কাজে লাগছে না এমন কী কী ঘরে গুছিয়ে তুলে রেখেছেন, তা একবার আঙুলে গুণে দেখে তালিকা করেছেন কখনও?
অনেকে ভাবেন যে, কোনো পুরনো বা বাতিল জিনিস ফেলে না দিয়ে কোনো একদিন কাজে লাগবে ভেবে যত্ন করে আলমারি আর স্টোর রুমে রেখে দেয়া বুঝি সঞ্চয়ী গুণ।
কিন্তু ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদন বলছে, এমন অভ্যাস থেকে আপনার মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।
আপনি একটি টি-শার্ট কিনে এনে কিছুদিন পরলেন। রঙ মলিন হলে, ছিঁড়ে গেলে স্বভাবতই আপনি আলমারি থেকে ওই টি-শার্ট সরিয়ে রাখবেন; হয়তো ফেলে দিতেও চাইবেন। কিন্তু এসবে বাধ সাধবেন আপনার মা অথবা বাড়ির কোনো মুরুব্বি।
হয়তো এই টি-শার্ট পরে বাইরে যাওয়া না গেলেও ঘরে পরার পরামর্শ পেতে পারেন আপনি। এতে আপনি আগ্রহী না হলে আপনার টি-শার্ট দিয়ে ঘরের আসবাব ছাড়া হবে এবং তারপর ঘর মোছা হবে। অর্থ্যাৎ যে টি-শার্ট কিনে অনেকদিন পরে আপনার পয়সা উসুল হয়েছে বলে ভেবেছেন, তা এখন আপনার বিনিয়োগের চেয়েও বেশি রকমের ভোক্তা সেবা দিচ্ছে।
শুধু টি-শার্টের সঙ্গেই এমন ঘটে না; ঘরে আসা জামার প্যাকেট, প্রসাধনী বাক্স, স্ন্যাকস পণ্যের প্যাকেট অথবা বাক্স কিংবা জার ও বোতলও না ফেলে দিয়ে বারবার ব্যবহার হতে থাকে। এমনকি ঘরে ওয়ান টাইম গ্লাস এবং বোতল এলেও তা আর ফেলা হয় না দীর্ঘদিন।
ইন্ডিয়া টুডে বলছে, ভারতের ঘরে ঘরে একই কাহিনি দেখা যায়। এখানে বাতিল হওয়ার উপযোগী অনেক জিনিসের পুনর্জন্ম হচ্ছে বারবার।
পরের প্রজন্মের মধ্যে এই প্রবণতা কিছু কম দেখা যায়। আর তাতে ঘরে খানিক দ্বন্দ্ব বেঁধেও যায় দুই প্রজন্মের। কিন্তু জেনে রাখা ভালো, এভাবে অকাজের বস্তু রেখে দেয়া সত্যিকার অর্থেই বিরাট এক সমস্যা।
পুরনো জিনিসে মায়া কেন?
নিউ দিল্লিতে স্যার গঙ্গা রাম হসপিটালের ক্লিনিকাল সাইকোলজিস্ট এবং সিনিয়র কনসালট্যান্ট ড. আরতি আনন্দ বললেন, “আমরা পুরনো জিনিসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা স্মৃতি ও আবেগ মিশিয়ে রাখি। এ কারণেই ওসব ফেলে দেয়া খুব কঠিন হয়ে ওঠে নিজের কাছে।”
এই স্মৃতিকাতরা নিয়ে অনেক গবেষণা দাবি করে, নস্টালজিয়া একটি সুখকর অনুভূতি।
তবে এর সঙ্গে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গে জুড়ে দিলেন আহমেদাবাদের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. সার্থক দেব।
তিনি মনে করেন, আগেকার দিনে মানুষের সীমিত সম্পদে চলাফেলা করার অভ্যাস পরের জীবনে গভীর ছাপ রেখেছে।
“২০০ বছর ধরে উপনিবেশবাদীরা ভারতের সম্পদ শোষণ করেছে এবং তারা জনগণকে ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করতে বাধ্য করেছে। এই দীর্ঘ সময়কাল প্রজন্মের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। তাদেরকে অল্প সম্পদ নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য প্রস্তুতি নিতে এবং যা কিছু পাওয়া যায় তা সর্বোচ্চভাবে ব্যবহার করতে শিখতে হয়েছে।”
“এজন্য আমাদের অনেকেই আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছ থেকে শিখেছি টিউব থেকে শেষ এক বিন্দু পর্যন্ত টুথপেস্ট বার করে ব্যবহার করতে। অথবা একটি পেন্সিল একেবারে ছোট না হওয়া পর্যন্ত ব্যবহার করতে।”
ইতিহাস বিশ্লেষণ থেকে এই মনোবিদ বলেন, অনেক ভারতীয়দের মধ্যে এভাবে জিনিসপত্র সঞ্চয় করার প্রবণতা তীব্রভাবে থাকে; হোক তা পুরানো পোশাক, খালি জার, এমনকি মেয়াদোত্তীর্ণ খাবারও ফেলে দেয়া তাদের জন্য সহজ হয়ে ওঠে না।
এমন মনোভাবের মানুষের মধ্যে সব সময় একটি আশা থাকে, এই অপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলোই হয়তো একদিন কাজে আসবে।
“এই আচরণ অতীতের সঙ্গে সম্পর্কিত; যেখানে দারিদ্র্য এবং সম্পদের অভাবের কারণে নিজের কাছে থাকা বস্তু অমূল্য মূল্য হয়ে উঠত। অনেকের জন্য তাই জিনিসপত্র ফেলে দেওয়া প্রায় অপচয়ের মতো মনে হয়। তারা মনে করেন, ফেলে দিলে এর পেছনে আগের প্রজন্মের কষ্টের অবমাননা হবে।”
মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বিশ্লেষণ করে বলা যায়, মানুষের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ করার একটি স্বাভাবিক চাহিদা থাকে। আর তাই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে মনে হলে তারা অস্থির হয়ে ওঠে।
পুরানো জিনিসপত্র ফেলে দেয়া, হারানো থেকে তেমন উদ্বেগ দেখা দিতে পারে এমন চিন্তার মানুষের ভেতরে। তারা মনে করে, এসব জিনিস ফেলে দিলে প্রিয়জনের স্মৃতির সঙ্গেও সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে।
তবে এমন আচরণের তীব্রতা দেখা দিলে একে ’ক্লিনিকাল ডিজঅর্ডার’ বলতে হবে। এ ধরনের ব্যক্তি এমনকি খালি ম্যাচবাক্সও ফেলে না দিয়ে যত্ন করে রেখে দেন।
ড. আনন্দ মনে করেন, এই আচরণ শারীরিক ও মানসিকভাবে যে কাউকে অবসন্ন করে তুলতে পারে।
তাছাড়া বাতিল জিনিস আলমারি, ঘরে এবং স্টোর রুমে রেখে দেয়া মানে যথেষ্ট পরিমাণে জায়গা নষ্ট করা। এসবের যত্ন করতে গেলে পরিশ্রম ও খরচ বাড়ে। আবার ফেলে রেখে দেয়া মানে ধুলা জমে নোংরা হচ্ছে জায়গা। অর্থ্যাৎ ব্যক্তির অগোছালো আচরণ দেখা যাচ্ছে এতে।
এসব কারণে ব্যক্তির মধ্যে অস্থিরতা, বিষণ্নতা হতে পারে; এমনকি দেখা দিতে পারে অবসেসিভ-কমপালসিভ ডিজঅর্ডার (ওসিডি), বললেন ড. দেব।
“মানুষের মধ্যে টানাপোড়েন দেখা দিতে পারে। একবার মনে হয় ফেলে দেই আবার একবার স্মৃতিকাতর হয়ে আগলে রাখেন এসব। তারপর ওই ব্যক্তি এই চক্রের আটকে থাকেন।”
কীভাবে সারবে এই বাতিক?
ব্যক্তির নিজের ও আশেপাশের মানুষের জীবনে এই আচরণ কী প্রভাব ফেলছে তা নিয়ে ভেবে দেখা খুব জরুরি।
কী কী না ফেলে রেখে দিলে সত্যিকার অর্থে কাজে লাগবে তা নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিতে হবে। পাশাপাশি সবকিছুই জমিয়ে রেখে দিতে হবে কেন এই প্রশ্নের উত্তর জানাও দরকার।
একটি সহজ নিয়ম নিজের উপর প্রয়োগ করে দেখা যেতে পারে- নতুন কিছু ঘরে আসবে এবং পুরনো জিনিস বাতিলের খাতায় নাম লেখাবে।
স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে এমন পুরনো জিনিস ফেলে দেয়ার মতো সচেতনতা তৈরি করতে হবে নিজের মধ্যে।
পুরনো জিনিসের একটি তালিকা করা যেতে পারে। এরমধ্যে কোনো জিনিস হয়তো আর্থিক অস্বচ্ছল কাউকে দেয়া যায়। কিছু জিনিস বিক্রি করে নতুন কিছু কেনা যায়। অথবা কেউ কম দামে কিছু খুঁজলে তার কাছেও বিক্রি করা যায় পুরনো যা কিছু আছে।
যদি হস্তশিল্প বা ডু ইট ইয়োরসেল্ফ (ডিআইওয়াই) করার অভিজ্ঞতা থাকে, তাহলে আপনার দক্ষতার সঙ্গে মানানসই শুধুমাত্র এমন উপকরণই রেখে দেয়া যেতে পারে।
আর যদি নিজের আচরণে এই বাড়াবাড়ি আয়ত্তে আনতে না পারেন, তাহলে দ্রুত মনোবিদের কাছে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে, নিজের ভেতর এই অভ্যাস তীব্রভাবে থাকলে তা কাটিয়ে উঠতে সময় দিয়ে সঠিক পরামর্শ নেয়ার পাশাপাশি ধৈর্য রাখতে হবে।