সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের মৃত্যুতে ভারতে ৭ দিনের শোক ঘোষণা করা হয়েছে। দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর ৯২ বছর বয়সে বৃহস্পতিবার দিল্লির একটি হাসপাতালে মৃত্যু হয় তার।
ভারতের অর্থনৈতিক সংস্কারের রূপকার মনমোহন সিং দেশটির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তাকে ভারতের অর্থনৈতিক উদারীকরণের স্থপতি ও রূপান্তরমূলক অর্থনৈতিক সংস্কারের পথপ্রদর্শক বলা হয়।
ভারতের রক্ষণশীল অর্থনীতিকে তিনি ধাক্কা দেন। মুক্ত বাজার অর্থনীতির সঙ্গে ভারতবাসীকে পরিচয় করিয়ে দেন তিনি। সেই নীতির ফলে ভারতের বাজারের বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর প্রবেশ ঘটে। দেশটির অর্থনীতিতে ব্যাপক কর্মচাঞ্চল্য তৈরি হয়।
তার দেখানো পথেই ভারতের পরবর্তী সরকারগুলো এগিয়ে যায়। মনমোহন সিংয়ের পর প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসা বিজেপি নেতা নরেন্দ্র মোদী সেই পথেই আরও জোর কদমে হাঁটছেন।
সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তাই ৭ দিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করেছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার।
ঘোষণা অনুযায়ী শুক্রবারের নির্ধারিত সব সরকারি কর্মসূচি বাতিল করা হয়েছে। একইভাবে কংগ্রেস পার্টির সাধারণ সম্পাদক কেসি বেণুগোপাল দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপনসহ সব অনুষ্ঠান আগামী সাত দিনের জন্য স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছেন।
শনিবার সকাল ১১টায় দিল্লির শক্তি স্থলের (মেমোরিয়াল) কাছে মনমোহন সিংয়ের শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাকে আনুষ্ঠানিক ২১ বার বন্দুকের স্যালুটসহ সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দেওয়া হবে।
তার লাশ জাতীয় পতাকায় মুড়ে দেওয়া হবে। শেষ যাত্রায় সামরিক ব্যান্ড ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা একটি ঐতিহ্যবাহী পদযাত্রার সঙ্গী হবেন।
এর আগে বৃহস্পতিবার রাতে দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সায়েন্সেসে (এআইআইএমএস) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ৯২ বছরের অর্থনীতিবিদ মনমোহন সিং।
তার মৃত্যুতে সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্স হ্যান্ডেলে শোকপ্রকাশ করেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে শুরু করে বিরোধীদলীয় নেতা ও কংগ্রেস সংসদ সদস্য রাহুল গান্ধীও।
মনমোহন সিং ১৯৭১ সালে ভারত সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে যোগদান করেন। অর্থনীতিবিদ মনমোহন সিং রাজনীতিতে আসার আগে ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন।
১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। কংগ্রেসের নরসিমা রাওয়ের সরকারে অর্থমন্ত্রী হিসাবে যোগ দেন তিনি।
২০০৪ সালে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত প্রগতিশীল মোর্চা (ইউপিএ) সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন মনমোহন সিং। এরপর ২০১০ সালে পুনর্নির্বাচিত হয়ে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ওই পদে ছিলেন।
মনমোহন যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন কংগ্রেসের প্রধান ছিলেন সোনিয়া গান্ধী। সোনিয়ার ইতালীয় নাগরিকত্ব নিয়ে বিজেপি বিরোধীতা করার পর কংগ্রেস মনমোহন সিংকে প্রধানমন্ত্রী করায় তাকে ‘অ্যাক্সিডেন্টাল প্রধানমন্ত্রী’ও বলা হতো।
আবার গান্ধী পরিবারের মতের বাইরে তার যাওয়ার সুযোগ ছিল না বলে তাকে ‘অনুগত’ প্রধানমন্ত্রীও বলত বিজেপি নেতারা।
তার মৃত্যুতে ভারতের দলমত নির্বিশেষে বিভিন্ন স্তরের মানুষ শোক প্রকাশ করে। এছাড়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বহু ব্যক্তিত্বও এতে সামিল হন।
ভারতের হাতে গোনা কয়েকজন রাজনীতিকের মধ্যে তিনি একজন, যিনি কোনও প্রকার তর্ক-বিতর্ক ও কেলেঙ্কারির বাইরে সাদাসিদে জীবন যাপন করে গেছেন।
দরিদ্র পরিবারের জন্ম নেওয়া মনমোহন সিং সততা ও বিনয় দিয়ে অগুনতি মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছিলেন। অবশ্য প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার দ্বিতীয় মেয়াদে মন্ত্রিসভার কয়েকজনের দুর্নীতির কারণে তার ভাবমূর্তি কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, তার বিরুদ্ধে কখনও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠেনি।
১৯৩২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাবের একটি বিদ্যুৎবিহীন কৃষিপ্রধান গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মনমোহন সিং। বর্তমানে গ্রামটি পাকিস্তানে অবস্থিত। তিনি দরিদ্র পরিবারে নয় ভাইবোনের সঙ্গে বড় হন।
অধ্যবসায়ের মাধ্যমে তিনি চন্ডীগড়ের পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্রিটেনের ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা করেন। পরে তিনি অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে অর্থনীতিতে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন।