ওষুধ, মোবাইল ফোনের টকটাইমসহ আট পণ্য ও সেবায় নতুন আরোপিত ভ্যাট-কর প্রত্যাহারের কথা ভাবলেও তা থেকে সরে আসতে সরকারের ওপর আইএমএফের চাপ রয়েছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এক কর্মকর্তা।
সকাল সন্ধ্যাকে তিনি বলেছেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলেছে- ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে এলে রাজস্ব আহরণ কমে যাবে। এতে আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাটির দেওয়া শর্ত ভঙ্গ হবে এবং বাংলাদেশে ঋণ কার্যক্রমও বাধাগ্রস্ত হবে।
এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান সকাল সন্ধ্যাকে জানিয়েছেন, ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কমাতে সরকারের মনোভাব ইতিবাচক রয়েছে। প্রস্তাবটা এখনও চূড়ান্ত হয়নি।
ওই আট পণ্য ও সেবার মধ্যে আরও আছে- ইন্টারনেট সার্ভিস প্রভাইডার (আইএসপি) সেবা, ব্র্যান্ড ও নন ব্র্যান্ডের পোশাক, নন-এসি হোটেল, মোটর গ্যারেজ ও ওয়ার্কশপ ও মিষ্টি।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট সামাল দিতে ২০২৩ সালের ৩০ জানুয়ারি ৪৭০ কোটি (৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন) ডলারের ঋণ অনুমোদন করে আইএমএফ। সেজন্য অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নানা সংস্কারের শর্ত বাংলাদেশকে বাস্তবায়ন করতে হচ্ছে।
রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ঘাটতির মুখে পড়েছে সরকার। অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪২ হাজার কোটি টাকা পিছিয়ে।
এই ঘাটতি মেটাতেই চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মাঝপথে এসে গত জানুয়ারি শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়ায় সরকার। এর মধ্যে রেস্তোরাঁ সেবায় ভ্যাট হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়।
মূল্যস্ফীতি যখন দুই অঙ্কের কোঠায়, তখন শতাধিক পণ্য ও সেবায় ভ্যাট-কর বাড়ানোর এই পদক্ষেপের সমালোচনা করছেন অর্থনীতিবিদরা। ব্যবসায়ী মহল থেকেও উঠেছে বিরোধিতা। বাংলাদেশে রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি তা ঠেকাতে সেদিনই অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটের হুমকি দেয়।
ওই আদেশে ওষুধ, এলপি গ্যাস, গুঁড়ো দুধ, বিস্কুট, আচার, সস, সিগারেট, জুস, টিস্যু পেপার, ফলমূল, সাবান, ডিটারজেন্ট পাউডার, মিষ্টি, চপ্পল (স্যান্ডেল), বিমান টিকেটসহ শতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর বিভিন্ন স্তরে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়।
হোটেল-রেস্তোরাঁর মালিক কর্মচারীদের আন্দোলনের মুখে গত ১৬ জানুয়ারি (বৃহস্পতিবার) এই খাতের ভ্যাট আগের মতো ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। একইদিন ওষুধসহ আরও আট পণ্য ও সেবার ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কমানোর বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের কথা জানায় এনবিআর।
এনবিআরের ওই কর্মকর্তা রবিবার সকাল সন্ধ্যাকে জানান, এনবিআর জনসমক্ষে রেস্তোরাঁ সেবার ওপর ভ্যাট ছাড়ের ঘোষণা দেওয়ায় এই ঘোষণা কার্যকর থাকবে।
তিনি বলেন, গত বৃহস্পতিবার (১৬ জানুয়ারি) এনবিআরের পক্ষ থেকে রেস্তোরাঁ সেবা ছাড়া আরও আট পণ্যের ওপর থেকে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক কমানোর প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছিল। এমনকি সেই প্রস্তাব ভেটিংয়ের জন্যও পাঠানোর কথা ছিল।
“কিন্তু আইএমএফের চাপের মুখে এখন জনগুরুত্বপূর্ণ এসব খাতের ওপর থেকে ভ্যাট ও শুল্ক কমানোর নতুন প্রস্তাবটা ভেস্তে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।”
এনবিআরের ওই কর্মকর্তা বলেন, “আমরা গত বৃহস্পতিবার মোবাইল টকটাইমের ওপর ২৩ শতাংশ ভ্যাট ২০ শতাংশে নামিয়ে আনা, ইন্টারনেট সার্ভিস প্রভাইডারের (আইএসপি) ওপর প্রথমবারের মতো ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার, ব্র্যান্ড ও নন ব্র্যান্ড পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা এবং ওষুধের ওপর আরোপিত ভ্যাট ৩ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৪ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রস্তাব তৈরি করেছিলাম। এছাড়া নন-এসি হোটেল, মোটর গ্যারেজ ও ওয়ার্কশপ এবং মিষ্টি বিক্রির ওপর থেকে অতিরিক্ত ভ্যাট আদায়ের আদেশ প্রত্যাহারের প্রস্তাব তৈরি করে এনবিআর।
“কিন্তু আইএমএফ ওই প্রস্তাবের বিরোধিতা করছে। তারা আমাদের বলেছে গত ৯ জানুয়ারি নতুন করে যে ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানো হয়েছে তা কার্যকর হলে দেশের রাজস্ব আহরণ পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে। এখন সেখান থেকে পিছিয়ে আসলে রাজস্ব কমে যাবে এবং আইএমএফের শর্ত ভঙ্গ হবে। এবং শর্ত ভঙ্গ হলে আইএমএফের ঋণ কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে।”
আইএমএফ এরই মধ্যে তিন কিস্তিতে ২ দশমিক ৩১ বিলিয়ন ডলার ছাড় করেছে। ধাপে ধাপে শর্তপূরণ সাপেক্ষে ২০২৬ সাল পর্যন্ত মোট সাত কিস্তিতে ঋণের পুরো অর্থ পাওয়ার কথা বাংলাদেশের।
ঋণের কিস্তি চলার মধ্যেই বাংলাদেশে ঘটে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন। ৮ আগস্ট দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। নানা কারণে সঙ্কটে থাকা অর্থনীতিতে গতি আনতে আইএমএফের কাছে আরও ঋণ চেয়েছে সরকার। আইএমএফের ঋণের চতুর্থ কিস্তি পাওয়ার কথা রয়েছে আগামী মাস ফেব্রুয়ারিতে। এই দফায় মিলবে ৬৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার।
আইএমএফের ঋণ চুক্তিতে বলা হয়েছে, এনবিআরকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে কর আহরণ ০.৫ শতাংশ, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আরও ০.৫ শতাংশ এবং ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ০.৭ শতাংশ বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশের কর-জিডিপির অনুপাত মাত্র ৭ শতাংশ- একথা জানিয়ে এনবিআরের ওই কর্মকর্তা বলেন, “আইএমএফের ওই ঋণের জন্য অন্যতম প্রধান শর্ত ছিল প্রতি বছর জিডিপির অনুপাতে ০.৫ শতাংশ হারে রাজস্ব আহরণ বাড়াতে হবে। কিন্তু আমাদের সেই শর্ত পূরণ করা সম্ভব হচ্ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে গত ৯ জানুয়ারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রায় একশ পণ্য ও সেবার ওপর বিভিন্ন হারে ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হয়।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান সকাল সন্ধ্যাকে বলেন, “প্রস্তাবটা এখনও প্রক্রিয়াধীন আছে। এখনও চূড়ান্ত হয়নি। উপদেষ্টা মহোদয় অসুস্থ্য থাকায় উনি অফিস করতে পারেন নাই।”
তিনি বলেন, “ইতিবাচক মনোভাব সরকারের তরফ থেকে আছে। দেখা যাক আমরা কতটুকু কী করতে পারি।”
গত ১৬ জানুয়ারি সচিবালয়ে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক শেষে অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ জানিয়েছিলেন, ওষুধ ও পোশাকসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর যে বাড়তি ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে- তা রিভিউ করা হচ্ছে।
বাড়তি ভ্যাটের কারণে বাজারে পণ্যের দামে এরই মধ্যে প্রভাব পড়েছে- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “ভ্যাটের কারণে সম্পূর্ণ না। দামের প্রভাব কিছু কিছু জায়গায় হয়তো ভ্যাটের কারণে হয়েছে। সম্পূর্ণভাবে এটা হলো ম্যানুপুলেশন, সাপ্লাই চেনের ওপর।”
“ভ্যাটের মাধ্যমে আমি কয়েকটি জিনিসের দাম বাড়িয়েছি। ফোন, বিদেশি ফলের জুস কয়টা মানুষ কেনে। অতএব ওটার ওপর পড়েছে (ভ্যাটের কারণে দাম বেড়েছে) তা না। তবু আজ আমরা রিভিউ করছি, কিছু কিছু ম্যাটার। আপনারা পরে জানতে পারবেন।”
তিনি বলেন, “অত্যাবশ্যকীয় কিছু কিছু জিনিসের বিষয়ে আমরা বলেছি। তারপর ওষুধ ও পোশাকসহ অত্যাবশ্যকীয় যেসব পণ্য সাধারণ লোকজনের ওপর প্রভাব ফেলে সেগুলো রিভিউ করা হচ্ছে।”
অর্থ উপদেষ্টার এমন বক্তব্যের তিন দিন পর এনবিআরের কাছ থেকে বিপরীত বক্তব্য এলো। এ বিষয়ে কথা বলতে তার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি। এসএমএস পাঠিয়েও তার সাড়া মেলেনি।