বাংলাদেশ জিতবেই এমন উত্তেজনা এবার ছিল না। ভারতের বিপক্ষে সবশেষ সিরিজে টেস্ট ও টি-টোয়েন্টিতে অসহায় আত্মসমর্পণ উত্তেজনার পারদ বাড়তে দেয়নি। তবুও মনের কোণে একটু আশা ছিল সকল ভক্তদের। তাদের হতাশ করে ভারতের বিপক্ষে সহজ হার হজম করেছে বাংলাদেশ।
এই হারে নাজমুল হোসেন শান্তদের একমাত্র প্রাপ্তি তাওহিদ হৃদয়ের সেঞ্চুরি। বাংলাদেশের মিডলঅর্ডারে দায়িত্ব নিয়ে ব্যাটিংয়ের অভাব মেটানো ইনিংস উপহার দিয়েছেন হৃদয়। পেয়েছেন ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি। ৩৫ রানে ৫ উইকেট হারানো দলকে লড়াইয়ের জায়গায় নিয়ে যান এই ব্যাটার।
৬ উইকেটে এই হারে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনালে যাওয়ার পথে প্রথম বাধায় পড়ল বাংলাদেশ। “এ” গ্রুপে বাংলাদেশের পরের দুই প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড ও পাকিস্তান।
জয়ের লক্ষ্য ২২৯ রানে পৌঁছাতে ৪৭ ওভার পর্যন্ত খেলতে হয়েছে ভারতকে। তাই বরাবরের মতো বোর্ডে আরও কিছু রান না থাকার আক্ষেপ থাকল বাংলাদেশের জন্য। ২২৮ এর জায়গায় ২৫০ রান করলেও ভারতকে কিছুটা চ্যালেঞ্জে পড়তো।
রিশাদ হোসেন দুবাইয়ের উইকেটের ধীর গতি কাজে লাগিয়ে নির্ধারিত ওভারে দিয়েছেন মাত্র ৩৮ রান, তুলে নিয়েছেন ২ উইকেট। ভারত ব্যাটার শুভমান গিল ক্যারিয়ারের অষ্টম সেঞ্চুরিতে দলকে এনে দিয়েছেন জয়।
১২৯ বলে ৯ চার ও ২ ছক্কায় ১০১ রান করেছেন গিল। ৪৭ বলে ৪১ রান করা লোকেশ রাহুলকে নিয়ে অপরাজিত ৮৭ রানের জুটি গড়েন। ১৪৪ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে কিছুটা বিপদে পড়া ভারত এ জুটিতেই জয়ের পথ খুঁজে পায়।
এই হারে “এ” গ্রুপে তৃতীয় অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। পাকিস্তানের চেয়ে রানরেটে এগিয়ে আছেন শান্তরা।
ভারতকে বিপদে ফেলতে পারছে না বাংলাদেশ
সময়ের সঙ্গে উইকেট ধীর হবে। রান নেওয়াও তখন কঠিন হবে। বাস্তবতা হলো বাংলাদেশ তো বোর্ডে বড় রান তুলতে পারেনি। ভারতের ইনিংসের শুরুতে দ্রুত উইকেটও নিতে ব্যর্থ । তাই ২০ ওভার শেষে ভারতকে ঠিক বিপদে ফেলতে পারছে না বাংলাদেশ।
২০ ওভারে ১ উইকেটে ১০১ রান তুলে জয়ের লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে ভারত। অপরাজিত আছেন ৫৫ বলে ৬ চার ও ১ ছক্কায় ৪৩ রান করা শুভমান গিল। এছাড়া বিরাট কোহলি অপরাজিত ৩৩ বলে ১৭ রানে। এই ইনিংসে ৩৭ রান করলে ওয়ানডেতে ১৪ হাজার রান পূর্ণ হবে ভারত গ্রেটের।
এদিকে ৩৬ বলে ৭ চারে ৪১ রান করা রোহিত শর্মা আউট হওয়ার আগে মাইলফলক ছুঁয়েছেন। ওয়ানডেতে ১১ হাজার রানের ক্লাবে পা রেখেছেন বাংলাদেশের বিপক্ষে ইনিংস দিয়ে। তাসকিনের বলে রিশাদের হাতে ধরা পড়ে বাংলাদেশকে একমাত্র সাফল্য দিয়েছেন রোহিত।
হৃদয়ের ‘হৃদয়’ জুড়ানো সেঞ্চুরি
ঠান্ডা মাথার কাজ হয়তো একেই বলে। সত্যিকারের পরিণত একটি ইনিংস উপহার দিয়েছেন তাওহিদ হৃদয়। পরিণতবোধের পরিচয় দিয়ে কেড়েছেন কোটি ভক্তের হৃদয়। ভারতের বিপক্ষে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির প্রথম ম্যাচে দলীয় রান ভক্তদের মন জুড়াতে পারেনি। তবে হৃদয়ের ব্যাট থেকে আসা সেঞ্চুরিতে “হৃদয়” জুড়িয়েছে সবার।
তার ক্যারিয়ারের প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরিতে ৩৫ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে ৪৯.৪ ওভারে ২২৮ রানে থেমেছে বাংলাদেশ। হৃদয় ১১৮ বলে ১০০ রান করেন ৬ চার ও ২ চারে।
বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনে যে পরিণত বোধের অভাব। ভারতের সঙ্গে তা মেটালেন হৃদয়। শুরুর ধাক্কায় ৩৫ রানে ৫ উইকেটে পরিণত হয়েছিল দল। এমন সময় উইকেট আগলে দলের ইনিংস বড় করাই ব্যাটারের মূল কাজ। হৃদয় নিজেও এমন অবস্থায় পড়েছিলেন আগেও। কিন্তু সেই ম্যাচগুলোয় দলকে টেনে তোলার, একটা ভালো অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হন।
সেই ভুলগুলো শিখিয়েছে হৃদয়কে। তাই ভারতের বিপক্ষে বৃহস্পতিবার সাবধান থেকেছেন। শুরুতে ইনিংস গড়েছেন পরে হাত খুলেছেন। প্রথম ৬০ রানে মাত্র দুটো চার এসেছে হৃদয়ের ব্যাট থেকে। তাতে ক্ষতি ছিল না কোন। ওই সময় দলের ইনিংস সাজানোই ছিল একমাত্র কাজ।
জাকের আলিকে নিয়ে সফল ভাবে সেই কাজ করেছেন হৃদয়। ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের যে কোন উইকেটে সেরা ১৫৩ রানের জুটি এনে দিয়েছেন। জাকের ফিরলে জুটির রান তোলার গতি কমে যায়।
শেষ দিকে পায়ে ক্র্যাম্প না হলে বাংলাদেশকে আরও বেশি রান এনে দিতেন হৃদয়। পায়ের শিরায় টান লাগায় শেষের তিনটি ওভারে হৃদয় স্বচ্ছন্দে খেলতে পারেনি। ইনজুরি না হলে সেঞ্চুরি হাঁকানো হৃদয় দলকে হয়তো আড়াইশো কোটায় নিতে পারতেন।
জাকেরের বিদায়ে জুটি ভাঙল
মাত্র ৩৫ রানে ৫ উইকেট পড়া অবস্থান থেকে দারুণ প্রতিরোধ গড়েছিল বাংলাদেশ। তাওহিদ হৃদয় ও জাকের আলি মিলে দলকে টেনে তুলেছেন। তবে এ জুটি ইনিংসের শেষ পর্যন্ত টিকলো না।
দলকে দুইশোর মুখে রেখে জাকের আলির বিদায়ে ভাঙল ২০৬ বলে ১৫৪ রানের জুটি। ১১৪ বলে ৬৮ রান করে মোহাম্মদ সামির ২০০তম ওয়ানডে উইকেট হয়ে ফিরেছেন জাকের। ৬ উইকেটে ১৮৯ রান বাংলাদেশের। প্রথম সেঞ্চুরির পথে এগোতে থাকা হৃদয় অপরাজিত ৮৪ রানে।
জাকেরকে নিয়ে গড়া ১৫৩ রানের জুটি ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডেতে যে কোন উইকেটে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ। দুবাই মাঠে ষষ্ঠ উইকেটের সর্বোচ্চ জুটিও এটি।
হৃদয়-জাকেরের জোড়া ফিফটি
প্রতিরোধ গড়ে এবার দলকে টানছেন তাওহিদ হৃদয় ও জাকের আলি। দুই ব্যাটারই করেছেন ফিফটি। হৃদয় ক্যারিয়ারের অষ্টম আর জাকের চতুর্থ ফিফটি করলেন। দুজনের ব্যাটে ধাক্কা সামলে উঠেছে বাংলাদেশ। যদিও ভারতকে চাপে ফেলতে হলে বিশাল লক্ষ্য দেওয়া চাই।
হৃদয় ও জাকেরের জুটি থেকে এখন পর্যন্ত ১৯৬ বলে ১৪১ রানের জুটি এসেছে। ৪১ ওভার শেষে তাদের দৃঢ়তায় দলের রান ৫ উইকেটে ১৭৬। জাকের ১০৬ বলে তিনটি চারে ৬০ করেছেন। আর হৃদয় ৯২ বলে তিনটি চার ও ২ ছক্কায় ৭০ রানে অপরাজিত।
এনিয়ে টানা দ্বিতীয় ম্যাচে ষষ্ঠ উইকেট জুটিতে শতরানের বেশি পেল বাংলাদেশ। আগেরটি ছিল জাকের ও মাহমুদউল্লাহর উইন্ডিজের বিপক্ষে।
হৃদয়-জাকেরের ব্যাটে প্রতিরোধ
ব্যাটিং ব্যর্থতার মড়কে দলীয় একশ পার হওয়া অসম্ভব মনে হচ্ছিল। তাওহিদ হৃদয় ও জাকের আলি তা সম্ভব করেছেন। দুজনের ব্যাটে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে কিছুটা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে বাংলাদেশ।
মাত্র ৩৫ রানে ৫ উইকেট হারানোর পর জুটি গড়েছেন হৃদয় ও জাকের। দুজনের ৭৬ রানের জুটিতে ৩০ ওভার শেষে ৫ উইকেটে ১১১ রান করেছে বাংলাদেশ।
বড় শটের দিকে না ছুটে ইনিংস বড় করায় মনযোগী দুই ব্যাটার। মাত্র ২টি করে চার মেরেছেন দুজনেই। জাকের ৭৪ বলে করেছেন ৪০ আর হৃদয় অপরাজিত ৬৪ বলে ৩৬ রানে। তাদের উইকেটে থেকে খেলার সিদ্ধান্তে লাভ হয়েছে বাংলাদেশের।
ভুল শটে বিধ্বস্ত বাংলাদেশ টপ অর্ডার
টুর্নামেন্ট বদলায়, সিরিজ শেষ হয় কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাটারদের ভুলের যেন শেষ হয় না। ভারতের বিপক্সে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির প্রথম ম্যাচে ভুল শটের ধারাবাহিকতায় ম্যাচের শুরুতেই ব্যাকফুটে বাংলাদেশ। ১৫ ওভার শেষে ৫ উইকেট হারিয়ে রান উঠেছে মাত্র ৬৪।
অক্ষর প্যাটেলের বলে রোহিত শর্মা জাকের আলির ক্যাচ হাতে রাখতে পারেননি। নয়তো প্রথম বলেই ফিরতেন এই ব্যাটার। সঙ্গে হ্যাটট্রিক হতো প্যাটেলের। এ যাত্রা বেঁচে গেলেও বাংলাদেশের দুঃখ কমেনি। আগেই যা ক্ষতি হওয়ার হয়েছে।
ইনিংসের প্রথম দুই ওভারে দুই উইকেট দিয়ে শুরু। ছেড়ে দেওয়ার বলে ড্রাইভ করতে গিয়ে ইনসাইডেজ হয়ে ০ রানে ফিরেছেন সৌম্য সরকার। অধিনায়ক শান্তর ব্যাটে রান খরা চলছেই। হারশিত রানাকে সামনের পায়ে ড্রাইভ করতে গিয়ে বল তুলে দিলেন সরাসরি বিরাট কোহলির হাতে। মাত্র ২ বল টিকেছেন কোন রান করতে না পারা শান্ত।
মেহেদি হাসান মিরাজকে নিয়ে ২৪ রানের ছোট জুটি দাঁড় করিয়েছিলেন তানজিদ হাসান তামিম। শুরু থেকে একপ্রান্ত আগলে তামিম-ই যা একটু স্বচ্ছন্দে খেলছিলেন। ছন্দ ভাঙে জুটি ভঙ্গ হওয়ায়। সামির বলে জায়গায় দাঁড়িয়ে ড্রাইভ করার চেষ্টায় স্লিপে ধরা পড়েন ১০ বলে ৫ রান করা মিরাজ। তার বিদায়ের পর অভিজ্ঞ মুশফিকুর রহিম প্রথম বলেই উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে ফিরেছেন ০ রানে।
প্রথম পাওয়ার প্লে শেষ হওয়ার আগেই ৩৫ রানে ৫ উইকেট হারাতে হয় বাংলাদেশকে।
টস জিতে ব্যাটিংয়ে বাংলাদেশ একাদশে নেই মাহমুদউল্লাহ
দুবাই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে নিজেদের প্রথম ম্যাচে টস জিতে ব্যাটিং নিয়েছে বাংলাদেশ। দুবাই স্টেডিয়ামের নতুন উইকেটে ক্রিকেট বিশ্লেষকদের পরামর্শ ছিল টস জিতে ব্যাটিং নেওয়া। ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকায় মনমতো চাওয়াটা পেয়ে গেলেন শান্ত।
তিন পেসার ও দুই স্পিনার নিয়ে ৫ স্পেশালিস্ট বোলারের একাদশ সাজিয়েছে বাংলাদেশ। এতে সুযোগ হয়নি মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের। তার জায়গাতেই খেলছেন রিশাদ হোসেন। এই কম্বিনেশন নিয়েই একটু আলোচনা ছিল। সাত নম্বরে জাকের, মাহমুদউল্লাহ ও রিশাদের কাকে খেলানো হবে। মাহমুদউল্লাহকে পেছনে ফেলে ব্যাটিং-বোলিংয়ের জন্য রিশাদ ও পাওয়ার হিটিংয়ের জন্য জাকের সুযোগ পেয়েছেন।
এদিকে নাহিদ রানাকেও রাখা হয়নি একাদশে। ভারত এই পেসারকে নিয়ে বেশ কাজ করেছে। তাই তরুণ পেসারকে না খেলানো বাংলাদেশের জন্য একরকম কৌশল। তার পরিবর্তে তানজিম সাকিবকে একাদশে রাখা হয়েছে ভারতের সঙ্গে অতীতে ভালো করার অভিজ্ঞতায়।
গত কয়েক মাসে মাঠটির মূল পিচে ইন্টারন্যাশনাল টি ২০, নারী ক্রিকেট মিলিয়ে অনেক খেলা হয়েছে। তাই ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচে অব্যবহৃত একটি পিচ বেছে নেওয়া হয়েছে। আর তাই একটু পাশের পিচ হওয়ায় মাঠের একপ্রান্ত খুব ছোট, অপরপ্রান্ত বেশি বড়। ব্যাটাররা ছোট বাউন্ডারির সুবিধা নিতে পারবেন।
এমন উইকেটে পরে ব্যাট করা কঠিন হবে বলে পিচ রিপোর্ট জানিয়েছেন সাবেক ইংল্যান্ড অধিনায়ক নাসের হুসেইন। শুরুতে উইকেটে কোন ফাটল না দেখা গেলেও সময়ের সঙ্গে তা প্রকাশ পাবে বলে নাসেরের ধারণা। অবশ্য ভারত আগে থেকেই চেয়েছিল আগে ফিল্ডিং নিতে, টস হেরে এমনটাই বলেছেন রোহিত শর্মা।
বাংলাদেশ : নাজমুল হোসেন শান্ত (অধিনায়ক), সৌম্য সরকার, তানজিদ হাসান তামিম, তাওহিদ হৃদয়, মুশফিকুর রহিম, মেহেদি হাসান মিরাজ, জাকের আলি, রিশাদ হোসেন, তাসকিন আহমেদ, তানজিম হাসান সাকিব, মোস্তাফিজুর রহমান।
ভারত : রোহিত শর্মা (অধিনায়ক), শুভমান গিল, বিরাট কোহলি, শ্রেয়াস আইয়ার, অক্ষর প্যাটেল, লোকেশ রাহুল, হারদিক পন্ডিয়া, রবীন্দ্র জাদেজা, কুলদ্বীপ যাদব, মোহাম্মদ সামি, হারশিত রানা।