Beta
শনিবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫
Beta
শনিবার, ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫

কোন ছকে শেখ হাসিনাকে দীর্ঘ সময় রাখতে চায় ভারত

শেখ হাসিনা-গ্রাফিতি
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার পলায়ন স্থান পেয়েছে দেয়ালচিত্রে।
[publishpress_authors_box]

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর তাকে ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশের নতুন সরকার যখন তৎপর হয়ে উঠেছে, তখন তাকে দীর্ঘ সময় রাখার পরিকল্পনাই করতে যাচ্ছে ভারত সরকার।

গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর তাকে ফেরাতে উদ্যোগ নেওয়ার কথা সরকারের পক্ষ থেকে আসার দুদিন বাদে শনিবার নয়া দিল্লির কর্মকর্তাদের বরাতে এই খবর দিয়েছে বিবিসি বাংলা।

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সচিবালয়ের শীর্ষস্থানীয় একজন সরকারি কর্মকর্তাকে উদ্ধৃত করে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেশ লম্বা সময়ের জন্যই শেখ হাসিনাকে ভারতে থাকতে দিতে হবে, এই বাস্তবতার জন্যই নয়া দিল্লি এখন প্রস্তুত হচ্ছে বলে তিনি মনে করছেন।

তার দুদিন আগে বৃহস্পতিবারই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বলেছিলেন, শেখ হাসিনা ভারতে রয়েছেন এবং সেখানেই থাকছেন।

সেদিনই জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচারে পুনর্গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গণহত্যার মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।

তারপর অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছিলেন, শেখ হাসিনাকে ফেরত আনতে উদ্যোগ নেবে সরকার।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর আড়াই মাস ধরে নয়া দিল্লিতেই রয়েছেন শেখ হাসিনা। সম্প্রতি তার অন্যদেশে যাওয়ার গুঞ্জন ছড়ালেও তা নাকচ করে দেয় নয়া দিল্লি।

শেখ হাসিনা।

পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরও ছয় বছর ভারতে ছিলেন শেখ হাসিনা।

৭৭ বছর বয়সী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার এবার ভারতে থাকাটি কোন প্রক্রিয়ায় হবে, সেই প্রশ্নের উত্তর মিলছে না এখনও।

তিব্বতের ধর্মগুরু দালাই লামা বা আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নজিবুল্লাহর স্ত্রী-সন্তানদের মতোই রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া হবে কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চেয়েছে বিবিসি বাংলা।

তার উত্তরে দিল্লি সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তারা বলেছেন, এই মুহূর্তে ভারতের কাছে শেখ হাসিনা একজন অতিথি। তাকে বিশেষ পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে ভারতে আসতে হয়েছে। নিজ দেশে তার নিরাপত্তা বা সুরক্ষা বিপন্ন হয়ে উঠেছিল।

এখন এই ‘অতিথি’র স্ট্যাটাসেই শেখ হাসিনাকে দিনের পর দিন কিংবা মাসের পর মাস রেখে দেওয়া যেতে পারে বলে কর্মকর্তারা ধারণা দিয়েছেন। তারা বলছেন, এক্ষেত্রে ভারতের কোনও অসুবিধা নেই। দেশের পুরনো বন্ধু ও অতিথি হিসেবে তিনি প্রাপ্য সম্মানই পাবেন।

এই মুহূর্তে শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার কোনও পরিকল্পনা নয়া দিল্লি সরকারের নেই জানিয়ে তারা বলছেন, ভবিষ্যতে পরিস্থিতি অন্যরকম হলে তখন তা ভাবা যাবে।

শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও ভারতের রাজনৈতিক মতানৈক্য সৃষ্টির কোনও আশঙ্কা নরেন্দ্র মোদীর সরকার আপাতত দেখছে না।

আবার শেখ হাসিনা নিজেও রাজনৈতিক আশ্রয় চাননি। তাই আগ বাড়িয়ে এখনই সেদিকে যাচ্ছে না নয়া দিল্লি।

ফলে এক কথায় বলতে গেলে আপাতত ভারত শেখ হাসিনাকে ‘আতিথেয়তা’ দিয়েই রাখতে চাইছে নয়া দিল্লি সরকার, রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়ে নয়, উপসংহার টেনেছে বিবিসি বাংলা।

অনাহুত অতিথি নিয়ে হিন্দি একটি প্রবাদ (বিন বুলায়ে মেহমান) স্মরণ করিয়ে দিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন প্রথম সারির কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, “শেখ হাসিনাকে বাস্তবিকই হয়ত ‘বিন বুলায়ে’ দিল্লিতে চলে আসতে হয়েছে, কিন্তু তিনি যে আমাদের মেহমান, তাতে তো কোনও সন্দেহ নেই!”

ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত অজয় বিসারিয়াও মনে করেন, শেখ হাসিনাকে ভারতে থাকতে দেওয়াটা দিল্লির জন্য একটি স্পর্শকাতর জটিলতার বিষয় হতে পারে, কিন্তু তাকে যথাযোগ্য মর্যাদায় এ দেশে রাখা ছাড়া ভারতের সামনে দ্বিতীয় কোনও রাস্তাও নেই।

শেখ হাসিনাকে কেন থাকতে দেওয়ার বিকল্প নেই, তার ব্যাখ্যায় ভারতের কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সঙ্কটের মুহূর্তে শেখ হাসিনার পাশে নয়া দিল্লি না দাঁড়ালে আগামী দিনে দক্ষিণ এশিয়া বা প্রতিবেশী কোনও দেশের কোনও নেতাই ভারতের বন্ধুত্বে ভরসা রাখতে পারবে না।

দিল্লির থিঙ্কট্যাঙ্ক আইডিএসএ-র জ্যেষ্ঠ ফেলো স্মৃতি পট্টনায়ক বিবিসি বাংলার সঙ্গে কথায় ১৯৭৫ সালেও শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার নজির তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, তখনও কিন্তু শেখ হাসিনা সপরিবারে ভারতে আশ্রয় পেয়েছিলেন। কিন্তু টেকনিক্যালি তাকে পলিটিক্যাল অ্যাসাইলাম দেওয়া হয়নি। বরং পরিচয় গোপন রেখে তাকে রাষ্ট্রের একজন অতিথি হিসাবেই রাখা হয়েছিল।

সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তখনকার কংগ্রেস সরকারের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। প্রায় অর্ধশতাব্দী বাদে বিজেপি সরকারের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও একই রকম পদক্ষেপই নিচ্ছেন।

তবে শেখ হাসিনাকে দীর্ঘ মেয়াদে রাখার সিদ্ধান্ত যে বাংলাদেশ-ভারত কূটনৈতিক সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, সেই সতর্কবার্তা দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা।

গত ৫ অগাস্ট হেলিকপ্টারে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল শেখ হাসিনাকে। পরে একটি বিমানে তিনি যান নয়া দিল্লি।

শেখ হাসিনা আছেন কোথায়

১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত প্রায় ছ’বছর ছদ্মপরিচয়ে ও সংবাদমাধ্যমের নজর এড়িয়ে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের দিল্লিতে রাখা হয়েছিল। এবারও তার অবস্থান অজানা।

সামরিক একটি বিমানে চেপে গাজিয়াবাদে হিন্দন বিমানঘাঁটিতে নামার পর এক মুহূর্তের জন্যও প্রকাশ্যে দেখা যায়নি তাকে। তার অবস্থান নিয়ে ভারত সরকারের কেউই মুখ খোলেনি।

হিন্দন মূলত ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি ঘাঁটি। সেখানে একজন ভিভিআইপি অতিথির লম্বা সময়ের জন্য থাকার কোনও সুব্যবস্থা নেই। কাজেই ধারণা করা যায়, শেখ হাসিনাকে সেখানে থেকে অন্য কোথায় সরিয়ে নেওয়া হয়।

শেখ হাসিনা দিল্লিতেই আছেন কি না, তাও নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। তার অবস্থান নিয়ে দু’রকম জল্পনা রয়েছে। একটি হলো- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় আঞ্চলিক পরিচালক হিসাবে দিল্লিতে কর্মরত মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের বাড়িতে তিনি রয়েছে। দ্বিতীয়টি হলো- উত্তরপ্রদেশের মীরাট বা হরিয়ানার মানেসরে একটি আধাসামরিক বাহিনীর অতিথিনিবাস বা ‘সেফ হাউসে’ তিনি থাকছেন।

বিবিসি বাংলা আভাস পেয়েছে, এর মধ্যে প্রথমটির কোনও ভিত্তি নেই। তবে দ্বিতীয় জল্পনাটি সত্য হলেও হতে পারে।

নিরাপত্তার ঘেরাটোপে থাকা শেখ হাসিনা নিজের ইচ্ছেমতো যেখানে খুশি ঘুরে বেড়াতে পারছেন না, এটা যেমন ঠিক; আবার তাকে ঠিক ‘গৃহবন্দি’ও করে রাখা হয়নি। কেননা শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ফোনের অ্যাকসেস বহাল আছে, আমেরিকা বা দিল্লিতে অবস্থানরত নিজের ছেলেমেয়ের সঙ্গেও তার নিয়মিত যোগাযোগ আছে। এমনকি, দলের যে নেতা-কর্মীদের সঙ্গেও তার কথা হচ্ছে।

তবে দিল্লির বিখ্যাত লোদি গার্ডেনে মর্নিংওয়াক কিংবা কোনও সুপারস্টোরে কেনাকাটার যে খবর ছড়িয়েছে, তা ‘১০০%’ হুজব বলে উড়িয়ে দিচ্ছে িববিসি বাংলা।

শেখ হাসিনা যাতে প্রয়োজনে তৃতীয় কোনও দেশে সফর করতে পারেন, এই জন্য ভারত সরকার তাকে ‘ট্র্যাভেল ডকুমেন্ট’ দিয়েছে বলে সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে খবর বের হয়। তবে তা নিয়ে ভারত সরকার কিছু এখনও বলেনি।

গত ৯ জুন নয়া দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদীর নতুন সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা যোগ দিয়েছিলেন তার মেয়ে শেখ সায়মা ওয়াজেদকে পুতুলকে নিয়ে। ফাইল ছবি: পিটিআই

রাজনৈতিক আশ্রয়ের ক্ষেত্রে কী হবে

নজিবুল্লাহর পরিবার কিংবা দালাই লামার মতো শেখ হাসিনা যদি রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেন এবং তা যদি দেওয়া হয়, তবে সেটা সাধারণত পার্লামেন্টে ঘোষণা করা হয়। সিদ্ধান্তটি নেওয়ার আগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনাও করা হয়।

দালাই লামার ক্ষেত্রে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ১৯৫৯ সালে নিজেই পার্লামেন্টে সে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিলেন। তবে নজিবুল্লাহর পরিবারকে আশ্রয় দেওয়ার কথা কয়েক বছর পরে পার্লামেন্টে জানিয়েছিলেন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আই কে গুজরাল।

শেখ হাসিনা প্রথম দফায় (১৯৭৫-৮১) যখন ভারতে ছিলেন, তখন সেটা কাগজে-কলমে রাজনৈতিক আশ্রয় ছিল না। ফলে পার্লামেন্টে তা জানানোও হয়নি। তখন বঙ্গবন্ধুর মেয়ে হিসাবে তাকে আশ্রয় দিয়েছিল ভারত সরকার।

তবে এবার শেখ হাসিনার নিজের পরিচয়ই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের প্রধানমন্ত্রী, সর্ববৃহৎ একটি দলের সভাপতি।

ফলে এমন একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে দীর্ঘ সময় ভারতে রাখার প্রয়োজন হলে একটা পর্যায়ে ‘অ্যাসাইলাম’ দেওয়ার কথা বিবেচনা করতে হতে পারে বলে কোনও কোনও পর্যবেক্ষক মনে করছেন।

তবে সুবিধা হলো এই যে শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের রাজনৈতিক মহলে কোনও তরফেই বিরোধিতা আসার সম্ভাবনা নেই।

দিল্লির জেএনইউ-তে সাউথ এশিয়া স্টাডিজের অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদ্বাজ বিবিসি বাংলাকে বলেন, “মনে রাখতে হবে, দালাই লামাকে আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্তেরও কিন্তু বিরোধিতা করেছিলেন ভারতের কমিউনিস্টরা, যারা তখন চীনের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন।

“কিন্তু শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার প্রস্তাব এলে ভারতের সব দলই যে তা স্বাগত জানাবে, এটা মোটামুটি নিশ্চিত। কারণ তিনি যে পরীক্ষিত ভারত-বন্ধু, এটা নিয়ে গোটা দেশেই একটা ‘ব্রড কনসেনসাস’ (সার্বিক ঐকমত্য) আছে।”

শেখ হাসিনা যদি ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় পান, তবে ঢাকা-নয়া দিল্লির মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘আসামি প্রত্যর্পণ চুক্তি’ অনুযায়ী বাংলাদেশের অনুরোধও মোদী সরকার ফিরিয়ে দিতে পারবে।

এক্ষেত্রে যুক্তি হলো এই- ভারত যাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে, তিনি নিজ দেশে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হতে পারেন এই আশঙ্কা থেকেই সিদ্ধান্তটা নেওয়া হয়েছে। কাজেই তাকে বিচারের জন্য তাদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না।

তবে তেমন সিদ্ধান্ত হলে যে বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব চাঙা হতে পারে, তাও নয়া দিল্লিকে ভাবনার মধ্যে রাখতে হবে, বলছেন বিশ্লেষকরা।  

আরও পড়ুন

সর্বশেষ

সর্বাধিক পঠিত