জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে শেখ হাসিনা সরকারের সাবেক মন্ত্রী, উপদেষ্টা, সাবেক বিচারক ও সচিবসহ ১৩ জনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত কারাগারে রাখার নির্দেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
শেখ হাসিনাসহ সব আসামির বিরুদ্ধে ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটির’ অভিযোগ আনা হয়েছে। সেই অভিযোগের তদন্ত করে এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার আদেশ হয়েছে।
সোমবার বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল এ আদেশ দেয়। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য হলেন– বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
এসব আসামি অন্যান্য মামলায় আগেই গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে ছিলেন। তাদেরকে সকাল পৌনে ১১টায় ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।
তারা হলেন- সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক মন্ত্রী ফারুক খান, দীপু মনি, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, শাজাহান খান, গোলাম দস্তগীর গাজী, সাবেক প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার ও জুনাইদ আহমেদ পলক, আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, সাবেক প্রধানন্ত্রীর উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী ও সালমান এফ রহমান এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিব জাহাঙ্গীর আলম।
গ্রেপ্তার থাকা আরেক আসামি সাবেক কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক টাঙ্গাইলে একটি মামলায় পুলিশ হেফাজতে থাকায় তাকে উপস্থিত করা হয়নি।
প্রধান আসামি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরাতে প্রসিকিউশন থেকে ইন্টারপোলে আবেদন জানানোর পাশাপাশি এ বিষয়ে ভারতের কাছে বহিঃসমর্পণ চুক্তির আওতায় সরকার পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে আদালতকে জানান প্রধান প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ২ মাস সময়ে চেয়ে প্রসিকিউশনের আবেদনে এক মাস সময় দিয়ে আগামী ১৭ ডিসেম্বর পরবর্তী তারিখ ঠিক করেছে ট্রাইব্যুনাল।
ওইদিন গ্রেপ্তার থাকা আসামি এবং এ মামলায় পরোয়ানার আওতায় থাকা অন্যান্য আসামিদের গ্রেপ্তার করে ট্রাইব্যুনালে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জুলাই আন্দোলনে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সেজন্য ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়।
এরপর গত ১৭ অক্টোবর দুই মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা এবং দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল।
সেই আদেশে নির্ধারিত তারিখ সোমবার সকালে ১৩ আসামিকে কঠোর নিরাপত্তা বলয়ে দুটি প্রিজন ভ্যানে করে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। পরে পৌনে ১১টায় তাদেরকে এজলাসে তোলা হয়।
এজলাসের কাঠগড়ায় দুই সারিতে ১২ জনকে চেয়ারে বসানো হয়। তবে দীপু মনিকে কাঠগড়ার বাইরে একটি চেয়ারে বসতে দেওয়া হয়।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা। এরপর থেকে তিনি সেখানেই অবস্থান করছেন।
অন্যদিকে ৫ আগস্টের পর থেকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের খোঁজ নেই। তিনি দেশেই আছেন নাকি দেশত্যাগ করেছেন, সে বিষয়েও কোনও তথ্য নেই সরকারের কাছে।
পটভূমি তুলে ধরেন প্রধান প্রসিকিউটার
ট্রাইব্যুনালের কাছে জুলাই-আগস্টের আন্দোলনকে ঘিরে আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃস্থানীয় নির্দেশে হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটের নানা অভিযোগ তুলে ধরেন প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল।
জুলাই-আগস্ট আন্দোলন দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নানা কর্মকাণ্ড ছাড়াও আওয়ামী লীগ সরকারের পূর্ববর্তী সময়ে সংঘটিত মানবতাবিরোধী নানা ‘অপরাধের’ বিষয়ে তদন্ত সংস্থার একটি প্রতিবেদন বিচারকদের সামনে উপস্থাপন করেন তিনি।
অপরাধের পটভূমি তুলে ধরে তাজুল বলেন, “২০০৯ সাল থেকে একটা রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহারের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে সমস্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনীতিকরণ, দলীয়করণ এবং পারিবারিকীকরণের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক দেশকে একটা ফ্যাসিবাদী ও নিপীড়ক রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছিল।
“একটা রাষ্ট্র ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন সময় হত্যা করে, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হয়েছে। শাপলা চত্বরে হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে প্রতিবাদী জনতাকে স্তব্ধ করা হয়েছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের মাধ্যমে মানুষের বাকস্বাধীনতা, অন্যায় ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে যে ভয়েস, সেটাকে রুদ্ধ করা হয়।”
প্রধান প্রসিকিউটর বলেন, “শুধু একজন ব্যক্তি শেখ হাসিনাকে এবং তার পরিবারকে ক্ষমতায় রাখার উদ্দেশ্যে এগুলো করা হয়। একটা রাষ্ট্রের চেতনার বিরুদ্ধে তারা অবস্থান নিয়েছিলেন।”
প্রধান আসামি শেখ হাসিনার ওপর সমস্ত অপরাধের বড় দায় পড়ে দাবি করে তাজুল বলেন, “তার নির্দেশে তাকে ক্ষমতায় রাখার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য যে ১৩ জনকে উপস্থিত করা হয়েছিল, তারা মন্ত্রিপরিষদের সদস্য হিসাবে, সরকারি দলের বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত থেকে, আমলাতন্ত্রের মধ্যে থেকে, সংসদ সদস্য এবং ১৪ দলের নেতা, সবাই মিলে নৃসংশভাবে অপরাধ করেছেন।”
জুলাই-আগস্ট আন্দোলন দমাতে সরকারি বাহিনী ও তাদের সহযোগিদের দ্বারা দেড় হাজারের অধিক ছাত্র-তরুণ-জনতাকে হত্যা এবং ২৫ হাজারের বেশি মানুষকে আহত করা হয়েছে বলে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেন চিফ প্রসিকিউটর।
তিনি বলেন, “গোটা বাংলাদেশ জুড়ে নৃশংসতা চালানো হয়েছে, সাধারণ মানুষকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে। হত্যার পর লাশ দাফনে বাধা দেওয়া হয়, লাশ পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, আহতদের চিকিৎসা দিতে বাধা দেওয়া হয়েছে। টার্গেট করে সেগুলো করা হয়েছে।”
তাজুল বলেন, শুধু জুলাই-আগস্টেই কেবল মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়নি, বরং বিগত সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই গুম, খুন এবং আয়না ঘরে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে, তদন্ত সংস্থার মাধ্যমে এসবের তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাচ্ছে।
যে ১৩ জনকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়, তাদের বিরুদ্ধে ‘মোটাদাগে সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটির’ দায়ে তারা অভিযুক্ত মন্তব্য করে তাজুল বলেন, “কারণ তারা নির্দেশ দিয়েছেন, পরিকল্পনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, সরাসরিও জড়িত ছিলেন। স্বরাষ্ট্র সচিব, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তারা সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন।
“আন্তর্জাতিক আইনে প্ররোচনা দেওয়া, পরিকল্পনার সঙ্গে থাকা, যারা সরাসরি অংশ নিয়েছে তাদের শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা থাকা সত্বেও শাস্তি না দেওয়া, এগুলো অপরাধ। এ অপরাধের দায় প্রত্যেক আসামির ওপর আছে।”
শেখ হাসিনা, তার মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, উপদেষ্টা পরিষদ, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, আমলাসহ আওয়ামী লীগ এবং ১৪ দলের নেতাদের ওপর এর দায় পড়ে, বলেন তিনি।
‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি’
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সেখানে বিচারে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযম ও মতিউর রহমান নিজামীর সাজা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিবেচ্য ছিল ‘সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটি’।
বিচারে গোলাম আযমের ৯০ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। সেই সাজা খাটার সময় কারাগারেই তার মৃত্যু ঘটে। জামায়াতের সাবেক আরেক আমির নিজামীর মৃত্যুদণ্ড হয়।
গোলাম আযমের মামলার রায়ে বলা হয়েছিল, মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের কোনও ঘটনাস্থলে আসামি উপস্থিত ছিলেন, এমন প্রমাণ নেই। এখানে তার দায় সুপিরিয়র কমান্ড রেসপনসিবিলিটির। কারণ এটা স্বীকৃত যে গোলাম আযম ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমির ছিলেন। তিনি শান্তি কমিটির প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। তাই জামায়াতের সদস্যরা প্যারামিলিশিয়া বাহিনীতে যোগ দিয়ে হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন, নির্যাতন, ধর্ষণসহ যেসব অপকর্ম করেছিলেন, এসব অপরাধের দায়-দায়িত্ব তার।
মতিউর রহমান নিজামীকেও বুদ্ধিজীবী হত্যায় একাত্তরে আল বদর বাহিনীর প্রধান হিসাবে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি হিসাবে দোষি সাব্যস্ত করে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটরের দায়িত্ব পাওয়া তাজুল তখন জামায়াত নেতাদের আইনজীবী ছিলেন।
শুনানি করেননি সমাজী
ট্রাইব্যুনালের তিন বিচারক সোমবার সকাল ১১টায় এজলাসে উপস্থিত হলে তখন প্রধান প্রসিকিউটরের নেতৃত্বে প্রসিকিউশনের সদস্যদের পাশাপাশি আসামিদের পক্ষে কয়েকজন আইনজীবীকে ওকালতনামা দাখিল করতে দেখা যায়। তাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী, আজিজুল হাসান দুলু, মো. আবুল হাসানসহ আরও কয়েকজন ছিলেন।
এ সময় ট্রাইব্যুনালের উদ্দেশে প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল বলেন, “আমি দেখতে পাচ্ছি, ডিফেন্স পক্ষে এহসানুল হক সমাজী ওকালতনামা জমা দিয়েছেন। আমি অনানুষ্ঠানিকভাবে জানতে পেরেছি, উনাকে (সমাজী) রাষ্ট্রীয় একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। ২/১ দিনের মধ্যেই হয়ত সরকার প্রজ্ঞাপন জারি করবে। তাই তিনি আসামিপক্ষে শুনানি করলে এটা হবে ‘কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট’।”
তাজুল আসামিপক্ষে শুনানি না করতে আইনজীবী সমাজীকে অনুরোধ জানান।
তখন এহসানুল হক সমাজী বলেন, “চিফ প্রসিকিউটর যে বিষয়টি তুলেছেন, তা আমার জানা নেই। যেহেতু তিনি একটি প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, আমি আপাতত শুনানি করব না।”
আইনজীবী সমাজী পাঁচ আসামির পক্ষে এসেছিলেন বলেন জানান। তারা হলেন- আনিসুল হক, শাজাহান খান, ফারুক খান, রাশেদ খান মেনন, কামাল আহমেদ মজুমদার ও তৌফিক-ই-ইলাহী।
আসামিদের পক্ষে তিন আইনজীবী ওকালতনামা দাখিল করলেও কোনও বক্তব্য রাখেননি। তবে ফারুক খান ও তৌফিক ইলাহীর আরেক আইনজীবী আজিজুল হাসান দুলু আসামিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের অনুলিপি সরবরাহের আবেদন জানান। তখন প্রসিকিউশনকে সব আসামির আইনজীবীদেরকে তা সরবরাহ করতে নির্দেশ দেয়।
এদিকে আইনজীবী আবুল হাসান আসামিদের সঙ্গে কথা বলার জন্য এবং পরিবারের সদস্যদের দেখা করার জন্য আদালতের কাছে অনুরোধ জানান। তখন আদালত শৃঙ্খলা রক্ষা করে রেজিস্ট্রারের তত্ত্বাবধানে আসামিদের সঙ্গে দেখা করা এবং কথা বলার অনুমতি দেয় ট্রাইব্যুনাল।