Beta
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪
Beta
মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪

অস্থির উত্তাল সময়ে ঘুম

ghum keno ashena
[publishpress_authors_box]

জগতে আছে দুই ধরনের মানুষ। একদল বালিশে মাথা রাখতেই তলিয়ে যান ঘুমের রাজ্যে। আর আরেক দল বালিশে মাথা রেখেও জেগে কাটিয়ে দেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

সারা বিশ্বেই অনিদ্রা একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা। অনিদ্রাজনিত কারণে বাড়ছে নানান শারীরিক এবং মানসিক সমস্যা।

তবে দেশে ঘটে যাওয়া ‘জুলাই বিপ্লব’- এ অসংখ্য মানুষ নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন এই অনিদ্রাজনিত সমস্যায়।

উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠাময় মানসিক পরিস্থিতিতে তেমনটাই স্বাভাবিক।

মনোচিকিৎসক সতীশ রামাইয়াও ঘুমাতে না পারার কারণগুলোর মধ্যে মানসিক অবস্থার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন।

তার মতে, ‘ঘুম একটি জটিল প্রক্রিয়া। ঘুমাতে না পারার শারীরিক, মানসিক এবং পরিবেশগত কারণ রয়েছে।’

দিল্লীর পালমোনোলজিস্ট ড. বিভু কাওয়াত্রা ঘুম না আসার পেছনে যে বিষয়গুলো দায়ী তার একটি তালিকা করেছেন। এতে বেশ গুরুত্বের অন্যান্য কারণগুলোর পাশাপাশি রয়েছে- স্ক্রিন টাইম, মানসিক চাপ ও উদ্বেগ এবং ঘুমাতে যাওয়ার অনিয়মিত সময়।   

জুলাইয়ের সরকার পতনের আন্দোলনের দুইজন সক্রিয় কর্মীর সঙ্গে কথা বলে আমরা জেনেছি তাদের অনিদ্রা ও উদ্বেগজনক অভিজ্ঞতার কথা। দুশ্চিন্তায় এই দুই কর্মীর রাত কেটে যেত একটু পর পর ফোন চেক করে।

দুই কর্মীর একজন, কবি ও সংস্কৃতিকর্মী মীর হাবিব আল মানজুর। তিনি জানান, প্রতিদিনের রুটিন মাফিক সময়েই ঘুমাতে যেতেন। কিন্তু একটু পরপরই উদ্বেগে তার ঘুম ভেঙ্গে যেত। দেখতেন দুঃস্বপ্ন। ইন্টারনেটবিহীন সময়ে রাতে ঘুম ভেঙে গেলেই ফোনে খোঁজ নিতেন অন্য বন্ধুদের। যেহেতু ইন্টারনেট ছিল না, তাই কাজ চালাতেন গ্রুপ মেসেজে। আর যখন ইন্টারনেট ছিল তখন ঘুমাতে যাওয়ার আগে প্রতিদিন ফেইসবুকের সমস্ত পোস্ট মুছে দিতেন। কারণ যে কোন সময় পুলিশ- বিজিবির রেইডে বাড়ি আক্রান্ত হতে পারতো। এতো সব অতি সাবধানী তৎপরতায় কেইবা রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারে!

মীর হাবীব আল মানজুর

আন্দোলনের আরেক সক্রিয় কর্মী লেখক কে এম রাকিব জানালেন, আন্দোলনের রাতগুলো কেটে যেত মোবাইল ফোনে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবর দেখে অথবা পড়ে। ফলে শরীর ঘুম চাইলেও ঘুমাতে পারতেন না তিনি। তার মতে, দেশের গণমাধ্যমে সে সময় কোন কিছু জানার সুযোগ ছিলনা।

রাকিবের ভাষায়, ‘শরীর যখন একেবারে এক্সোস্টেড, তখন ধীরে ধীরে ঘুম আসতো’।

কে এম রাকিব

গ্রেপ্তার এড়াতে রাকিব ফিরতে পারেননি নিজের বাসায়। ফেরারী হয়ে গা ঢাকা দিয়ে ছিলেন আজ এ বাসায় তো কাল ও বাসায়। আর এমন উৎকণ্ঠা নিয়ে ঘুম? ভাবাই যায়না।

রংপুরের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন নাফিদা নওরীন। তার সঙ্গে আলাপে জানা যায়, আন্দোলনের উত্তাল সময়গুলোতে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন তিনি।

তার ভাষায়, “আমার সাধারণত ঘুমের সমস্যা নাই। যখন তখন যে কোন অবস্থাতেই ঘুমাতে পারি। কিন্তু যখন আন্দোলন চলছিল তখন ঘুমাতে ঘুমাতে ৩-৪টা বেজে যেতো। আবার ঘুম হলেও সেটা ছাড়া ছাড়া, সাউন্ড স্লিপ না। শেষ পর্যন্ত ঘুমের ওষুধ খেলাম। যদিও ওইটা কন্টিনিউ করি নাই। গত ৩ দিন যাবত ঠিকঠাক ঘুমাচ্ছি।”

নওরীন জানালেন, নির্ঘুম রাতগুলোয় ফেইসবুকে স্ক্রল করেই সময় চলে যেত। সবসময় একটা উদ্বেগ কাজ করতো কখন কী হয়- এই ভেবে!

ঢাকার বাড্ডায় বসবাস করেন ব্যবসায়ী জাহিদুর রহমান খান। আন্দোলনের সময়গুলো তার কেটেছে প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা আর আতঙ্কের মধ্যে।

সেইসব দিনের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, “রাতগুলো এক কথায় নির্ঘুম কেটেছে। মনের মধ্যে সবসময় একটা আতঙ্ক কাজ করতো। একেতো আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে খুব চিন্তিত ছিলাম তার ওপর যুক্ত হলো গুজব।”

ব্যবসায়ী জাহিদুর রহমান খান

জাহিদও আমাদের জানালেন, নির্ঘুম রাতগুলোতে ফেইসবুকে খুঁজে ফিরতেন আন্দোলনের আপডেইট। আর এই করতে গিয়ে আর ঘুমানোই হতো না তার।

রাজধানীর সেন্ট্রাল রোডে বসবাসরত গৃহিণী ফরিদা তামলিখা ইসলামের কণ্ঠে ঝরে পড়ল উত্তাল সেইসব দিনের অভিজ্ঞতার কথা।

তার বয়ানে আমরা জানতে পারি, আবু সাঈদের মৃত্যুর দৃশ্য তাকে ভীষণভাবে ছুঁয়ে যায়। সেদিনের পর থেকে আজও তিনি চোখের পাতা এক করতে পারেননি।

ফরিদা তামলিখা ইসলাম

ফরিদা বলেন, “আমি কিন্তু নিউজ দেখিনা। কারণ নিউজে শুধু সব ‘ভালো’ দেখায়। তাই সত্যি খবর জানতে ফেইসবুকেই আসতাম। সবসময় চিন্তা হতো যে দেশে আসলে কী হচ্ছে। এই যে রাস্তায় আন্দোলন করা ছেলেমেয়েগুলোর ওপর দিয়ে কী ঘটে যাচ্ছে। রাতে ফেইসবুকে দেখতাম কোন আপডেইট আছে কিনা।”

বাংলাদেশের অগুণতি মানুষ রাকিব, মানজুর কিংবা জাহিদ, ফরিদার মতোই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছেন গত দুই সপ্তাহ।  

চিকিৎসক বিভু কাওয়াত্রার মতে এন্ড্রোয়েড ফোন, ট্যাবলেট এবং কম্পিউটারের নীল আলো ঘুমে বাধা সৃষ্টি করে। মেলাটনিন নামের একটি হরমোন শরীরে ঘুম নিয়ন্ত্রণ করে। উল্লেখিত ডিভাইসের নীল আলো মেলাটনিন উৎপাদনে বাধা দেয়। ঘুমানোর ঠিক আগ মুহূর্তে এইসব ডিভাইসের ব্যবহার মস্তিষ্ককে দেয় ভুল বার্তা। এই ডিভাইসগুলো রাতে ব্যবহার করার সময় মস্তিষ্ক ধরে নেয় এখনো দিন। মানজুর এবং রাকিবের বরাতে আমরা জেনেছি রাতগুলোতে অ্যান্ড্রয়েড ফোনের ওপর তারা কতটা নির্ভরশীল ছিলেন।

এছাড়া মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং  সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে বিছানায় যাওয়ার পরও তারা ঘুমাতে পারেন না।

এ বিষয়ে বিভু কাওয়াত্রা জানাচ্ছেন, উচ্চমাত্রার চাপ এবং উদ্বেগ রাতের ঘুম আসাকে কঠিন করে তুলতে পারে।

আসলে প্রতিকুল পরিবেশ যে কারও স্বাভাবিক ঘুমের রুটিনকে এলোমেলো করে দিতে পারে। তাই প্রত্যাশা, আমাদের স্বপ্নগুলো অনুকূল ঘুমের পরিবেশ ফিরে পাবে।    

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত