হাজার হাজার পরীক্ষার্থী অস্বাভাবিক হারে উচ্চ নম্বর পাওয়ায় ভারতের ২০২৪ সালের মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। উঠেছে প্রশ্ন ফাঁস ও জালিয়াতির অভিযোগ।
ভারতে মেডিকেল কলেজগুলোতে ভর্তি পরীক্ষার নাম ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি কাম এন্ট্রান্স টেস্ট-আন্ডারগ্র্যাজুয়েট বা নিট-ইউজি (NEET-UG)। চিকিৎসা শাস্ত্রে পড়ার সুযোগের জন্য এই পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেতে হয়।
ভারতের ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সি (এনটিএ) এই পরীক্ষা নেয়। এনটিএ একটি সরকারি সংস্থা, যা ভারতের কয়েকটি বৃহত্তম পরীক্ষা পরিচালনা করে থাকে।
প্রতি বছর লাখ লাখ শিক্ষার্থী এই পরীক্ষা দেয়, কিন্তু মাত্র এক লাখের কিছু বেশি প্রার্থী মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য বিবেচিত হয়।
কিন্তু এবছর অনেক বেশি সংখ্যক প্রার্থী অস্বাভাবিক নম্বর পেয়েছে। এতে র্যাঙ্কিং সিস্টেমটির অবনমন ঘটেছে এবং এমনকি উচ্চ-স্কোরধারীদেরও ভর্তি হওয়া কঠিন করে তুলেছে।
গত ৪ জুন ফল ঘোষণার পর থেকে প্রশ্নপত্রে ত্রুটি থেকে শুরু করে প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং জালিয়াতির অভিযোগ থেকে ভুল পদ্ধতিতে গ্রেস মার্কস (ক্ষতিপূরণমূলক নম্বর) দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা পুনরায় পরীক্ষা নেওয়ার দাবি তুলেছে এবং এ লক্ষ্যে আদালতে কয়েক ডজন আবেদনও জমা পড়েছে।
যদিও এনটিএ কর্মকর্তারা প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
তবে রবিবার কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান স্বীকার করেছেন, কিছু পরীক্ষা কেন্দ্রে ‘কিছু অনিয়ম’ ধরা পড়েছে।
তিনি বলেন, অনিয়ম পাওয়া গেলে এনটিএ কর্মকর্তাসহ কাউকেই রেহাই দেওয়া হবে না।
মঙ্গলবার, ভারতের শীর্ষ আদালত এনটিএ-কে এক নোটিসে বলেছে, “যদি কারও পক্ষ থেকে ০.০০১ শতাংশ অবহেলাও হয়ে থাকে, তাহলেও সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ।”
কিন্তু শিক্ষার্থীদের জন্য এসব অনেক ছোট সান্ত্বনা। কারণ তারা অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক এই পরীক্ষার জন্য কয়েক মাস বা এমনকি কয়েক বছরও ব্যয় করে।
প্রায় দেড়শ কোটি মানুষের দেশ ভারতে প্রতি বছর লাখ লাখ শিক্ষার্থী একটি ভালো মেডিকেল বা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন দেখে। কারণ তাদের চোখে এই পেশাগুলো অনেক সম্মানের এবং চাকরির সংকটে থাকা একটি দেশে স্থির ও দীর্ঘমেয়াদী আয়ের নিশ্চয়তা দেয়।
এবছর মাত্র ১ লাখ ১০ হাজার আসনের জন্য প্রায় ২৪ লাখ শিক্ষার্থী নিট (NEET) পরীক্ষায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। এ থেকেই বোঝা যায় প্রার্থীদের কতটা তীব্র চাপ এবং তীব্র প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হয়।
মোট আসনের মধ্যে আবার মাত্র ৫৫-৬০ হাজার আসন সরকারি কলেজগুলোর অন্তর্গত, আর বাকী আসনগুলো বেসরকারি কলেজের জন্য। এর মধ্যে আবার অর্ধেক আসন সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের জন্য সংরক্ষিত।
সরকারি কলেজে খরচ কম হওয়ায় শিক্ষার্থীরা সাধারণত সেগুলোতেই ভর্তি হতে চায়। সরকারি কলেজে পাঁচ বছরের এমবিবিএস কোর্সে সর্বোচ্চ ৫ থেকে ১০ লাখ রুপি খরচ হয়। অন্যদিকে, বেসরকারি কলেজগুলোতে এর প্রায় দশ গুণ বেশি খরচ হতে পারে।
নজিরবিহীন ভালো ফল
৪ জুন ফলাফল ঘোষণার পর দেখা যায়, এবার নজিরবিহীনভাবে ৬৭ জন শিক্ষার্থী পূর্ণ নম্বর (৭২০) পেয়েছে। নিট (NEET) পরীক্ষার ইতিহাসে এই ধরনের ফলাফল এর আগে আর কখনো হয়নি।
২০১৬ সাল থেকে নিট (NEET) সরকারিভাবে ভারতের মেডিকেল কলেজগুলোর জন্য ভর্তি পরীক্ষা হিসেবে স্বীকৃত হয়। এরপর থেকে প্রতিবছর এই পরীক্ষায় শুধু এক থেকে তিনজন করে প্রার্থী পূর্ণ নম্বর পেয়েছে।
এমনকি কোনও কোনও বছর একজনও পূর্ণ নম্বর পায়নি। সেখানে এ বছর এক লাফে ৬৭ জন শিক্ষার্থী পূর্ণ নম্বর পাওয়ায় সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
এছাড়া এ বছর ৬৫০-৬৮০ নম্বর পাওয়া প্রার্থীর সংখ্যাও অনেক বেশি। এতে ভারতের শীর্ষ মেডিকেল কলেজগুলোর আসনের জন্য প্রতিযোগিতা তীব্র আকার ধারণ করেছে।
এই অস্বাভাবিক ফলাফল অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। তারা পরীক্ষার পরিচালনা এবং গ্রেডিংয়ে অনিয়মের অভিযোগ করে তদন্তের আহ্বান জানিয়েছেন।
এনটিএ অবশ্য অভিযোগগুলো প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, “পরীক্ষায় কোনও অনিয়ম হয়নি এবং এবছর বেশি সংখ্যক প্রার্থীর উচ্চ নম্বর পাওয়ার কারণ এবার অনেক বেশি শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিয়েছে।”
এনটিএ আরও বলেছে, মাত্র ১৫৬৩ জন পরীক্ষার্থীকে পরীক্ষা কেন্দ্রে আসতে দেরি হওয়ার কারণে এবং পদার্থবিজ্ঞানের একটি প্রশ্নের দুটি সঠিক উত্তর থাকায় ‘গ্রেস মার্ক’ দেওয়া হয়েছিল। উল্লেখ্য যে, শীর্ষ নম্বর পাওয়া ৬৭ জনের মধ্যে ৫০ জনই এই গ্রেস মার্ক পাওয়াদের মধ্যে রয়েছেন।
তবে কয়েকজন প্রার্থী মামলা করলে ভারতের শীর্ষ আদালতে গ্রেস মার্ক বাতিল করার আদেশ দেয়। ওই শিক্ষার্থীরা এনটিএ’র এই গ্রেস মার্ক দেওয়ার সিদ্ধান্তকে নিয়মবহির্ভূত এবং পক্ষপাতমূলক বলছে।
সুপ্রিম কোর্ট আরও বলেছে, যে প্রার্থীরা গ্রেস মার্ক পেয়েছে, তাদের পুনরায় পরীক্ষা দিতে হবে, যা আগামী ২৩ জুন অনুষ্ঠিত হবে।
তবে এরপরও বিক্ষোভকারীরা বলছেন, আদালতের রায় তাদের উত্থাপিত বৃহত্তর সমস্যাগুলোর সমাধান করেনি। যেমন প্রশ্ন ফাঁস, প্রতারণা এবং পদ্ধতিগত দুর্নীতির অভিযোগ।
প্রশ্ন ফাঁসের মহামারি
সুরভী শর্মা (২৩) নামের এক প্রার্থী এবছর পঞ্চমবারের মতো নিট পরীক্ষা দিয়ে ৬৫০ নম্বর পেয়েছেন। তার অভিযোগ, প্রশ্ন ফাঁস ভারতে মহামারি আকার ধারণ করেছে। আর এ কারণেই এতো বেশি সংখ্যক প্রার্থীর উচ্চ নম্বর পাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
সুরভী জানান, উচ্চ নম্বর (৬৫০-৬৮০) পাওয়া প্রার্থীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যহারে বাড়লেও মধ্যম নম্বর (৬১০-৬৪০) পাওয়া প্রার্থীর সংখ্যা একই হারে বাড়েনি।
তিনি বলেন, “এনটিএ কর্মকর্তারা বলেছেন, এ বছর বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থীর উচ্চ নম্বর পাওয়ার কারণ নাকি প্রশ্ন সহজ ছিল। কিন্তু প্রশ্ন যদি সত্যিই সহজ হতো, তাহলে তো প্রত্যেকেরই আরও ভালো করার কথা ছিল, কিছু প্রার্থীর নয়।”
আদালতে আবেদনে পরীক্ষার্থীদের সহায়তা করা ড. বিবেক পাণ্ডেও সুরভীর অবস্থানকে সমর্থন করেন। গত ১ জুন তিনি সুপ্রিম কোর্টে একটি পিটিশন দায়ের করতে ১০ জন শিক্ষার্থীকে সাহায্য করেছিলেন।
ওই ১০ শিক্ষার্থী বিহার রাজ্যের রাজধানী পাটনার পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোতে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ করে তাদেরকে পুনরায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেয়ার আবদন জানান।
পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার পরপরই বিহার পুলিশ ওই অভিযোগের তদন্ত শুরু করে। ১০ মে পুলিশ প্রশ্ন ফাঁস মামলায় চার শিক্ষার্থীসহ ১৩ জনকে গ্রেপ্তারের ঘোষণা দেয়।
১৫ জুন পুলিশ মামলায় জড়িত সন্দেহে আরও নয়জন প্রার্থীকে নোটিস পাঠায় এবং তাদের তদন্তে যোগ দিতে বলে।
বিহারের পুলিশ কর্মকর্তা মানবজিৎ সিং ধিলোন টাইমস অব ইন্ডিয়াকে বলেন, ১৩ জন অভিযুক্ত কয়েক লাখ টাকার বিনিময়ে পরীক্ষার এক দিন আগে একটি ‘সেফ হাউসে’ ৩০ জন পরীক্ষার্থীর কাছে প্রশ্নপত্র ফাঁস করেছিল বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
তিনি বার্তা সংস্থা পিটিআইকে বলেছেন, তদন্ত চলাকালীন পুলিশ কর্মকর্তারা পোস্ট-ডেটেড বা ভবিষ্যতের তারিখ দেওয়া ব্যাঙ্ক চেক এবং আংশিকভাবে পোড়া কাগজপত্র উদ্ধার করেছেন। তারা রেফারেন্সের জন্য এনটিএ থেকে প্রশ্নপত্রের নমুনা চেয়েছেন।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ ছাড়াও পরীক্ষায় প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগও রয়েছে।
অন্য প্রার্থীর হয়ে ছদ্মবেশে পরীক্ষা দিতে আসার অভিযোগে পুলিশ দিল্লিতে তিনজন এবং রাজস্থানে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে। গুজরাট রাজ্যের গোধরায় একটি পরীক্ষা কেন্দ্রে জালিয়াতির চক্রান্তে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে।
রাজনৈতিক দোষারোপ
এই ঘটনায় ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন সরকারের কড়া সমালোচনা করেছে।
বিরোধী দলের নেতারা বিজেপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের বিরুদ্ধে লাখ লাখ শিক্ষার্থীর ‘স্বপ্নের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা’ করার অভিযোগ তুলেছেন।
কংগ্রেস নেতা মল্লিকার্জুন খাড়গে এই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং তার সরকারের বিরুদ্ধে ‘নিট কেলেঙ্কারি ধামাচাপা দেওয়ার’ অভিযোগ করেন।
পরীক্ষায় অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের নেতৃত্বে তদন্তেরও দাবি জানিয়েছে দলটি।
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট আগামী ৮ জুলাই নিট পরীক্ষার ফলাফল সম্পর্কিত অনেকগুলো পিটিশনের শুনানি করতে চলেছে, যার মধ্যে পরীক্ষাটি বাতিল করার একটি আবেদনও রয়েছে।
তথ্যসূত্র : বিবিসি