ভারতে এ বছরও শীত সময়ের চেয়ে আগে বিদায় নিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনে দিশেহারা প্রকৃতির এমন আচরণ বিপাকে ফেলেছে ব্যবসায়ীদের।
তাদেরই একজন নিতিন গোয়েল। ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় পাঞ্জাব প্রদেশে টেক্সটাইল শহর হিসাবে পরিচিত লুধিয়ানায় দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে কাপড়ের ব্যবসা করছে তার পরিবার। জ্যাকেট, সোয়েটার- শীতের এসব পোশাকই বানায় তারা।
তবে গত কয়েক বছরের মতো এ বছরও গ্রীষ্মের আগাম আগমনে নিতিনের পরিবারকে শীতের কাপড় তৈরি বাদ দিয়ে গরমের কাপড় বানাতে হচ্ছে।
নিতিন বিবিসিকে বলেন, “শীতের মেয়াদ কমে এসেছে। সোয়েটারের পরিবর্তে আমাদের এখনই টি-শার্ট বানানো শুরু করে দিতে হচ্ছে।
“গত ৫ বছরে আমাদের বিক্রি অর্ধেকে নেমে এসেছে। আর এ মৌসুমে বিক্রি আরও ১০ শতাংশ কমে গেছে। শুধু করোনাভাইরাস মহামারির বছরে ২০২০ সালে আমরা আগের মতো ব্যবসা করতে পেরেছিলাম।”
কেবল নিতিন নন, ভারতজুড়ে তার মতো আরও অনেক ব্যবসায়ী গত কয়েক বছর ধরে লাভের মুখ দেখছে না। শীত মৌসুম ক্ষণস্থায়ী হওয়ায় খামার ও কারখানাগুলোতে উদ্বেগ বাড়ছে। ফসল ফলানোর সময় পাল্টে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীদের পরিকল্পনাও কাজে লাগছে না।
ভারতের আবহাওয়া বিভাগের পরিসংখ্যান বলছে, ১২৫ বছরের মধ্যে এ বছর সবচেয়ে উষ্ণ ফেব্রুয়ারি দেখেছে তারা। এসময় দেশটির অনেক অঞ্চলে সাপ্তাহিক গড় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা স্বাভাবিকের থেকে ১-৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল।
সংস্থাটি সতর্ক করে বলেছে, এ বছর মার্চ থেকে মে এর মধ্যে স্বাভাবিকের থেকে বেশি সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ও তাপপ্রবাহ দেশের বেশিরভাগ অংশে অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
এমন বিরূপ আবহাওয়া নিতিনের মতো ছোট ব্যবসায়ীদের কেবল বিক্রিই কমাচ্ছে না। একই সঙ্গে তাদের বহু বছর ধরে গড়ে তোলা ব্যবসার পুরো কাঠামো বদলে ফেলতে হচ্ছে।
সারা ভারতে ছড়িয়ে থাকা ব্র্যান্ডের দোকানগুলোতে কাপড় সরবরাহ করে নিতিনের কোম্পানি।
তিনি জানান, এসব দোকান এখন ডেলিভারির পর অর্থ পরিশোধ করে না। বরং তারা অবিক্রিত মালামাল তার কোম্পানিতে ফেরত পাঠাচ্ছে।
এ বছর সরবরাহ করা পণ্যে ক্রেতাদের বড়সড় ডিসকাউন্ট ও প্রণোদনা দিতেও বাধ্য হন নিতিন।
তিনি বলেন, “বড় খুচরো বিক্রেতারা নিশ্চিত অর্ডার সত্ত্বেও পণ্য সংগ্রহ করেনি। এসব কারণে আমার শহরেই কয়েকজন ব্যবসায়ী দোকান বন্ধ করে দিয়েছে।”
লুধিয়ানা থেকে প্রায় ১ হাজার ২০০ মাইল দূরে ভারতের পশ্চিম উপকূলীয় শহর দেবগড়। আলফনসো আম উৎপাদনের জন্য এর খ্যাতি আছে। তবে অতিরিক্ত গরম সম্প্রতি সেখানকার আম উৎপাদন ব্যাহত করে।
দেবগড়ে আম বাগান আছে বিদ্যাধর যোশীর। দেড় হাজারের মতো আম গাছ আছে তার।
হতাশ বিদ্যাধর তিনি বলেন, “এ বছর মাত্র ৩০ শতাংশের মতো উৎপাদন হবে।”
তার ভাষ্য, স্বাদে মিষ্টি ও সুন্দর গন্ধের আলফনসো আম তার অঞ্চলের মূল্যবান রপ্তানি পণ্য হলেও সম্প্রতি রাইগড়, সিন্ধুদুর্গ ও রত্নগিরি জেলায় এই আমের ফলন কমে গেছে।
এসব জেলায় প্রধানত আলফনসো আমই উৎপাদন করা হয়।
যোশী বলেন, “এ বছর আমরা ক্ষতির মুখে পড়তে পারি। কারণ আমাকে সেচ ও সারের পেছনে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি খরচ করতে হয়েছে।”
তিনি জানান, তার অঞ্চলের অনেক কৃষক তাদের শ্রমিকদের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়, কারণ তাদের করার মতো কাজ ছিল না। এসব শ্রমিকদের মধ্যে নেপাল থেকে আসা শ্রমিকও ছিল।
ভারতে প্রধানত শীতে উৎপাদিত গম, ছোলা ও রাই সরিষার ফলনেও হুমকি তৈরি করেছে প্রচণ্ড গরম।
এসব আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে ভারতের কৃষিমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান বলছেন, ভারতে এ বছর বিপুল গম উৎপাদন হবে।
তার আশ্বাসে অবশ্য ভরসা রাখতে পারছেন না বিশেষজ্ঞরা।
দিল্লির গবেষণা সংস্থা কাউন্সিল অন এনার্জি, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ওয়াটারের গবেষক অভিষেক জৈন বলেন, “২০২২ সালে তাপপ্রবাহের কারণে ফলন ১৫-২৫ শতাংশ কমে যায়। এ বছরও এমনটা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।”
এছাড়া তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে কৃষিকাজে পর্যাপ্ত পানি না পাওয়ার ঘটনায় উদ্বিগ্ন অর্থনীতিবিদরা।
কাউন্সিল অন এনার্জি, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ওয়াটারের তথ্যমতে, উত্তর ভারতে জলাধারে পানির স্তর বছরের শুরুতেই ধারণক্ষমতার ২৮ শতাংশে নেমে গেছে। গত বছর যা ছিল ৩৭ শতাংশ।
এর ফলে ফল ও সবজি উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। এমনকি দুধ শিল্পেও এর প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন তারা।
এরই মধ্যে ভারতের কয়েকটি অঞ্চলে দুধ উৎপাদন ১৫ শতাংশ কমে গেছে।
এ বিষয়ে গুজরাটে ব্যাংক অব বরোদার প্রধান অর্থনীতিবিদ মদন সবনাভিস বলেন, “আবহাওয়ার কারণে কম উৎপাদন মূল্যস্ফীতি বাড়াতে পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি নামিয়ে ৪ শতাংশ করার যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, তা সম্ভব নাও হতে পারে।”
তথ্যসূত্র : বিবিসি