‘চালাই দেন’ কথাটি বেশ চলছিল জুলাই আন্দোলনের সময়, এতটাই যে উইকিপিডিয়ায়ও স্থান করে নিয়েছে শব্দবন্ধটি। ভুয়া খবর চালিয়ে দিতে রোমান হরফে এই কথাটি ছাত্রলীগের একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে আসার পর তা নিয়ে নানা মিম ছড়িয়ে পড়ে তখন সোশাল মিডিয়ায়। অভ্যুত্থানের ছাত্রনেতা থেকে উপদেষ্টা বনে যাওয়া আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াও সম্প্রতি রসিকতা করে একটি পোস্ট দিয়ে লেখেন ‘চালাইদেন’।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অর্থ বছরের মাঝামাঝিতে এসে হঠাৎ করে শতাধিক পণ্যে ভ্যাট-কর বাড়ানোর পর সেই ‘চালাই দেন’ মনে পড়ে গেল। বাংলাদেশে ভ্যাট চালানোটা শুরু করেছিলেন এম সাইফুর রহমান, ১৯৯১ সালে, তখন তিনি অর্থমন্ত্রী। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বার বাজেট দিয়েছেন যে দুজন, তার একজন বিএনপির সাইফুর রহমান; অন্যজন আওয়ামী লীগের আবুল মাল আবদুল মুহিত।
সেই যে ভ্যাট এল, তার পরের সরকারগুলোর জন্য তা সোনার ডিম পাড়া হাঁসে পরিণত হলো। রাজস্ব আয় বাড়ানোর সহজ তরিকা হিসাবে সবাই ভ্যাটকেই বেছে নিচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকারও তাই করত। গত জুনে যে বাজেট সংসদে দিয়েছিলেন আবুল হাসান মাহমুদ আলী, সেখানেও ভ্যাট থেকে আদায়ের লক্ষ্য ১ লাখ ৮২ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা, যা মোট রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রার ৩৮ শতাংশ। আগের অর্থ বছরেও তা ছিল ৪০ শতাংশ।
ভ্যাট হলো পরোক্ষ কর। এর ওপর এত নির্ভরতা কোনও দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো নয়, তা অর্থনীতিবিদরাই বলেন। আর এই কর ব্যবস্থা বৈষম্যমূলকও বটে। ধরুন রিকশাচালক মতি মিয়া যে ওষুধ খান, সেই ওষুধ খান কোটিপতি জালাল মিয়াও। সেই ওষুধে এবার ভ্যাট বেড়েছে, তাতে ওষুধের খরচা দুজনেরই সমান বাড়ল। তাতে কি বৈষম্য হলো না? একই রকমভাবে যেসব পণ্য ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবার কেনা লাগে, তাতে ভ্যাট আরোপ মানে, দুই পক্ষের কাছ থেকে সমান কর আদায়।
বর্তমান অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদও বিভিন্ন সময়ে এনিয়ে কথা বলেছেন। গত জুন মাসে আওয়ামী লীগ সরকারের বাজেট দেওয়ার আগেও এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “গরিব মানুষ যেভাবে ভ্যাট দেয়, ধনী শ্রেণিও একই হারে ভ্যাট দেয়। এতে অসমতা তৈরি হয়।” সম্প্রতি ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের এক আলোচনায় রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাকও বলেছিলেন, “দেশে যারা গরিব মানুষ, তারা আয়ের অনুপাতে সবচেয়ে বেশি ভ্যাট দেন। আর বেশি আয়ের মানুষ সবচেয়ে কম ভ্যাট দিচ্ছেন। এতে বৈষম্য বাড়ছে।” তাহলে এই অন্তর্বর্তী সরকারও বৈষম্যের পথে হাঁটছে কেন? উত্তরটা খুবই সহজ- ওই যে সহজ পন্থা। কারণ ভ্যাটের আয় নগদে চলে আসে কোষাগারে। কে যাবে ধনীদের কাছ থেকে কর আদায়ের কঠিন পথ ধরতে। তাতে না আবার গদি উল্টে যায়। তাই রাজনৈতিক সরকার হোক, অন্তর্বর্তী সরকার হোক, ভ্যাটের তরিকা কারও বদলায় না।
দেশে কর-জিডিপির অনুপাত অন্য সব দেশের তুলনায় বেশ কম। ধনীদের নানা কর অব্যাহতি সুবিধা দিয়ে তা টিকিয়ে রাখা হয়েছে। ইআরএফের অনুষ্ঠানেই র্যাপিড চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক বলেছিলেন, “বাংলাদেশে কর–জিডিপির অনুপাত মাত্র ৯ শতাংশ। এটি সারা বিশ্বের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ের। এর বড় কারণ আমাদের প্রত্যক্ষ কর অনেক কম। বর্তমানে পরোক্ষ কর ৬৫ শতাংশ ও প্রত্যক্ষ কর ৩৫ শতাংশ।” গত মে মাসের সাক্ষাৎকারে সালেহউদ্দিনও প্রত্যক্ষ কর সংগ্রহে জোর দিতে বলেছিলেন। সরকারের বাইরে থেকে যে পরামর্শ তিনি তখন দিয়েছিলেন, সরকারের এসে এখন তিনিই উল্টে গেলেন! নিজের দেখানো পথে না হেঁটে তিনি হাঁটছেন আগের পথে। সেটা কি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের পরামর্শে? অনেকে তাই বলেন। কেননা নেওয়া ঋণের শর্ত হিসাবে সংস্থাটি ভ্যাটের হার সমান ১৫ শতাংশ করতে বলেছিল। সরকারের এখন অর্থ চাই, আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের চতুর্থ কিস্তি হাতে পাওয়া দরকার। ঋণের অঙ্ক আরও ৭৫ কোটি বাড়াতেও অনুরোধ জানানো হয়েছে। তার প্রাপ্তি নিশ্চিত করতেই যে এই ভ্যাটের খড়গ, তা সরকার মুখে না বললেও অনুমান করতে কষ্ট হয় না।
বছরের প্রথম সপ্তাহেই শতাধিক পণ্যের ভ্যাট হার বাড়িয়ে দেয় সরকার। সব ধরনের রেস্তোরাঁর বিলের ওপর ভ্যাট এক লাফে ১০ শতাংশ বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। মিষ্টিতে বেড়েছে ৮ শতাংশ। পোশাকে বেড়েছে সাড়ে ৭ শতাংশ। এই শীতে একটু গরম পেতে একটা সোয়েটার, চাদর বা জ্যাকেট কিনতে গেলে এখন বাড়তি টাকা খরচ করতে হবে। মনের সুখে একটু মিষ্টি খেতে চাইলেও গুনতে হবে আগের চেয়ে বেশি টাকা।
পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি করায় এলপি গ্যাস, ফল, বিস্কুট, কেক, জুস, সিগারেট ও টিস্যুর মতো পণ্যের দামও বেড়েছে। সিগারেট, রং, মদের বিল, পটেটো ফ্লেকস, প্লাস্টিক ও মেটাল চশমার ফ্রেম, রিডিং গ্লাস, সানগ্লাস, বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার ও তাতে ব্যবহৃত তেল, বৈদ্যুতিক খুঁটি, সিআর কয়েল, জিআই তারে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এলপি গ্যাসের ওপরও ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। ওষুধের ক্ষেত্রে স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট হার ২ দশমিক ৪ শতাংশ বাড়িয়ে ৩ শতাংশ করা হয়েছে। এতদিন মোবাইল সিম বা রিম কার্ড ব্যবহারের ওপর ২০ শতাংশ হারে সম্পূরক শুল্ক আরোপ হতো। তা ২৩ শতাংশ করা হয়েছে। বর্তমানে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ৫০ লাখ টাকা থেকে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত বার্ষিক লেনদেন হলে টার্নওভার কর দিতে হতো। এখন বার্ষিক লেনদেন ৩০ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা হলেই টার্নওভার কর দিতে হবে।
সরকার যখন ভ্যাট ও করহার বাড়িয়েছে, তখন মূল্যস্ফীতিতে পিষ্ট সাধারণ মানুষ। সরকারি হিসাবে গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি বা মাসভিত্তিক) দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৯২ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির এই বাজারে ভ্যাট বাড়লে জিনিসপত্রের দাম যে বাড়বে, তা সাধারণ মানুষও বোঝে, তার জন্য অর্থনীতিবিদ হতে হয় না। কিন্তু সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন তা বাড়িয়ে আবার বলছেন, মূল্যস্ফীতিতে তা প্রভাব ফেলবে না। তার সঙ্গে সুর মিলিয়ে এনবিআরও বলছে, ভ্যাট বাড়লেও মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব পড়বে না। অর্থমন্ত্রী বা অর্থ উপদেষ্টা যা বলবেন, এনবিআর তাই বলবে- সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এতদিন যে সালেহউদ্দিন আহমেদের কাছ থেকে এক রকম শুনে আসছি, সেই সালেহ উদ্দিনের কাছে এখন অন্য রকম কথা শুনে মনে হচ্ছে- ‘এ কী কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে’।
সরকার রাজস্ব আদায়ে বড় ঘাটতির মুখে পড়েছে, তাই আয় বাড়াতে মরিয়া তারা। তা বোধগম্য। কিন্তু এছাড়া কি আর উপায় ছিল না? বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলছেন, ছিল। করজাল বাড়ানোর পাশাপাশি দুর্নীতি দমন, সরকারের ব্যয় কমানো যেত। করযোগ্য আয় যাদের, তাদের খুঁজে বের করে কর আদায় বাড়ানোর ওপর অর্থনীতিবিদরাই জোর দিচ্ছেন। অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান বলছেন, অতীতে অনেক ক্ষমতাশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কর অব্যাহতির অন্যায় সুযোগ নিয়েছে। অনেক সম্পদশালী কর ফাঁকি দিয়েছেন। সেগুলো বন্ধ করে প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর সুযোগ এখনও আছে।
কিন্তু কাজটি যে কঠিন, সেটা সেলিম রায়হানও মানছেন। কিন্তু কঠিন কাজের শপথেই তো গঠিত হয়েছে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ফসল এই সরকার কেন তবে বৈষম্য বাড়ানোর পথে হাঁটবে? তা আমার ক্ষুদ্র মাথায় ঢুকছে না। আপনারাই উত্তর খুঁজে নিন।