয়োজন হলে তারা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বাস্তবায়ন করবে কিনা।”