শ্রমিক অসন্তোষের জেরে মঙ্গলবার ঢাকার আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে ৫৫টি কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এর বাইরে ডিইপিজেডসহ শিল্পাঞ্চলের অন্যান্য কারখানায় স্বাভাবিক কার্যক্রম চলছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
শ্রমিক অসন্তোষের জেরে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে একই কারণে গতকাল সোমবার বন্ধ ছিল ৪৯টি কারখানা।
শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উৎপাদন বন্ধ থাকা এই ৫৫টি কারখানা মূলত আশুলিয়ার বাইপাইল-আবদুল্লাহপুর সড়কে অবস্থিত। তবে এর সবকটি কারখানায়ই যে সমস্যা রয়েছে, তা নয়। মঙ্গলবার সকালে অনেকেই এসব কারখানায় গিয়েছিল। কারখানা বন্ধ পেয়ে তারা ফিরে এসেছে।
শ্রমিকরা বলছেন, মূলত হাতেগোনা কয়েকটি কারখানা থেকে শ্রমিক অসন্তোষের এসব ঘটনার সূত্রপাত। ১০-১২টি কারখানার শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে আশেপাশের কারখানাগুলোতে প্রভাব পড়ছে। এই কারখানাগুলো মূলত নাসা গ্রুপ, ডেকো গ্রুপ, নেক্সট কালেকশন, শারমিন গ্রুপ, অনন্ত গ্রুপ, সেতারা গ্রুপের।
সরকার পতনের পর প্রথম আন্দোলন শুরু হয় নজরুল ইসলাম মজুমদারের নাসা গ্রুপ থেকে।
মঙ্গলবার শিল্পাঞ্চলের কোনও সড়কে অবরোধ বা কোনও অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। নিরাপত্তা জোরদারে বিভিন্ন কারখানার সামনে শিল্প পুলিশের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন রয়েছে।
আশুলিয়া শিল্প পুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার সারোয়ার আলম বলেন, “শ্রমিকরা বেতন বৃদ্ধি, ইনক্রিমেন্টসহ অন্যান্য দাবিতে আন্দোলন করার কারণে আজ ৪৬টি কারখানা শ্রম আইনের ১৩ (১) ধারায় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রয়েছে। আরও ৯টি কারখানায় সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ।”
শিল্প পুলিশ আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে মঙ্গলবার ৫৫টি কারখানা বন্ধ থাকার কথা বললেও তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ বলছে, ৩৫টি কারখানা বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে ২৯টি কারখানা বন্ধ রয়েছে শ্রম আইন ১৩(১) ধারায় (নো ওয়ার্ক, নো পে)। কারখানা চালু থাকলেও উৎপাদন বন্ধ আছে বা ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে এমন কারখানা আছে ৬টি।
শ্রম আইনের ১৩(১) ধারায় বন্ধ থাকা কারখানাগুলোর মধ্যে রয়েছে- হা-মীম গ্রুপ, অনন্ত গ্রুপ, ডুকাটি অ্যাপারেলস, নাসা গ্রুপ, নিউএইজ গ্রুপ, ব্যান্ডো ডিজাইন, ইয়াগি বাংলাদেশ লিমিটেড, এনভয় গ্রুপ, ভিনটেজ গার্মেন্টস ও জেনারেশন নেক্সট।
স্ব-বেতনে ছুটি বা উৎপাদন কাজ বন্ধ আছে বা শ্রমিকরা কারখানায় এসে চলে গেছে- এমন কারখানার মধ্যে রয়েছে- সিডকো গ্রুপ, দ্য রোজ ড্রেসেস লিমিটেড, এফএনএফ ট্রেন্ড ফ্যাশন, ট্রাউজার্স লাইন লিমিটেড ও ফ্যাশন ফোরাম লিমিটেডের কারখানা।
বিজিএমইএ আরও জানিয়েছে, মঙ্গলবার সাভার, আশুলিয়া, জিরানি এলাকায় ৪০৭টি কারখানা খোলা রয়েছে। বন্ধ রয়েছে ৩৫টি। গাজীপুর এলাকায় খোলা রয়েছে ৮৭৬টি কারখানা, বন্ধ রয়েছে ৪টি। নারায়ণগঞ্জ এলাকায় ২০৯টি কারখানা খোলা রয়েছে। ঢাকা মহানগরীর ৩০২টি এবং চট্টগ্রামের ৩৫০টি কারখানা খোলা রয়েছে। এসব এলাকায় কোনও কারখানা বন্ধ নেই।
বিজিএমইএ জানিয়েছে, আশুলিয়া এলাকায় ২৬৭টি (৯৮.১৬ শতাংশ) কারখানা আগস্ট মাসের বেতন পরিশোধ করেছে। বেতন দিতে পারেনি ৫টি (১.৮৩ শতাংশ) কারখানা।
বিজিএমইএর ‘বিশেষ সাধারণ সভা’, মজুরি না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত
গাজীপুর, আশুলিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক অসন্তোষের মধ্যে গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় সংগঠনের উত্তরা কার্যালয়ে ‘বিশেষ সাধারণ সভায়’ মজুরি না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় বিজিএমইএ।
বর্তমান পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার বিষয়ে সদস্যদের মতামত জানতে এ সভা ডাকে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি-বিজিএমইএ।
সভায় শ্রমিকদের নামে দেওয়া দাবিগুলো শ্রমিকদের নয় বলে অভিযোগ করেন প্যাট্রিয়ট গ্রুপের মালিক ইমরান। তার আশঙ্কা, পোশাক শিল্পকে বিপদে ফেলতে নতুন করে দাবি তোলা হচ্ছে।
প্যাট্রিয়ট গ্রুপের মালিক বলেন, “গত ডিসেম্বরে নতুন মজুরি হার বাস্তবায়ন করেছি। নতুন বেতন, বোনাস চালু করেছি। সরকার বদল হওয়ায় ৯ মাস পরে কেন আবার মজুরি হার বাড়ানো হবে?
“এখন কেন নতুন দাবি উঠেছে আমাদের বিপদে ফেলানোর জন্য। হাজিরা বেতন ও মাতৃত্বকালীন ভাতা দেওয়া যায়। কালো ছায়া দেখতে পাচ্ছি গার্মেন্টস খাতে। গার্মেন্টস যদি ধ্বংস হয় তাহলে দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে।”
মালিকদের একটি বড় অংশের অভিযোগ, এই অসন্তোষ রাজনৈতিক কারণে তৈরি হচ্ছে। আওয়ামী লীগ ও দলটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মালিকদের উস্কানি আছে এই আন্দোলনে।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি রেদওয়ান আহমেদ বলেন, “সমস্যাটি শুরু হয়েছিল নাসা গ্রুপ থেকে। গ্রুপটির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে, মহাডাকাতি করে ফ্যাসিস্ট সরকারের মদদে। এখন তিনি বিদেশে বা গোপনে আছেন, কই আছেন তা জানি না।
“শ্রমিকদের বেতন না দিয়ে শ্রম অসন্তোষ করছেন। সমস্যা তো সামলানো গেছিল, শুরুতেই ওখানে হাত দিলে এত বড় হতো না। এখন নজরুলরা কোটি কোটি টাকা ঢালছেন শ্রমিকদের পেছনে ভাঙচুর করতে, কারখানা বন্ধ করতে। সরকার ও শিল্পকে ধ্বংস করতে।”
শ্রমিকদের মজুরি না বাড়ানোর সিদ্ধান্তের বিষয়ে হয়েছে বিজিএমইএর ‘বিশেষ সাধারণ সভা’।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ সভাপতি রফিকুল ইসলাম বলেন, সভায় উপস্থিত সদস্যরা একমত হয়েছেন নতুন করে মজুরি বৃদ্ধি ও বছর শেষে ১০ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট দেওয়া নিয়ে কোনও ধরনের আলোচনা হবে না।
গত ৮ অগাস্ট অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর প্রশাসনে রদবদলের মধ্যে বিজিএমইএর নেতৃত্বেও বদল আসে। সংগঠনটির সভাপতির পদ ছেড়েছেন এস এম মান্নান কচি।
নতুন সভাপতির দায়িত্ব পেয়েছেন ডিজাইন টেক্স নিটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে থাকা খন্দকার রফিকুল ইসলাম।