Beta
বুধবার, ৩ জুলাই, ২০২৪
Beta
বুধবার, ৩ জুলাই, ২০২৪

লেবার পার্টির প্রধানকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আলোচনায় বাংলাদেশি প্রার্থী

যুক্তরাজ্যের হলবর্ন অ্যান্ড সেন্ট প্যানক্রাস আসন থেকে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ওয়াইছ ইসলাম।
যুক্তরাজ্যের হলবর্ন অ্যান্ড সেন্ট প্যানক্রাস আসন থেকে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ওয়াইছ ইসলাম।
Picture of মাহমুদুর রহমান তারেক, যুক্তরাজ্য থেকে

মাহমুদুর রহমান তারেক, যুক্তরাজ্য থেকে

বাংলাদেশি অভিবাসীদের নিয়ে নির্বাচনের আগ মুহূর্তে লেবার পার্টির প্রধান কিয়ার স্টার্মারের নেতিবাচক বক্তব্য ঘিরে পরিস্থিতি ক্রমশ ঘোলাটে হয়ে উঠেছে।

কিয়ার স্টার্মারের ওই বক্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে এরই মধ্যে পদত্যাগ করেছেন তার দলেরই নেতা সাবিনা ইসলাম। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এই নারী টাওয়ার হ্যামলেটস শাখার ডেপুটি লিডার ও কাউন্সিলর ছিলেন।

লেবার পার্টির বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত দুই এমপি রুশনারা আলী ও আপসানা বেগমও তাদের দলনেতার বক্তব্যের সমালোচনা করে বিবৃতি দিয়েছেন। পরিস্থিতির চাপে লেবার পার্টিও আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক ব্যাখ্যা দিয়েছে।

ভোটার ধরে রাখতে স্বয়ং স্টার্মার সুর নরম করে বলেছেন, বাংলাদেশিদের আঘাত করার উদ্দেশ্য তার ছিল না। বাংলাদেশি কমিউনিটির সঙ্গে লেবার পার্টি ও যুক্তরাজ্যের সম্পর্ক অনেক ঘনিষ্ঠ।

যুক্তরাজ্যে অবৈধ অভিবাসীদের প্রথম ১০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম নেই। তারপরও লেবার পার্টির প্রধান কেন বাংলাদেশকে উদাহরণ হিসেবে টানলেন, সেই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে। এবারের নির্বাচনে লেবার পার্টি জয়ী হলে স্টার্মারই হবেন যুক্তরাজ্যের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী।

স্টার্মারের ওই বক্তব্য ঘিরে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে লেবার পার্টিকে নিয়ে যে সমালোচনা হচ্ছে তা ভোটের মাঠে কাজে লাগাতে চাইছেন প্রতিপক্ষরা। তাদের মধ্যে আছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত স্বতন্ত্র প্রার্থী ওয়াইছ ইসলাম।

তিনি আগে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের কাউন্সিলার ও পেনসন অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।

ওয়াইছ ইসলাম ও কিয়ার স্টার্মার একই আসন- হলবর্ন অ্যান্ড সেন্ট প্যানক্রাস থেকে এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

লেবার পার্টির নেতা কিয়ার স্টার্মার।

এই আসনের অনেক বাংলাদেশি শেষ মুহূর্তে লেবার পার্টির প্রধানকে চ্যালেঞ্জ জানানো ওয়াইছ ইসলামের পক্ষে প্রচারে নেমেছেন।

কনজারভেটিভ পার্টি, লেবার পার্টির প্রার্থীদের পাশাপাশি তিনিও এখন আছেন আলোচনার কেন্দ্রে। কেবল বাংলাদেশি অভিবাসী নয়, গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসন নিয়ে স্টার্মারের অবস্থানেরও সমালোচনা করছেন তিনি।

ওয়াইছ ইসলাম বলেন, “কিয়ার স্টার্মার বাংলাদেশিদের তাড়ানোর বক্তব্য দিয়েছেন। এটি আন্তর্জাতিক আইনবিরোধী, মানবাধিকারবিরোধী বক্তব্য। লেবার পার্টির নেতার কোনও অধিকার নেই যারা আশ্রয়ের আবেদন করেছেন এবং বৈধভাবে যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন, তাদের বের করে দেওয়ার।

“কোনও বাংলাদেশি ইংল্যান্ডে নৌকায় চড়ে আসেন না। যাদের কথা তিনি বলেছেন, তারা বাংলাদেশি নন। তিনি কেন বাংলাদেশিদের টার্গেট করলেন?”  

হলবর্ন অ্যান্ড সেন্ট প্যানক্রাস আসনের ভোটারদের স্টার্মারকে ভোট না দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে এই স্বতন্ত্র প্রার্থী বলেন, “তিনি এমপি না হলে প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। কেবল বাংলাদেশি অভিবাসী ইস্যু নয়, গাজায় ফিলিস্তিনিদের ওপর যে অত্যাচার হচ্ছে, তারও কোনও প্রতিবাদ তিনি করেননি।  

“বরং তিনি বলেছেন, ইসরাইলের অধিকার আছে গাজায় পানি, বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করার। যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশিদের হটানোর আগে আমাদের উচিত কিয়ার স্টার্মারকে এই আসন থেকে হটানো।”

মঙ্গলবার যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী দৈনিক ডেইলি সানের ইলেকশন শো-ডাউন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন লেবার পার্টির নেতা স্টার্মার। সেসময় একজন অবৈধ অভিবাসী ইস্যুতে তার অবস্থান জানতে চান।

জবাবের একপর্যায়ে বাংলাদেশকে উদাহরণ হিসেবে টেনে স্টার্মার বলেছিলেন, “যারা বাংলাদেশের মতো দেশ থেকে এদেশে এসেছেন, তাদের ফেরত পাঠানো হতে পারে। কয়েকটি দেশের মানুষের এখানে আসা বন্ধ করতে পারি আমরা।”

রুয়ান্ডা অ্যাসাইলাম প্ল্যানকে ‘ব্যয়বহুল’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, “যে দেশ থেকে তারা এসেছেন, সেখানেই তাদের ফেরত পাঠানো হবে। আমি নিশ্চিত করব সেটা।”

২০২২ সালের এপ্রিলে রুয়ান্ডা অ্যাসাইলাম প্ল্যান নামের একটি অভিবাসন নীতি প্রস্তাব করেছিল ব্রিটিশ সরকার। এতে বলা হয়, যুক্তরাজ্যে অবৈধ অভিবাসী বা আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে চিহ্নিত ব্যক্তিদের পূর্ব আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডায় পুনর্বাসনের জন্য স্থানান্তর করা হবে।

ইলেকশন শো-ডাউন অনুষ্ঠানে লেবার পার্টির নেতা স্টার্মারের ওই বক্তব্যের পরপরই তোলপাড় শুরু হয় যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে। সোশাল মিডিয়ায় তার বক্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। নেটিজেনদের অনেকে লেবার পার্টির নেতার বক্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

নির্বাচনী প্রচারে রুশনারা আলী।

এক পর্যায়ে দলনেতার বক্তব্যের সমালোচনা করে বুধবার বক্তব্য দিতে বাধ্য হন গ্রিন অ্যান্ড স্টেপনি আসন থেকে টানা চারবার নির্বাচিত এমপি রুশনারা আলী।

তিনি বলেন, “কোনও দেশকে এভাবে এককভাবে বলা ঠিক নয়। এটা ভুল হয়েছে। আমি আমার নেতাদের জানিয়েছি, এভাবে এককভাবে বললে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়।”

স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ভোটাদের ভুল বোঝাচ্ছেন অভিযোগ এনে রুশনারা আলী বলেন, “আমাদের লেবার পার্টি ক্ষমতায় গেলে ব্রিটিশ নাগরিকদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে, এটা গুজব। বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের সঙ্গে লেবার পার্টির সম্পর্ক বেশ ভালো এবং তা অটুট থাকবে।”

লেবার পার্টির বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আরেক এমপি আপসানা বেগম সেদিন বলেন, “আমি স্পষ্টভাবে বলছি, আমি যতদিন আছি, অভিবাসী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে দোষারোপ সহ্য করব না। আমাদের বাংলাদেশি সম্প্রদায় ১৯৭৮ সালে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন করে। সেই আন্দোলনে ইস্ট লন্ডনে ২৫ বছর বয়সী আলতাব আলী নিহত হন।

“তখন আমাদের স্লোগান ছিল- ‘আমরা এখানে ছিলাম, আমরা এখানে থাকব’। আপনারা আমাকে ভোট দিলে শক্তিশালী আওয়াজের জন্য ভোট দিচ্ছেন, সে বিষয়ে নিশ্চিত থাকেন। যিনি সংসদে গিয়ে যেকোনো উপায়ে আমাদের অভিবাসী সম্প্রদায়ের অধিকার এবং সম্মান রক্ষা করবে।”

লেবার পার্টির প্রধান স্টার্মারের বক্তব্যের সমালোচনা করেন যুক্তরাজ্যের উদারপন্থি রাজনৈতিক দল লিবারেল ডেমোক্রেটসের (লিবডেম) লুটন শাখার নির্বাহী কমিটির সদস্য মাহবুবুল কারীম সুয়েদও। তিনি বলেন, “লেবার পার্টির নেতার এমন বক্তব্য আমাদের হতাশ করেছে। একজন নেতার এমন বক্তব্য তার নেতৃত্বের যোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

“পরিসংখ্যান বলছে, যুক্তরাজ্যে ইরান ও আফগানিস্তানের আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা সর্বাধিক। সেক্ষেত্রে কেবল বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করে স্টারমারের এমন বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া আগামী নির্বাচনে তিনি দেখবেন।”

লেবার পার্টির বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এমপি আপসানা বেগম।

এমন পরিস্থিতিতে চাপে পড়ে বৃহস্পতিবার এটিএন বাংলা ইউকে টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে স্টার্মার বলেন, “বাংলাদেশিদের উদ্দেশ করে বা আঘাত করে আমি কোনও কথা বলতে চাইনি। বাংলাদেশি কমিউনিটির সঙ্গে লেবার পার্টি ও যুক্তরাজ্যের সম্পর্ক বেশ ঘনিষ্ঠ।”

রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রথম বিদেশ সফরে ঢাকা ও সিলেটে ভ্রমণ করেছেন উল্লেখ করে স্টার্মার বলেন, “বাংলাদেশি কমিউনিটির উদ্বেগকে আমি সমর্থন করছি। তবে আমি আবারও বলছি, কাউকে বা কোনও নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে আঘাত করা আমার উদ্দেশ্য ছিল না।”

যুক্তরাজ্য কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্সের ৬৫০ আসনে বৃহস্পতিবার ভোট হবে। এ নির্বাচনে ৩৪ জন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ দলীয় ও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়াই করছেন।

লেবার পার্টির মনোনয়ন পেয়ে ৮ বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ভোটে নেমেছেন। এদের মধ্যে আছেন এমপি রুশনারা আলী, টিউলিপ সিদ্দিক, রুপা হক ও আপসানা বেগম। তারা ছাড়াও আছেন নুরুল হক আলী, রুমি চৌধুরী, রুফিয়া আশরাফ ও নাজমুল হোসেন।

ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির মনোনয়ন পেয়েছেন দুজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক। তারা হলেন দক্ষিণ লন্ডনের টটেনহাম আসনের আতিক রহমান এবং ইলফোর্ড সাউথ আসনের সৈয়দ সাইদুজ্জামান।

লেবার পার্টির ৮ জন ও কনজারভেটিভ পার্টির ২ জনের বাইরে ওয়ার্কার্স পার্টি অব ব্রিটেন, লিবারেল ডেমোক্র্যাটস, রিফর্ম পার্টি, স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট, গ্রিন পার্টি ও সোশ্যালিস্ট পার্টি থেকে ১৩ জন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এবার মনোনয়ন পেয়েছেন। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ১১ জন ভোটযুদ্ধে শামিল হয়েছেন।       

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

ad

সর্বাধিক পঠিত