যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচন একেবারে দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছে। এরমধ্যে ব্রিটিশ ভোটারদের টিভি স্ক্রিন, ইমেইল বক্স ও সোশাল মিডিয়ার নিউজ ফিড রঙে রঙে রঙিন হয়ে উঠেছে।
বাণিজ্যিক ব্র্যান্ডগুলোর মতো রাজনৈতিক দলগুলোও বুঝে গেছে চোখে পড়ার মতো গাঢ় ও এক রঙে সহজেই ভোটারদের নজরে আসা যায়।
৪ জুলাই কনজারভেটিভ দল নীল রঙ নিয়ে মুখোমুখি হচ্ছে লেবার দলের লাল রঙের সঙ্গে। এই দুটো দলেরই সুযোগ আছে জয়ের মুখ দেখার। ব্রিটেনের রাজনৈতিক কাঠামোতে বাকি ছোট দলগুলো কখনও সূক্ষ্ণ পার্থক্য আবার কখনও একই রঙ দেখায়।
কমলা রঙ নিয়ে দ্য লিবারেল ডেমোক্রেটস, টারকয়েশ (তুর্কি ব্লু বা ময়ূরকণ্ঠী নীল) রঙ নিয়ে রিফর্ম ইউকে এবং সবুজ রঙ নিয়ে গ্রিন পার্টি ভোটের মাঠে আছে।
হলদে রঙে সেজেছে দ্য স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি। অন্যদিকে নর্দান আয়ারল্যান্ডের সিন ফেইন এবং ওয়েলস প্লেইড সিমরু পার্টি নির্বাচনী প্রচারণার ব্র্যান্ড কালার হিসেবে কাছাকাছি সবুজ রঙ বেছে নিয়েছে।
কেন রঙে মাতলো ব্রিটিশ দলগুলো?
সিএনএনের কাছে রাজনীতির মাঠে রঙের মাহাত্ম্য ব্যাখ্যা করলেন যুক্তরাজ্যের লাওবোরো ইউনিভার্সিটির পলিটিকাল কমিউনিকেশনের অধ্যাপক ডোমিনিক রিং।
“রাজনৈতিক প্রচারণায় রঙের ছোঁয়া লাগে ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ পরবর্তী সময়ে, যখন নতুন প্রযুক্তি আর বিজ্ঞাপনের জোয়ার শুরু হলো।”
“রঙিন টেলিভিশনের যুগের বিজ্ঞাপনের বাজারেও বড় পরিবর্তন ঘটে। তারপর রঙ আর নতুনত্বের চাহিদা বাড়তে থাকে। আর এরকম সময় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের বক্তব্য আরও সহজ করার দিকে ঝুঁকছিল।”
পরিচিতি গড়ে তোলা ছাড়াও আদর্শ ও মূল্যবোধের জায়গা থেকেও রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে রঙের গুরুত্ব ধরা দিয়েছে।
যেমন, হলুদ রঙ উদারনীতির প্রতীক। আবার নৈরাজ্যবাদ বা ফ্যাসিবাদের কথা বলে কালো রঙ। ব্রিটিশ ইউনিয়ন অব ফ্যাসিস্টস দলের অনুসারীদের বলা হতো ‘ব্ল্যাকশার্টস’।
লেবার পার্টি মানেই শ্রমিক ইউনিয়ন, সমাজতন্ত্র; ফলে লাল ছাড়া আর কোনও রঙে মানায় না এই দলকে। ফরাসি বিপ্লবের সময় থেকেই এই রঙ বামপন্থীদের গায়ে লেগে আছে। এই লাল মানে শ্রমিকের রক্ত, যারা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে প্রাণ দিয়েছিল। বিংশ শতাব্দীতে লাল পতাকা এই দলের লোগো হয়ে ওঠে।
“তখন থেকেই আজও শ্রমিক আন্দোলনের প্রতীক হয়ে আছে এই রঙ”, বললেন রিং।
যুক্তরাজ্যের পতাকায় আছে তিনটি রঙ; লাল, সাদা এবং নীল। ঐতিহাসিকভাবে এই তিনটি রঙই ধারণ করেছে কনজারভেটিভ পার্টি। আর এই তিন রঙে উদ্ভাসিত হয়ে দলটি বোঝাতে চাইছে তারা ব্রিটিশ মূল্যবোধ রক্ষায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তিন রঙের মধ্যে নীল রঙের সঙ্গে অবশ্য বৈভব এবং রক্ষণশীলতার সংযোগ রয়েছে।
ওদিকে ছোট দলগুলো মধ্যে রঙ বাছাই প্রক্রিয়া বেশ সোজাসাপটা ভাবেই ঘটে। যেমন, গ্রিন পার্টির রঙ হলো গ্রিন মানে সবুজ। এই দলের সঙ্গে পরিবেশবাদের সংশ্লিষ্টতা আছে; এ কারণেও সবুজ রঙ দলটির জন্য অনিবার্য হয়ে ওঠে।
বাকি দলগুলোও বাস্তববাদী চিন্তা থেকেই রঙ নির্বাচন করেছে। লিবারেল ডেমোক্রেটিক দলের কমলা রঙ বেছে নেওয়ার কারণও তেমনই।
লিবারেল পার্টির রঙ ছিল হলুদ এবং সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি আগে লাল রঙের লেবার দলের সঙ্গে ছিল। আশির দশকের গোড়ায় এই সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়।
লাল আর হলুদ মিলেই কমলা হলো লিবারেল ডেমোক্রেটিক দলের রঙ। ২০১৯ সালের নির্বাচন পর্যন্ত তৃতীয় বড় দল ছিল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি।
কমলা রঙের অবশ্য আরও এক কাহিনী আছে।
সত্তরের দশকে স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির নামডাক ছড়িয়ে পড়ছিল। ওই সময় হলুদ রঙ থেকে সরে দাঁড়িয়ে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির পক্ষে নিজেদের আলাদা ভাবে তুলে ধরতে সুবিধা হয়।
ইউরোপে ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেট দলের সঙ্গে এবং পূর্বে সোভিয়েত ভেঙ্গে যাওয়ার সঙ্গেও কমলার যোগসূত্র আছে। ইউক্রেইনের কমলা বিপ্লবের কথাও গণনায় আনতে হবে। এই আন্দোলনের পরেই সংবিধান পরিবর্তন করে ইউক্রেইনে সংসদীয় ব্যবস্থা আনা হয়।
![](https://www.shokalshondha.com/wp-content/uploads/2024/07/ukvote-030724-1024x576.png)
নতুন দলগুলোর মধ্যে ৯০ দশকের রেফারেনডাম পার্টি গোলাপি এবং ইউকে ইনডেপেন্ডেন্স পার্টি বেগুনি রঙ বেছে নিয়েছিল। রাজনৈতিক দলগুলোর ভিড়ে এই ভিন্ন রঙ তাদের আলাদাভাবে চেনাচ্ছিল।
অনেক দেশে যদিও সবুজ মানে পরিবেশবাদী নয়; বরং ইসলামিক রাজনৈতিক দলগুলোর সবুজ রঙ ব্যবহারের উদাহরণ রয়েছে। আবার নাৎসিরা ব্যবহার করতো বাদামি রঙ। গাঁজা বিষয়ে সরব কানাডার মারিজুয়ানা পার্টিও বাদামি রঙের অনুসারী।
নীল মানেই ডানপন্থী এবং লাল মানে বামপন্থী- এই সহজ সমীকরণও কিন্তু সব সময় খাটে না।
যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্রেটরা নীল রঙ বেছে নিয়েছে। লাল রঙ নিয়েছে রক্ষণশীল দল রিপাবলিকান। যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনে রাজনৈতিক দলগুলো রঙ দিয়ে নিজেদের যতই চেনাক, ভোটের দিন কিন্তু ভোটাররা এসব রঙের লেশ মাত্র পাবেন না। কারণ ব্যালট কাগজ শুধু সাদা ও কালো কালিতে ছাপা হয়।
তথ্যসূত্র: সিএনএন ডটকম