থাইল্যান্ড সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধের চাকা বিস্ময়করভাবে উল্টো দিকে মোড় নিয়েছে। মায়াবতী ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ হারানোর দুই সপ্তাহ পর সেটি পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়েছে সামরিক জান্তা। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত ক্রসিং, যেখান দিয়ে প্রায় ১০০ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়।
দেশের অন্যান্য অংশে একের পর এক অপমানজনক পরাজয়ের মুখোমুখি হলেও জান্তা বাহিনী মায়াবতীতে কর্তৃত্ব ধরে রাখতে পারছে বলেই মনে হচ্ছে। তবে বাস্তব পরিস্থিতি অনেক বেশি জটিল।
কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন (কেএনইউ) এই মাসের শুরুর দিকে মায়াবতীর কাছের সব সামরিক ঘাঁটি আকস্মিকভাবে দখল করে নিলে মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে এক নতুন ধাপের সূচনা হয়, যে যুদ্ধ শুরু হয় তিন বছর আগে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সামরিক জান্তার ক্ষমতা দখলের পর।
কয়েক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো মিয়ানমারের সবচেয়ে পুরোনো বিদ্রোহী গোষ্ঠী কেএনইউ শহরটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। তাদের জন্য এটি অনেক বড় বিজয় ছিল, কারণ থাইল্যান্ডের সঙ্গে দেশটির বেশিরভাগ বাণিজ্য এই পথ দিয়েই হয়। এ এলাকায় বেশ কয়েকটি বড় ও খুব লাভজনক ক্যাসিনো কমপ্লেক্স রয়েছে।
তবে বাস্তবতা হলো কেএনইউ আসলে মায়াবতী পুরোপুরি দখল করেনি। বরং শহরের বাইরে ব্যাটালিয়ন ২৭৫ সেনা ঘাঁটি নিয়ন্ত্রণের জন্য মিত্রবাহিনী পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস (পিডিএফ) যোদ্ধাদের একটি ছোট দলকে পাঠিয়েছিল। এছাড়া আগের পুলিশ, অভিবাসন ও স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাদেরই শহর পরিচালনা ও সীমান্ত বাণিজ্য চালু রাখার জন্য বহাল রাখে কেএনইউ।
কেএনইউ এই কৌশল নিয়েছিল ওই অঞ্চলে অন্যান্য শক্তিশালী কারেন সশস্ত্র মিলিশিয়া বাহিনীর উপস্থিতির কারণে, যারা সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত সামরিক জান্তার মিত্র ছিল। কেএনইউর অগ্রগতির ব্যাপারে তাদের প্রতিক্রিয়া অনিশ্চিত ছিল। কেএনইউ নেতৃত্ব বলছে, তারা কারেন গ্রুপগুলোর নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ এড়াতে চেয়েছিল। এ কারণেই তাদের সেনারা সরাসরি মায়াবতীর দখল নেয়নি।
জটিল হিসাব-নিকাশ
এই মিলিশিয়া বাহিনীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়টি নিজেদের কারেন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) বলে আখ্যায়িত করে, যার নেতৃত্বে রয়েছেন স চিট থু নামের একজন ওয়ারলর্ড। ১৯৯০-র দশকে তিনি কেএনইউ থেকে আলাদা হয়ে নিজস্ব বাহিনী গড়ে তোলেন।
স চিট থু মিয়ানমারের কুখ্যাত শ্বে কোক্কো ক্যাসিনো কমপ্লেক্স নিয়ন্ত্রণ করেন। এই ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে মানুষকে ফাঁদে ফেলে অর্থ আদায়ের অভিযোগ রয়েছে।
ক্যাসিনোর আয় দিয়ে কয়েক হাজার যোদ্ধার বেতন-ভাতা দেওয়া শুরুর পাশাপাশি একটি সুসজ্জিত বাহিনী গড়েন স চিট থু। তার বাহিনী ২০১০ সাল থেকে মিয়ানমার জান্তার সমর্থনে সীমান্তরক্ষী বাহিনী হিসেবে কাজ করছে।
গত জানুয়ারিতে স চিট থু জান্তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা। কেএনইউর অভিযোগ, তিনি ব্যাটালিয়ন ২৭৫ ঘাঁটি থেকে বিতাড়িত জান্তা সেনাদের সাহায্য করেছেন, যারা আত্মসমর্পণ করেনি।
কেএনইউ-র সতর্কতার আরেকটি কারণ ছিল সামরিক বাহিনীর বিমান শক্তি। এর আগে দেশের যেসব এলাকায় জান্তার স্থল সেনারা পরাজিত হয়েছে সেখানে জান্তার বিমান বাহিনী ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।
গত সপ্তাহের শেষদিকে জান্তার এমআই৩৫ হেলিকপ্টার গানশিপ ও ওয়াই১২ যুদ্ধবিমান থেকে মায়াবতীতেও কেএনইউর অবস্থান লক্ষ্য করে বোমাবর্ষণ করা হয়। এতে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে এবং হাজার হাজার মানুষ থাইল্যান্ডে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
কেএনইউ সূত্রগুলো আরও বলেছে, থাইল্যান্ডের সেনাবাহিনীও তারেদকে মায়াবতী দখলের জন্য যুদ্ধ না করতে অনুরোধ করেছে। কারণ এতে দুদেশের বাণিজ্য ব্যাহত হবে এবং মিয়ানমার থেকে থাইল্যান্ডে শরণার্থীর ঢল নামবে।
কেএনইউ নেতৃত্ব তাদের বাহিনীকে গত ২৫ এপ্রিল ব্যাটালিয়ন ২৭৫ ঘাঁটি ত্যাগ করার নির্দেশ দেয়। কেএনইউ বলেছে, মায়াবতীতে আরও ধ্বংস এড়াতেই এই আদেশ দেওয়া হয়েছে। তবে শহরের ৩০ কিলোমিটার পশ্চিমে আরও বড় যুদ্ধের দিকে মনোনিবেশ করাও এখন তাদের একটি লক্ষ্য।
গত ১১ এপ্রিল মায়াবতী হারানোর কয়েকদিন পরই জান্তা সরকার সাঁজোয়া যান ও কামানসহ প্রায় এক থেকে দেড় হাজার সেনার অতিরিক্ত একটি দলকে সীমান্তের রাস্তার উপর নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য পাঠায়।
গত বছরের অক্টোবরে জাতিগত বিদ্রোহীদের হাতে শান রাজ্যে পরাজয়ের পর এটিই জান্তা সরকারের সবচেয়ে বড় পাল্টা হামলা প্রচেষ্টা।
জান্তা সেনারা কাওকারেক শহরের বাইরের জঙ্গলময় পাহাড়ের মধ্য দিয়ে মায়াবতীর দিকে যাওয়ার সময় কেএনইউ যোদ্ধারা রাস্তার পাশ থেকে তাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। কেএনইউর হামলায় তাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার গতি ধীর হয়ে যায় এবং বেশ কয়েকটি সামরিক যানবাহন ধ্বংস হয়।
সেনা দলটির নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল সো উইন, যিনি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় শীর্ষ জেনারেল। এ থেকেই জান্তার কাছে মায়াবতীর নিয়ন্ত্রণ কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝা যায়।
কিন্তু জেনারেল সো উইনকে এখন আর জনসম্মুখে দেখা যাচ্ছে না। এ কারণে ধারণা করা হচ্ছে, তিনি হয় আহত হয়েছেন বা নয় তার বস তথা জান্তাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং তাকে সরিয়ে নিয়েছেন।
এই শক্তিশালী সেনাদলটিকে থামানো বা পিছু হটানো কেএনইউর জন্য মায়াবতী দখলের চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হবে। কারণ এর ফলে এই অঞ্চলের সীমান্ত এলাকায় প্রবেশের সব পথ কেএনইউর নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে।
কিন্তু কেএনইউ কয়েকটি বিষয়ে দ্বিধায় রয়েছে। তারা বলেছে, অভ্যুত্থানের পর থেকে কারেন রাজ্যে লড়াইয়ের ফলে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ লাখেরও বেশি, যা রাজ্যটির জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক। জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই বাড়লে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।
কেএনইউকে তার সাতটি সশস্ত্র ব্রিগেডের মধ্যে ঐক্য বজায় রাখতে হবে, যারা ঐতিহ্যগতভাবে নিজেদের এলাকায় উচ্চমাত্রার স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে। ২০২১ সালের সেনা অভ্যুত্থানের আগে কারেন অঞ্চলে শান্তি ও ব্যবসা বাণিজ্যের স্বার্থে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে কতদূর আপস করতে হবে- তা নিয়ে কেএনইউর ব্রিগেডগুলোর মধ্যে তীব্র বিরোধ ছিল।
মিয়ানমারের কারেন বা কায়িন প্রদেশ এশিয়ার সবচেয়ে দরিদ্র অঞ্চলগুলোর একটি।
কেএনইউকে কারেন রাজ্যের অর্থনীতির মূল ভিত্তি মায়াবতীর প্রতি তাদের নীতি কী হবে- এখন সে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। স চিট থু কেএনইউ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা বাহিনী গড়ায় তার প্রতিও ক্ষোভ রয়েছে তাদের। কেএনইউ মনে করে, স চিট থুর ক্যাসিনো কমপ্লেক্সগুলো মানব পাচারের মতো আন্তর্জাতিক অপরাধের উৎস এবং সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া উচিৎ।
কিন্তু স চিট থুর একটি উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা রয়েছে। তিনি শ্বে কোক্কোকে চীনা কোম্পানি ইয়াতাইয়ের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে একটি বিশাল, আন্তঃসীমান্ত বিনোদন অঞ্চল হিসেবে গড়ে তুলতে চান।
আর স চিট থুর বাহিনী এতোটাই শক্তিশালী যে কেএনইউ একা তাকে পরাস্ত করতে পারবে না, এর জন্য থাইল্যান্ডের সহায়তা লাগবে। কারণ থাইল্যান্ড সরকার শ্বে কোক্কোতে বিদ্যুৎ ও টেলিযোগাযোগ সরবরাহ করে।
কিন্তু থাইল্যান্ডের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের শ্বে কোক্কো প্রকল্পে আর্থিক স্বার্থ থাকায় সেটাও সম্ভব না। এমনকি কেএনইউর কিছু সিনিয়র নেতাও শ্বে কোক্কোর ক্যাসিনোর ব্যবসায় জড়িত।
কেএনইউ সূত্রের সঙ্গে আলোচনা থেকে মনে হয়েছে, ১১ এপ্রিল সেখানকার সামরিক ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পরও মায়াবতী দখলের জটিলতাগুলোর মুখোমুখি হওয়ার জন্য তারা তখনও প্রস্তুত ছিল না।
কেএনইউ ৭৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে কারেন রাজ্যের স্বায়ত্বশাসনের জন্য লড়াই করছে এবং এর নেতৃত্ব সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে।
কেএনইউ ইতোমধ্যে সেনা শাসনবিরোধী গণতান্ত্রিক প্রতিরোধ আন্দোলনের সঙ্গে তার ভাগ্যকে দৃঢ়ভাবে বেঁধে ফেলেছে। শহর থেকে পালিয়ে আসা গণতন্ত্রপন্থীদের নিয়ে গঠিত পিডিএফগুলোকে লালন-পালন ও প্রশিক্ষণ এবং জাতীয় ঐক্য সরকারের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল দিয়েছে।
কিন্তু জাতিগত বাহিনী, যুদ্ধবাজ মিলিশিয়া কমান্ডার ও পিডিএফ যোদ্ধাদের মধ্যে সমন্বয় করে জান্তা সরকারকে পরাস্ত করার জন্য সর্বাত্মক হামলা চালানো অনেক বড় একটি চ্যালেঞ্জ। কেএনইউ সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কতটা সফল হতে পারবে- তা এখনও নিশ্চিত নয়।
তথ্যসূত্র : বিবিসি